একবিংশ শতাব্দীতে এসে ক্রিস্টোফার কলম্বাস একটি পৌরণিক চরিত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তাঁর আমেরিকা আবিষ্কারের কাহিনীকে নিয়ে বিভিন্ন গান, কবিতা, পৌরণিক কাহিনীও রচনা করা হয়েছে। আমেরিকায় এই আবিষ্কার কর্তার নামে ৫৪টি প্রদেশের নামকরণ করা হয়েছে।
এছাড়াও ১৯৩১ সাল পর্যন্ত “হেইল, কলম্বিয়া” শিরোনামে আমেরিকার বেসরকারী জাতীয় সঙ্গীত ছিলো। পাশাপাশি, প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সোমবার ফেডারেল হলিডে হিসেবে “কলম্বাস ডে” পালন করা হয়।
এতকিছু সত্ত্বেও, ইতিহাসবিদরা “কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন” এমন কথার সাথে একমত হতে পারেন না। এমনকি পৃথিবী পুরোপুরি নাশপাতির মত গোল তাঁর এমন মতবাদের সাথেও একমত হতে পারেন না। সত্যি বলতে, বিজ্ঞদের পৃথিবীর পরিধি নিয়ে খুব ভালো ধারণা আছে।
এশিয়া মহাদেশকে পৃথিবীর থেকে বড় বলায় তাঁরা কলম্বাসের জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তাদের প্রশ্নের পেছনে – কলম্বাসের স্বভাব, তাঁর জলযাত্রার সফলতা, তাঁর পরিচালিত রাজতন্ত্র বিষয়ক যুক্তি উপস্থাপন করেন। তারা বলেন, তিনি ভ্রমণের অংশ হিসেবে আমেরিকায় এসেছিলেন, এর বেশি কিছু না।
এই ঐতিহাসিক চরিত্রের নানান দিক নিয়ে তারা সন্দেহ প্রকাশ করেন। কিছু কিছু প্রচলিত কথাকে তারা মিথ্যা কিংবা অর্ধ-সত্য বলে অভিহিত করেন।
ক্রিস্টোফার কলম্বাস
কলম্বাসের জন্ম ইতালির জেনোয়া শহরে । তিনি ছিলেন ইতালীয় নাবিক এবং ঔপনিবেশিক। বাবা ছিলেন একজন তন্তুবায়। বাবার পেশার মাধ্যমেই তিনি জানতে পেরেছিলেন প্রাচ্য দেশের উৎকৃষ্ট পোশাক, নানান মশলা, প্রচুর ধন-সম্পদের কথা। আর সেই সূত্রধরে, ক্রিস্টোফারের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন একদিন তিনি জাহাহ নিয়ে পাড়ি দিবেন ভারতবর্ষে। স্বপ্ন থেকেই বড় হয়ে শুরু হয় তাঁর সমুদ্র অভিযান।
কলম্বাসের সমুদ্র অভিযান
মূলত কলম্বাস সম্পদের লোভে খ্রিস্টান ধর্মের নামে নীল সমুদ্রে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আর এই যাত্রার মধ্যেই তিনি দাস প্রথা, লুন্ঠন, নারী নির্যাতন, আদম বিক্রিসহ জঘন্য কিছু কাজ করেন। যার ফলে ক্ষমতাচ্যুত করে স্পেনের জেলে প্রেরণ করা হয়। কলম্বাসের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিতে গিয়ে তাঁর সহযাত্রী বারটোলোম দে লাস কাসা ১৫৫২ সালে প্রকাশিত “হিস্ট্রি অফ দ্যা ইন্ডিজ” গ্রন্থে বলেন,
“এমন অমানবিকতা ও বর্বরতা আমার জীবনে আগে কখনো দেখি নি। আমার চোখের সামনে দেখা সেসব কথা লিখতে গিয়েই আমি কেঁপে উঠছি”।
১৪৯২ সালের আগস্ট মাসে কলম্বাস সান্তা মারিয়া, পিনটা, সান্তা ক্লারা (ডাকনাম নিনা) নামের তিনটি জাহাজ নিয়ে স্পেন ত্যাগ করেন। স্পেন ছাড়ার আগে রাজা ফেরডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলা “প্রথম ভূমি আবিষ্কারকর্তা”-র জন্যে সিলিকন জ্যাকেট ও বার্ষিক দশ হাজার স্প্যানিশ মুদ্রা পুরষ্কারের ঘোষণা দেন।
দুইমাস সমুদ্রে থাকার পর, একটি ভূমি চিহ্নিত হয়। অন্যদিকে, পিনটা জাহাজ থেকে রোদ্রিগো দে ট্রিয়ানা একটি জনবসতি সবার আগে দেখেন। এরপর রোদ্রিগো চিৎকার করে পিনটার ক্যাপ্টেনকে জানান। তারা আগুন জ্বালিয়ে এই আবিষ্কার সবাইকে জানান দেন।
কিন্তু পুরষ্কার গ্রহণের সময় এলে, কলম্বাস দাবী করেন তিনি সেই স্থানটি আরো বেশ কয়েক ঘন্টা আগে আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু অস্ফুট আলোর কারণে তিনি সেটিকে একটি বসতি হিসেবে অভিহিত করেননি। ইসাবেলা কলম্বাসের এই কথা বিশ্বাস করেন। যার ফলে, পুরষ্কারও চলে যায় কলম্বাসের দিকে।
অন্যদিকে স্যান স্যালভাডোর (বর্তমানে বাহামাস) দ্বীপে নামার পর, তিনি খুব ঝটপট করে নেমে সোনার খনি খোঁজার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং স্থানীয়দেরকে দাস বন্দী করেন। এরপর কলম্বাস দেখেন, স্থানীয় আরাওয়াক জাতি তরবারির ভয়ে বন থেকে বেরিয়ে আসে। এখানে মজার ব্যাপার হলো – তারা ভয়ে বিভিন্ন উপহার হাতে করে নিয়ে আসে। এতে করে তারা তাদের দাসত্ব জানান দেয়। বিভিন্ন সাময়িকী থেকে জানা যায়,
“আরাওয়াকরা নিরস্ত্র ছিলো। তারা অস্ত্রের ব্যবহার জানতো না। যার কারণে তারা তরবারির মাথার ধরে টানা টানি করে এবং অজ্ঞতা বশত নিজেদের শরীরে জখম করেন। তাদের এই অজ্ঞতা তাদের ভালো দাস বানাবে বলে তখনই ধারণা পাওয়া যায়। এরপর মাত্র ৫০ জন নিয়ে তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয় এবং তাদের সাথে যা খুশি তাই করা হয়”।
ইউরোপিয়ান পর্যটকদের থেকে জানা যায়, আরাওয়াকরা আতিথেয়তার এবং ভাগাভাগি করার মনোভাবের কারণে বিখ্যাত। আর কলম্বাস এই সুযোগটিই নিয়েছিলেন। এমনকি পরবর্তীতে কলম্বাস এই উপজাতি নিয়ে বলেন,
“তারা অনেক সাদাসিধে এবং অধিকারের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক, এটা তাদের না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। আপনি যদি তাদের কাছে কিছু চান আর তা যদি তাদের কাছে থাকে, তাহলে তারা কখনো আপনাকে ফিরিয়ে দিবে না। এমনকি তা দেবার মত না হলে তারা ভাগাভাগি করবে”।
এসব বিষয় কলম্বাস খুব আগেই টের পেয়েছিলেন। তাই আরাওয়াকদের এই অভ্যাসের সুযোগ নিতে তাঁর দেরী হয় নি। তিনি মহিলাদের কানে স্বর্ণের দুল খুলে নেন এবং তারপর ঘেরাও করে সব স্বর্ণ লুট করেন।
এরপর তিনি যাত্রা করেন কিউবা ও হাইতির দিকে। কিন্তু কলম্বাস মনে করেছিলেন, তিনি এশিয়ার দিকে যাচ্ছেন। যাত্রাপথে তিনি নদীতে স্বর্ণের কণা পান। তবে তাঁর প্রত্যাশা অনুযায়ী অতটা বেশি পান নি। কিন্তু তবুও তিনি স্পেনে গিয়ে বলেছিলেন, যাত্রাপথে তিনি অনেক মশলা, স্বর্ণ ও লোহার খনি পেয়েছেন”।
মূলত এই রিপোর্ট তাকে দ্বিতীয় জলযাত্রার জন্যে অর্থনৈতিক সাহায্য নিতে সুবিধা করে দেয়। ফলে এবার তিনি ১৩টি জাহাজ ও ২০০ জনকে যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি যাত্রা শেষে জাহাজগুলো স্বর্ণে বোঝাই করেন। সাথে সাথে নতুন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও প্রবর্তন করেন। আর এই ব্যবস্থা পরবর্তীতে বিশ্বে একটি ভয়ংকর প্রভাব ফেলে। আর এই ব্যবস্থাটির নাম হলো – দাসপ্রথা।
এরপর ১৪৯৫ সালে কলম্বাস স্যান স্যালভাডোরে ফিরে যান এবং ১৫০০ আরাওয়াককে বন্দী করেন। এই ১৫০০ জনের মধ্যে ৫০০ জনকে তিনি স্পেনে দাস হিসেবে পাঠান। এর মধ্যে ২০০ জন ফিরে আসার সময় মারা যায়। এর ফলে দাস প্রথার ব্যাপক প্রচলন হয়। ১৫০০ জনের বাকী ১০০০ জনকে তিনি ঐ রাজ্যে স্বর্ণ খোঁজার জন্যে বাধ্য করেন। ইতিহাসবিদ হোয়ার্ড জিনের মতে,
“১৪ বছরের উপরে সবাই এই স্বর্ণ খোঁজার কাজে লেগে যায়। এদের মধ্যেই স্বর্ণ খুঁজে না পেলে তাদের হাত কেটে নেওয়া হতো”।
অবশেষে, রাজ্যে পর্যাপ্ত স্বর্ণের খনি না পেয়ে কলম্বাস বাকীদের দাস হিসেবে নিয়ে গেলেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত নতুন কলোনীতে কাজ দিলেন। এসময় অগণিত স্থানীয় মানুষজন মারা যায়। ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, পনের শতাব্দীতে সে অঞ্চলে তিন লাখের মত আরাওয়াক ছিলো।
কিন্তু ১৫১৫ তে এসে মাত্র পঞ্চাশ হাজার আরাওয়াকের দেখা মিলে। এরপর ১৫৩১, ১৬০০ এবং ১৬৫০ সালে পুরো দ্বীপের মাটি কেবল আরাওয়াকদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলো।
কলম্বাসের কাহিনী
কলম্বাস ও তাঁর সৈনিকেরা আরাওয়াক শিশু ও নারীদের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করত। কলম্বাস রুটিন করে লেফটেন্যান্টদের পুরষ্কার সরূপ নারীদের ধর্ষন করতে দিতেন। উদাহরণসরূপ কলম্বাসের একজন সহযাত্রী ও বন্ধু মাইকেল দে কুনোর স্বীকারোক্তিতে এটা প্রমাণ পায়।
তিনি কলম্বাসের সাথে স্যান স্যালভাডোর দিকে দ্বিতীয় যাত্রায় ছিলেন। যাত্রার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন,“আমি নৌকায় উঠতেই একজন সুন্দরী ক্যারিবিয়ান নারীকে দেখতে পাই। তিনি আমাকে বললেন লর্ড অ্যাডমিরাল(কলম্বাস) তাকে পাঠিয়েছে। তারপর আমি তাকে আমার কেবিনে নিয়ে যাই। আমি তাকে গর্ভপাত করাতে চাই। কিন্তু সে আমার সাথে একদম তুচ্ছ ব্যবহার করে যে আমি তাকে ছোঁয়ার মত সুযোগ পাই না। এরপর আমি তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মারতে থাকি। তারপর আমাদের মধ্যে সমঝোতা হয়। তার সমঝোতা দেখেই বোঝা যায়, সে কোন পতিতালয় থেকে উঠে এসেছে”।
নৃশংসতার আরো প্রমাণ পাওয়া যায় পনের শতকের শুরুর দিকে পাওয়া কলম্বাসের একটি চিঠিতে। সেখানে লেখা ছিলো-“বর্তমানে একটি নারীর জন্যে মাথাপিছু ১০০ জন কাতালান রয়েছে এবং এটা খুব সাধারণ ব্যাপার যে বালিকাদের জন্যেও পর্যাপ্ত ব্যাপারী আছে। কিন্তু এখন থেকে চাহিদা অনুসারে কেবল নয় থেকে দশজন একজনকে দাসী হিসেবে নিতে পারবে”।
এছাড়াও কলম্বাসের সময়ে, যৌনরোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ রাজ্যে “সাইফিলস” ছড়ানোর জন্যে কলম্বাসকে দায়ী করা হয়। পরবর্তীতে এই রাজ্য থেকে সারা ইউরোপেও এই রোগ ছড়িয়ে যায়। ইতিহাসবিদরা এই ঘটনাকে “রেনেসাসের সময়ে চাবুক মারা”-র সাথে তুলনা করেন।
এসময় নারীদের জোর করে গর্ভপাত করানো হতো এবং যে বেশি গর্তপাত করতে পারত তাকে আরো বেশি করে শরীরবৃত্তিতে পাঠানো হত। জানা যায়, এভাবে তারা একটা সময় অপুষ্টিতে ভুগতে আরম্ভ করে এবং বাচ্চার জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাতৃদুগ্ধ উৎপাদনে অক্ষম হয়ে যায়। এসময় নারীরা হতাশায় তাদের বাচ্চাকে ডুবিয়ে মেরে ফেলে।
সম্প্রতি স্পেনের আর্কাইভে ফ্রানসিসকো দে বোবাদিল্লার লেখা ৪৮ পৃষ্ঠার একটি নথি আবিষ্কৃত হয়। যেখানে বলা হয়, “কলম্বাসের পরিবারের কাউকে অপমান করলে তাকে উলঙ্গ হয়ে পুরো এলাকায় নাকে খর দেওয়ানো হতো। এরপর তার জিহ্বা কেটে ফেলা হতো। এরপর কলম্বাসের ভাই, বারটোলোম তাকে পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্যে বাহাবা দিতো”।
দে বোবাদিল্লার নথি থেকে আরো জানা যায় এমন বর্বর সব কাজের জন্যে কলম্বাসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে স্পেনের জেলে পাঠানো হয়।
আমর আজকে জানলাম, কলম্বাসের সমুদ্র অভিযান, সেই সাথে বর্বতার গল্প। আরও নতুন কোন তথ্য জানতে অভিযাত্রীর সাথেই থাকুন।
Leave a Reply