ডিনামাইট আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেল:
আলফ্রেড নোবেল কি মৃত্যু বিক্রেতা ছিলেন?
এনামুল রেজা
সময়টা ১৮৮৮। শোকবার্তার শিরোনামটা হয় এরকম- ‘মৃত্যু বিক্রেতার মৃত্যু।’ ফরাসী এক পত্রিকা লেখে, ‘দ্রুততম উপায়ে মানুষ মারার পদ্ধতি আবিষ্কার করে যিনি ধনকুবের হয়েছিলেন, সেই আলফ্রেড নোবেল মারা গেছেন।’
খবরটা তিনি পড়েন ফ্রান্সের কান শহরে ভ্রমণরত অবস্থায়। এলোমেলো হয়ে যায় তার চিন্তার জগত। আসল ঘটনা কি ছিল? ল্যাব-বিষ্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন তার বড় ভাই লুডভিগ নোবেলসহ আরও পনেরো জন!
এই যে বললাম ভ্রমণরত অবস্থায় নিজের মৃত্যুসংবাদ পড়ছেন, এমন অজস্র ভ্রমণেই তার জীবন কেটেছে। বিশেষ করে ইউরোপের নানান দেশে ঘুরে বেড়াতেন ব্যবসায়িক কর্মে। ডায়নামাইট আবিষ্কারের পর প্রকান্ড বিত্ত লাভ করবার পরেও তা থেমে ছিলনা। মহান ফরাসী ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো তার নাম দিয়েছিলেন ‘ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ভবঘুরে’, যদিও এটা হুগোর বলা কিনা এ নিয়ে বিতর্ক আছে।
আলফ্রেড নোবেলের জন্ম এবং পরিবার
সোজাসাপ্টা ভাষায় আলফ্রেড নোবেল, যার জন্ম ২১ অক্টোবর ১৮৩৩ সনে স্টকহোমের এক সুইডিশ পরিবারে, বাবা ইমানুয়েল নোবেলের অস্ত্র ব্যবসায়ের উত্তরাধিকার তিনি বয়ে নিয়ে যান বহু বহু উচ্চতায়, সমগ্র পশ্চিমের অর্থশালী পরিবারগুলোর মাঝে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করেন, এর সবকিছুই সম্ভব হয় ওই মৃত্যু ব্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে। একই অর্থে তো তার জীবনে অন্য সম্ভাবনাও ছিল। কেমন সেটা?
আলফ্রেড তার বাবার অনুগামী না হয়ে মায়ের অনুগামী হলেও হতে পারতেন। মোটামুটি সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে ছিলেন আন্দ্রিয়েত্তে নোবেল। স্বামী যখন রাশিয়ায় ভাগ্য পরীক্ষায় ব্যস্ত, তখন তিনি সংসার চালাতে দিয়ে ফেলেন একটা মুদি দোকান। আলফ্রেড নোবেল মুদি দোকানদার হলে মন্দ কি হত?
ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (রাশিয়া আর ফিনল্যান্ডের মাঝে সংঘটিত ১৮৫৩- ১৮৫৬ সনের যুদ্ধ) ইমানুয়েল তার সেন্ট পিটার্সবুর্গের অস্ত্রকারখানা থেকে নানান সরঞ্জাম রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে সর্বরাহ করতে থাকেন। তার ব্যবসায় জমজমাট হয়ে ওঠে। একজন ইনভেন্টর ছিলেন তিনি। আরও পাওয়ারফুল মারণাস্ত্র উদ্ভাবনের চেষ্টা স্বরুপ ইমানুয়েল তৈরি করেন সি-মাইন। যা দিয়ে মোটামুটি বৃটিশ নৌবহরকে বেকায়দায় ফেলে দেয় রাশিয়ানরা। এ যুদ্ধকালীন অর্থসমাগমেই মূলত বেশ শক্ত একটা অবস্থান তৈরি হয় ইমানুয়েল নোবেলের। সুইডেনের স্টকহোম থেকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে তিনি চলে আসেন স্ব-পরিবারে।
জীবনের এ পর্বে আলফ্রেড নোবেলের শিক্ষাজীবন নতুন মোড় নেয়। তিনি মোটামুটি চারটি ভাষা রপ্ত করেন ১৭ বছর বয়সেই। ইংলিশ-ফ্রেঞ্চ-জার্মান-রাশিয়ান। যদিও পড়েছিলেন মাত্র একটা স্কুলে অল্প কয়েক বছর। রাশিয়ায় চলে আসার পর আর কোন স্কুলে তাকে ভর্তি করানো হয়না। নামকরা গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানেই পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য এবং প্রকৃতি বিজ্ঞান শিখে ফেলেন অন্য তিন ভাইয়ের সাথে।
বাবার ইচ্ছায় নিজের কবিতাপ্রীতি চাপা দিয়ে আলফ্রেড প্যারিসে চলে যান কেমিকাল প্রকৌশলি হবার লক্ষ্যে। হ্যাঁ, এইখানে একটু অবাক হওয়া যাচ্ছে। নোবেল উঠতি যৌবনে কবিতার চর্চা করতেন, বড় হয়ে কবি হবেন এইরকম ভাবতেন। তার মানসের এ স্বত্তাটির ভূমিকা তার জীবন সায়াহ্নের একটা প্রভাবক কি হয়েছিল? তর্কসাপেক্ষ আলাপ।
ডায়নামাইট আবিষ্কার
নোবেলের আত্মজৈবনিক গ্রন্থনায় তার জীবনীকারেরা ডায়নামাইট আবিষ্কারকে একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে এবং খুব ইতিবাচকরূপে বর্ণনা করেছেন।
ইউরোপের আধুনিক রাস্তাঘাট নির্মাণ, রেল কোম্পানীর লাইন বসাতে পাহাড় ধ্বসানো কিংবা নানা পদের খননকাজে ডাইনামাইট ছিল মহান আবিষ্কার। ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন নতুন স্থলপথের দ্রুত নির্মাণ এর ফলে তরান্বিত হয়।
মূলত ডায়নামাইট আবিষ্কারের আগে বিস্ফোরণ জাতীয় কাজগুলো করতে ব্যবহার করা হত গান পাউডার কিংবা নাইট্রো গ্লিসারিন যা খুবই বিপজ্জনক ছিল ব্যবহারকারীদের জন্যেও। সুতরাং বাজারে আসার পর নিরাপদ ব্যবহারযোগ্য এবং শক্তিশালী বিস্ফোরক হিসেবে ডায়নামাইট আকাশ্চুম্বি সাফল্য লাভ করে। প্রধানত আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে নোবেল কোম্পানী এ বস্তু সর্বরাহ করতে থাকে।
এটি যে মারণাস্ত্র তা চাপা থাকার কারণ ছিলনা সে যুগেও। একদিকে আলফ্রেড নোবেল জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি লাভ করেন। অন্যদিকে মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার বিভিন্ন গোষ্ঠি ও ব্যক্তি তার এ আবিষ্কারকে দানবীয় ও মৃত্যুদূত হিসেবে তীব্র সমালোচনা করেন। এ বিস্ফোরক যুদ্ধের চেহারা বদলে দিয়েছে এবং মৃত্যুকে আরও সহজ ও জীবনকে স্বস্তা করে তুলেছে এই ধরণের অভিযোগ উঠতে থাকে। আদতে তো হচ্ছিলও তাই। সেনাবাহিনী কামানের গোলার পরিবর্তে ডায়নামাইট শেল ব্যবহার করতে শুরু করে, যার ফলাফলে প্রাণহানী বেড়ে দাঁড়ায় অজস্রগুণ।
মৃত্যু বিক্রেতা আলফ্রেড নোবেল
ইমানুয়েল আর আন্দ্রিয়েত্তে নোবেলের মোট সন্তান সংখ্যা আটজন। এদের প্রথম চারজনই মারা যায় শৈশব পেরুবার আগেই। নোবেল হচ্ছেন পরবর্তি চারজনের মাঝে তিন নম্বর। এই চার ভাই সফলভাবে পিতার পারিবারিক ব্যবসায়কে চালিয়ে নিতে থাকেন।
মৃত্যু কিন্তু পরিবারটিকে ছেড়ে যায়না, তার করাল গ্রাস চলতে থাকে নানাভাবেই। পারিবারিক গবেষণাগারে তখন চেষ্টা চলছে নাইট্রোগ্লিসারিনকে কীভাবে আরও নিরাপদ, উন্নত এবং শক্তিশালী বিস্ফোরকে উন্নিত করা যায় তাই নিয়ে।
সন ১৮৬৪। ভয়ানক এক বিস্ফোরণে আলফ্রেডের ছোটভাই এমিল মারা যায়। ঠিক যেন ১৪ বছর পর যে ঘটনা তার চেতনাকে নাড়িয়ে দেবে, সেটির উল্টো ফল ঘটায় এ বিস্ফোরণ ও মৃত্যু। আলফ্রেড গবেষণা আরও জোরদার করেন। নিজের মেধার সর্বোচ্চ ঢেলে দেয়া নিরলস শ্রমে ঠিক তিন বছর বাদে নাইট্রোগ্লিসারিন আর ডায়াটোমেকিয়াসের যে পেস্ট আবিষ্কার করেন, তাই চুড়ান্ত রূপ নেয় ডায়নামাইটে।
এই অর্থে বলা যায়, প্রথম পারিবারিক দুর্ঘটনা তাকে উন্মাদগ্রস্থ করে তোলে এ আবিষ্কারের পথে। দ্বিতীয়টিতে তিনি অনুধাবন করেন: যা আবিষ্কার করেছেন, তাই কি তার জীবনকে বহন করবে মৃত্যুর পরেও? আসলেই কি মৃত্যু বিক্রী করে গেলেন এতকাল ধরে?
প্রণয়
৬৩ বছরের জীবনে তার প্রণয় সংক্রান্ত তথ্য তেমন জানা যায়না এবং এটা জানাটা সহজ হয় যে, আলফ্রেড নোবেল বিয়ে করেননি।
তবে বের্থা ভন সুটনারের কথা আমরা বলতে পারি। এই অস্ট্রিয়ান নারী বেশ অনেকদিন তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারি ছিলেন। হয়ত প্রেমিকাও?
তার জীবনে প্রণয়ের ঘ্রাণ বলতে এটুকুই, কারণ বের্থা একদিন হুট করেই চাকুরি ছেড়ে পুনরায় অস্ট্রিয়া ফিরে যান এবং অন্য একজনকে বিয়ে করেন। যদিও তার সাথে নোবেলের পত্র চালাচালি হত এরপর থেকে বাকি জীবন, যে সমস্ত চিঠি প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর অনেক বছরবাদে, ১৯৫৫ সালে। বিয়ের পর সুটনার মূলত বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তার যুদ্ধ বিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডে। প্রকাশিত হয় তার বই- ‘গিভ আপ দা আর্মস।’ পরবর্তিকালে ১৯০১-এ প্রথম নোবেল পুরষ্কার আসরে বের্থা ভন সুটনারকে শান্তিতে নোবেল দেয়া হয়। অনুমিত যে, নোবেল তালিকায় শান্তিতে অবদান রাখা লোকজনকে সম্মানীত করার এ আইডিয়া হয়ত সুটনারের প্রভাবেই আলফ্রেড পেয়ে থাকবেন।
অর্থাৎ বিয়ে না করলেও জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীদ্ধান্তটিতে একজন নারীর প্রধান ভূমিকা ছিল তার জীবনে, এটুকু ভাবা যেতে পারে। নিশ্চিতভাবে ওই শুরুতে উল্লেখ করা বড়ভাই লুডভিগ নোবেলের মৃত্যু ছিল একটা বড় প্রভাবক।
আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যু
৬৩ বছর বয়সে আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুটিও ছিল মোটামুটি এক ক্লান্তিকর ভ্রমণের পরিসমাপ্তি। ফ্রান্সে বসবাস করছেন তখন। ফরাসী সরকার তাকে একেবারে বিদ্রোহী ঘোষণা করে দিল। অভিযোগ ছিল যে গোপনে ইতালির কাছে ব্যালিস্টাইট পাচার করছেন তিনি। বিষয়টাকে অভিহিত করা হল চুক্তিভঙ্গ হিসেবে। বাধ্য হয়ে ফ্রান্স থেকে ইতালির সানরেমোয় চলে এলেন নোবেল। ভূমধ্য সাগরের তীরঘেঁষা এ শহরেই ১৮৯৬ সনের ১০ই ডিসেম্বর হার্ট এটাকে তার মৃত্যু হলো মোটামুটি নিঃসঙ্গ অবস্থায়।
মৃত্যুর আগে তার নামে ৩৫৫টি আবিষ্কারের পেটেন্ট ছিল। ছিলেন খ্যাতিমান ও বিত্তশালী। যদিও দাবি করা হয় তিনি শান্তিবাদি, শেষ পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠিত অস্ত্রকারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৯০টি’তে।
এসমস্ত আবিষ্কার ও ফ্যাক্টরি যে তাকে চর্চিত করবে এইরকম আলফ্রেড নোবেল জীবনের শেষের দিকে ভাবতেন না। সম্ভবত আজীবন অস্ত্র ব্যবসায়ের যে মানবিক দুর্নাম, সেটির অপরাধবোধ থেকেই নিজস্ব পরিবারহীন এ লোকটি ঠিক করেন তার অর্জিত সমস্ত সম্পদ থেকে জীবনের নানান ক্ষেত্রে চুড়ান্ত মেধার সাক্ষর রাখা লোকজনকে যেন আর্থিকভাবে সম্মানিত করা হয়। এই ছিল তার শেষ ইচ্ছে।
নোবেল পুরস্কার
ঘটনাটি সকলের জানা, ১৮৯৬ তখন। যদিও তার নিকট আত্মিয়স্বজনেরা এ স্বীদ্ধান্তকে হঠকারী মনে করেছিল এবং উইলটিকে ভুয়া বলেই প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। সুতরাং ফাউন্ডেশন, মানে নোবেল ফাউন্ডেশন গড়ে উঠতে লেগে যায় প্রায় বছর চারেক।
তাহলে এ আলাপের শেষ এমন দাঁড়ালো। একজন অস্ত্র ব্যবসায়ির বিপুল সম্পদের মানবিক কর্মকান্ডে কার্যকর হবার ইতিহাস লিখবার কথা নোবেল পুরষ্কারের। তাই কি লিখেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত এ সম্মাননা?
সবকিছু মিলিয়েই আলফ্রেড নোবেলের হতাশা মিশ্রিত অনুতাপের সঙ্গীত আমরা শুনতে পাব। মন্দ কী?
মানুষের জয় হোক।
কমেন্টে লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে আপনার মতামত জানান
আরও লেখা পড়ুন:
Leave a Reply