আইয়ুব বাচ্চু এবং একটি রূপালি গিটারের গল্প
সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে… লাইভ কনসার্টে গাওয়ার সময় আইয়ুব বাচ্চুকে একাই পুরো গানটি গাইতে খুব একটা দেখেছি বলে মনে হয় না। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত একই ঘটনা।
একটা গান যে কালজয়ী হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এটি। হয়ত আরো ১০০ বছর পরেও এই গানটি এমনই রয়ে যাবে। শুধু “সেই তুমি” নয়, “রূপালি গিটার”, “আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি”, “ফেরারি মন”, “এখন অনেক রাত”, “হকার”, “আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি”, “বাংলাদেশ”, “তাঁরা ভরা রাতে”, “মেয়ে”, “এক আকাশের তাঁরা”, “ঐ দূর আকাশের তারা রে” সহ তার আরো অসংখ্য গানের ইতিহাস একই।
কিন্তু এই ইতিহাসে লেখা হবে না আর কোন পাতা। কারণ এই গিটার সম্রাট ১৮ই অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। কিন্তু তার ৫৬ বছরের সংগ্রামের গল্পের পুরোটা জানেন না অনেকেই।
তাই অভিযাত্রীর পক্ষ থেকে এই কিংবদন্তীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে আজকের এই আয়োজন।
আমাদের রবিন এবং একটি গিটারের গল্প
আইয়ুব বাচ্চু, তার ডাক নাম রবিন। পরিবারের সবার কাছে এই নামে বেশি পরিচিত তিনি। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের এক হাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ ইসহাক ও মায়ের নাম মৃত নুরজাহান বেগম।
পরিবারের তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। মা মারা গেলেও আইয়ুব বাচ্চুর বাবা এখনও জীবিত রয়েছেন। তবে তার বাবা কোথায় আছেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায় নি। শোনা যায়, তার বাবা পরিবার ত্যাগ করেছিলেন।
তারপর থেকে তার মা-ই পরিবার চালাতেন। অন্যদিকে, আইয়ুব বাচ্চুর দাদা হলেন মরহুম হাজী নুরুজ্জমা সওদাগর। মোজাফফরাবাদ এন.জে উচ্চ বিদ্যালয়, কৃষি অফিস, তহসিল অফিস, খরনা বাজার, মসজিদ, মাদ্রাসা, খরনা রেল স্টেশনসহ ১১টি প্রতিষ্ঠানের জমি দাতা তিনি।
১৯৭৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠেন আইয়ুব বাচ্চু। ভালো ফলাফল করায় বাবা তাকে একটা কালো রঙের গিটার উপহার দেন। কিন্তু গীটারের নেশা তাকে তখনও পেয়ে বসেনি। তবে বাবার থেকে পাওয়া সেই অ্যাকুয়েস্টিক গিটারেই আইয়ুব বাচ্চুর আঙুলে প্রথম টুংটাং ছোঁয়া লাগে।
আজম খানের প্রেমে মশগুল কিশোর রবিন
একদিন টিভিতে গানের একটি প্রোগ্রামে দেখলেন পপ সম্রাট আজম খানকে। অনেক আগে থেকেই আজম খানের ভক্ত রবিন। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন পপ সম্রাটের গান। পাশে ঝাঁকড়া চুলে বোতাম খোলা শার্টে একজন গিটার বাজাচ্ছেন অসাধারণ দক্ষতায়।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তী গিটারিস্ট “নয়ন মুন্সি”। মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে গীটারের মোহে পড়ে গেলেন। তখন তিনি চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্র। কলেজের প্রথমেই নেশাটা যেন চরমভাবে বেড়ে গেল।
চাইলে আমিও হয়তো বখে যেতে পারতাম। কিন্তু মিউজিকই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। আমি সেই লক্ষ্যে ছুটে গেছি।
বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারবাদক জিমি হ্যানড্রিকস, রিচি ব্রাকমোর, কার্লোস স্যানটানাসহ আরো অনেকের বাজানোতে বশীভূত হয়ে যান। তারপর কলেজ জীবনেই পাগলামির বশে বন্ধুদের নিয়ে ফর্মড করে ফেললেন একটি ব্যান্ডের।
নাম দিলেন, “গোল্ডেন বয়েজ”। তবে এরপর আবার নাম পরিবর্তন করে নাম দেন, “আগলি বয়েজ”। তবে ছেলে মানুষি পাগলামি ভাঙতে খুব একটা সময় লাগেনি। ভেঙে যায় ব্যান্ড।
তখনকার সময়ে চট্টগ্রামে “ফিলিংস” ব্যান্ডের খুব নামডাক। প্রায় প্রতিটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে তাদের। আইয়ুব বাচ্চু এই ব্যান্ডের সাথে কাজ করতে চাচ্ছিলেন। কারণ তাতে গিটার প্র্যাকটিসটাও ভালো হবে।
অন্যদিকে, এর আগে ‘ব্যান্ড ৭৭” এর মাধ্যমে পরিচয় ঘটে কুমার বিশ্বজিতের সাথে। তাই কুমার বিশ্বজিতের তাকে নিয়ে আসেন “ফিলিংস” ব্যান্ডে। এটা ১৯৭৮ সালের ঘটনা। “ফিলিংস” ব্যান্ডে এসে ১৬ বছর বয়সে তিনি নিজের প্রথম গান্ রেকর্ড করেন।
গানের শিরোনাম ছিলো, “হারানো বিকেলের গল্প”। গীতিকার ছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। মৌলিক গানের পাশাপাশি ফিলিংসে থাকার তিন বছরে বিভিন্ন ইংরেজী গান করতেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেলে। ফিলিংসের পর, যোগদান করেন তপন চৌধুরী ও নকিব খানের তত্ত্বাবধানে থাকা তৎকালীন সোলসে গিটারিস্ট হিসেবে।
সোলস তখন ছিলো চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যান্ডদল। যদিও ’৮২ সালের দিকে সোলস ব্যান্ড ঢাকায় মুভ করে। যার কারণে, আইয়ুব বাচ্চুও ঢাকায় চলে আসেন। সেই সময়েই সোলসের প্রথম অ্যালবাম, “সুপার সোলস” মুক্তি পায়, অন্য আরেকটি ব্যান্ড “শকিং ব্লু”র সাথে।
এই অ্যালবামের “মন শুধু মন ছুঁয়েছে” ও কুমার বিশ্বজিতের “তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে” গানটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। অন্যদিকে, অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে এটিই ছিলো আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম আত্নপ্রকাশ।
ঢাকায় আইয়ুব বাচ্চু
ঢাকায় আসার প্রথম দিনগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৬ সালে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু বলেন, “আমার সন্তানেরা ছোটবেলা থেকে আমার মুখে একটা গল্প শুনে অভ্যস্ত। এই ঢাকা শহরে ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। উঠেছিলাম এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে।
ঢাকা শহরে আমি যখন ৬০০ টাকা নিয়ে আসি, তখন এখানে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন থাকতেন। আমি কারও কাছেই যাইনি। বিপদে কারও মুখাপেক্ষীও হইনি। নিজেকে গড়ে তুলেছি। কাজে হাত দিয়েছি। কাজের পর কাজ করেছি। এখনো করেই যাচ্ছি। দিনরাত্রি কাজ করে একটা অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি।
আমার কাছে ওই ৬০০ টাকা ছিল ৬ কোটি টাকার মতোই। সামনে অনেক পথ খোলা ছিল। সবকিছু পাশ কাটিয়ে গেছি। চলার পথে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল, যাদের নাম শুনলে আতঙ্কিত হতে হতো। শুধু তা-ই নয়, আমার পরিচিত অনেকে মাদকসেবনও করত।
চাইলে আমিও হয়তো বখে যেতে পারতাম। কিন্তু মিউজিকই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। আমি সেই লক্ষ্যে ছুটে গেছি। ১০ বছর লেগেছে আমার সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে। এই ১০ বছরে আমি ভেসে যেতে পারতাম। হয়তো আমার কোনো পাত্তাই পাওয়া যেত না। কিন্তু আমি ভাসিনি।
আশপাশে নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। অনেক ধরনের লাইফস্টাইলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। কিন্তু যে লাইফস্টাইল আমার পরিচিত না, যেটার সঙ্গে আমার পরিবার একমত না—এ ধরনের লাইফস্টাইল থেকে নিজেকে সংবরণ করেছি।
কারণ, আমার মা কষ্ট পেলে দেশ কষ্ট পাবে। আত্মীয়স্বজনেরা মন ছোট করবেন। দেশ কষ্ট পেলে দুনিয়া কষ্ট পাবে। এ জন্যই নিজেকে সংবরণ করেছি। আমি বলতে চাই, লোভ সংবরণ করা খুব দরকার”।
আইয়ুব বাচ্চু এবং কুমার বিশ্বজিৎ
অন্যদিকে ঢাকার প্রথম দিনের সময়গুলোতে তার সঙ্গী ছিলেন আরেক প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, “আমরা দুজন প্রথম ঢাকায় আসলাম ৭৮-৭৯ এর দিকে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল (শেরাটন) হোটেলের পাশে সাকুরা বারে আমরা অডিশন দিতে আসলাম।
মানে পরীক্ষায় পাশ করলে এই বারে নিয়মিত বাজানোর সুযোগ হবে। ঢাকায় এসে উঠলাম বাসাবোর একটা হোটেলে। দুই দিন গেল, তারপরও অডিশনে ডাকে না। দুজনের পকেট ফাঁকা। পরিবার থেকে তো ‘না’ বলে আসছি।
এরপর এক রাতে হোটেলে বসে বাচ্চুকে বললাম, তোর পকেটে কত আছে? বললো- ৫ টাকা। আমার পকেটে হাত দিয়ে পেলাম ১০ টাকা। বললাম, তাইলে আমরা চট্টগ্রাম ফিরে যাবো ক্যামনে? বাচ্চু তো আবার বেশ মজার লোক। সে আমার এই টেনশনের কোনও পাত্তাই দিলো না।
সে আবার বেশ ভোজন রসিক ছিল। বলে, ‘আগে খাইয়া নিই বেটা। পরে অন্য হিসাব।’ আমি পরে ডাক দিলাম বেয়ারাকে। বললাম, আচ্ছা কমের মধ্যে কী আছে নাস্তা (ডিনার)। বললো, পরোটা আর ভাজি আছে। বললাম, দুইটা পরোটা আর একটা ভাজি নিয়ে আসো।
বেয়ারা আনলো। তখন আবার এগুলা খবরের কাগজে মোড়ায়ে দিতো। দুই পরটা একটা পেপারে। আরেকটা পেপারের টুকরায় ভাজি। বেয়ারা আমাদের রুমে আনার সঙ্গে সঙ্গে ভাজির পেপার ভিজে ধপাস করে হোটেল রুমের ফ্লোরে পড়ে গেল!
আমি তখন বললাম, বাচ্চু রুটি-ভাজিও তোর কপালে নাই। কী আর করা। পানি খেয়ে শুয়ে পড়। বাচ্চু বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে বললো, আরে রাখ তোর কপাল। এই বলে সে ফ্লোর থেকে ভাজিটা তুলে নিলো আরেকটা কাগজে। এরপর দুজনে সেটা তৃপ্তি নিয়ে খেলাম”।
তবে ঢাকায় থাকা আর সোলসের খ্যাতিতে উঠাবসা শুরু হলো বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তির সাথে। আর নিজের প্রথম প্রেম গীটারের সাথেই তখন তার দিন-রাতের কাব্য।
গীটার ছিলো যার ধ্যান জ্ঞান
গীটারের প্রেমে কতটা মগ্ন ছিলেন তার প্রমাণ মেলে সোলসের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য আহমেদ নেওয়াজের বক্তব্যে। তিনি বলেন, “আমরা সবাই প্র্যাকটিস করে সময়মত চলে যেতাম। কিন্তু বাচ্চু রাত ১১টা, ১২টা পর্যন্ত প্র্যাকটিস করত”।
তার ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে, তিনি আশির দশকের একমাত্র সঙ্গীতশিল্পী যিনি ফুল টাইম মিউজিক করতেন। এতে করে তার সঙ্গীত সাধনার জোরালো বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই সাধনাকে সম্বল করে ১৯৮৬ সালে সোলসে থাকা অবস্থায় নিজের প্রথম একক অ্যালবাম, “রক্তগোলাপ” প্রকাশ করেন।
এই অ্যালবামের সুর ও সঙ্গীত ছিলো তার নিজেরই। কিন্তু এখানে মজার ব্যাপার হলো, অ্যালবামের কভারে সুর ও সঙ্গীতের জায়গায় তিনি তার ডাকনাম “রবিন” ব্যবহার করেন এবং শিল্পীর স্থানে আইয়ুব বাচ্চু ব্যবহার করেন।
তবে তার এই অ্যালবামটি শ্রোতাদের মধ্যে তেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছিলো না। তবে এরই মাঝে সোলসের হয়ে “সুপার সোলস” ও “কলেজের করিডর” নামের দুটি অ্যালবামে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেন।
সেই অভিজ্ঞতা আর প্রথম এককের ব্যর্থতা পুঁজি করে ১৯৮৯ সালে প্রকাশ করেন দ্বিতীয় অ্যালবাম, “ময়না”। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছিলো, তৎকালীন স্বনামধন্য অডিও প্রতিষ্ঠান “সারগাম”।
এই অ্যালবামের পর আমরা আইয়ুব বাচ্চুর আসল রূপ দেখতে পাই। তিনি জ্বলে উঠেন আর শ্রোতাপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। এটিকে আইয়ুব বাচ্চুর ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়।
সোলসের সাথে আইয়ুব বাচ্চুর বিরোধ
১৯৯০ সালে সোলস থেকে বেরিয়ে যান। কোন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ নয়, নিজের ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো মূল উদ্দেশ্য। তারপর ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল গড়ে তুলেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। এলআরবি দিয়ে শুরুতে বোঝানো হয়েছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’।
কিন্তু কিছুদিন পর তার এক প্রবাসী বন্ধু জানান এই নামে অস্ট্রেলিয়ায় একটি ব্যান্ড আছে। তাই ব্যান্ডের নতুন নাম রাখা হলো ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। শুরুতেই এলআরবি চমক সৃষ্টি করে ১৯৯২ সালে ডবলস ডেব্যু অ্যালবাম বের করার মধ্য দিয়ে।
আইয়ুব বাচ্চু আশির দশকের একমাত্র সঙ্গীতশিল্পী যিনি ফুল টাইম মিউজিক করতেন।
‘এলআরবি- ১ ও ২’ নামের এই ডবলস প্রকাশ পায় সারগাম থেকে। এটি ছিলো বাংলা অডিওর ইতিহাসে প্রথম ডবল অ্যালবাম। এই অ্যালবামে একটি সাইক্লিক অর্ডারে একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প বলতে চেষ্টা করেছে এল আর বি।
মূলত এই অ্যালবামের অনুপ্রেরণা তিনি পান ইংলিশ রক ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের ১৯৭৯ সালের প্রকাশ হওয়া “দ্যা ওয়াল” থেকে। তার এই ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তা-ভাবনার সফলতার প্রমাণ রাখে এই অ্যালবামের “শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি”, “ঘুম ভাঙ্গা শহরে”, “হকার” গানগুলো জনপ্রিয়তা।
চলো বদলে যাই…
এরপর তার দ্বিতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম “সুখ” বের হয় ১৯৯৩ সালে। সুখ অ্যালবামের “সুখ, “চলো বদলে যাই”, “রূপালি গিটার”, “গতকাল রাতে” উল্লেখযোগ্য গান। গানগুলো কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই। “সুখ” অ্যালবামে আমরা তার কন্ঠের ভার্সেটাইলিটি লক্ষ করতে পারি।
একেক গানে একেক কন্ঠ। এই অ্যালবামের শীর্ষ সঙ্গীত “সুখ” গানটির দৈর্ঘ্য ছিলো ১২ মিনিট। অনিকেত প্রান্তরের আগ পর্যন্ত এটিই ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গান! এরপর পরের বছরই বের করলেন তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম “তবুও”।
এই এ্যালবামেও তিনি এক অদ্ভুত কাজ করেন! তখন প্রতিটি এ্যালবামের এ পিঠ আর ও পিঠের গানের তালিকা দেওয়ার ধারা ভেঙে ফেলে পুরো একটি বাক্যে দিলেন সবগুলো গানের নাম।
১৯৯৪ সালেই ঢাকায় “এবি কিচেন” নামে নিজের মিউজিক স্টুডিও দেন। এরপর থেকে তিনি এবি নামেও পরিচিত হতে থাকেন। এই স্টুডিওতেই কাজ করেন, ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হওয়া তার তৃতীয় একক অ্যালবাম, “কষ্ট”-এর।
আইয়ুব বাচ্চুর এবি হয়ে উঠা
লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা “কষ্ট” গানটি হু হু করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, অ্যালবামের কভারেও ভিন্নতা আনেন নিয়াজ আহমেদ অংশু। একরোখা চেহারা ভিত্তিক কভার থেকে অন্যরকম কিছু পায় শ্রোতারা।
“কষ্ট কাকে বলে”, “কষ্ট পেতে ভালোবাসি”, “অবাক হৃদয়”, ও “আমিও মানুষ” গানগুলোর উপর ভর করে এটি হয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত অ্যালবাম। একই বছর আসে তার ব্যান্ডের অ্যালবাম, “ঘুমন্ত শহরে”।
ঠিক আবার পরের বছর এল আর বি আবার হাজির হয় “স্বপ্ন” ও “ফেরারি মন” নামে তাদের আরো দুইটি অ্যালবাম নিয়ে। “ফেরারী মন” অ্যালবামের গানটি আইয়ুব বাচ্চু লিখেছিলেন তার স্ত্রী চন্দনাকে নিয়ে।
প্রেমিকা এবং গান
গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু জানিয়েছিলেন, “আমার স্ত্রীকে যখন মানে এখন যে আমার স্ত্রী, সে একসময় আমার প্রেমিকা ছিলো। তাকে অনেকদিন ওর পরিবার দেখতে দেয়নি আমাকে। ওর পরিবার থেকে আটকে রাখা হতো। ওই দুঃখ থেকে গানটা লেখা। তো ওই গানটা যে এতো বিখ্যাত হয়ে যাবে, এটা আমি কখনোই চিন্তা করিনি”।
১৯৯৮ সালে আবার ডবলস নিয়ে হাজির তাঁরা। এবারের অ্যালবাম, “আমাদের বিষ্ময়”।
১৯৯৮ পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মিক্সড অ্যালবাম, সিনেমার গান, এনার্জি ড্রিংকের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি করতে করতে আইয়ুব বাচ্চু নিজেই নিজের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে থাকেন।
চলচ্চিত্রে আইয়ুব বাচ্চু
এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে মালেক আফসারীর পরিচালিত “লাল বাদশা” সিনেমার “অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে” গানে কনক চাঁপার সাথে গলা মিলিয়ে প্লেব্যাকে নিজের অভিষেক ঘটান। এরপর একই বছর কাজী হায়াতের পরিচালনায় “আম্মাজান’ ছবির টাইটেল ট্র্যাকে নিজের ভার্সেটাইলিটি প্রমাণ দিয়ে চারপাশে শোরগোল ফেলে দেন। আর ২০১৮ সালে এসে সেটিকে কালজয়ী গান বললেও ভুল হবে না।
এরপর ২০০০ সালে আরমানের পরিচালনায় “গুন্ডা নাম্বার ওয়ান” ছবিতে কাজ করেন। ২০০৪ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় ব্যাচেলর ছবিতে “কেউ প্রেম করে, কেউ প্রেমে পড়ে” গান দিয়ে আবার তোলপাড় করে দেন।
এই গানের মাধ্যমে সর্বসাধারণের মাঝে নতুন ক্রেজ হয়ে উঠেন এস আই টুটুল। এরপর একে একে কাজ করেন রঙ নাম্বার, চাঁদের মত বঊ, চোরাবালি, টেলিভিশনে।
সবশেষে, ২০১৪ সালে নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুলের “এক কাপ চা” সিনেমাতে প্লেব্যাক করার মাধ্যমে প্লেব্যাক থেকে বিদায় নেন। কারণ হিসেবে নিজের কাজের স্বীকৃতির আক্ষেপকে দায়ী করেছেন তিনি।
এদিকে, ব্যান্ড অ্যালবামেও নিয়মিত ছিলেন। ২০০০ সালে মন চাইলে মন পাবে, ২০০৩ সালে অচেনা জীবন, ২০০৫ সালে মনে আছে নাকি নেই এবং ২০০৮ সালে স্পর্শ এল আর বির পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়। তবে এরপর ভালো বিরতি দেয় এই ঐতিহ্যবাহী ব্যান্ড।
কারণ হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু অডিও পাইরেসির কথাই উল্লেখ করেন। এল আর বির সবশেষ অ্যালবাম “যুদ্ধ” বের হয় ২০১২ সালে, ব্যান্ডটির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে।
আইয়ুব বাচ্চুর এ্যালবামসমূহ
শুধু ব্যান্ড নয়, নিজের সলো অ্যালবামে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। প্রেম তুমি কি! (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স (২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫) ছিলো তার একক অ্যালবাম।
এরমধ্যে সাউন্ড অফ সাইলেন্স ছিলো ইন্সট্রুমেন্টাল অ্যালবাম। এটাই ছিলো বাংলাদেশের কোন ব্যান্ড তারকা প্রথম ইন্সট্রুমেন্টাল অ্যালবাম। এটি ছিলো তার ইন্সট্রুমেন্টালের প্রতি ভালোবাসার প্রথম প্রকাশ। এরপর তিনি ২০১৭ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি ইন্সট্রুমেন্টাল ব্যান্ড কনসার্ট করেন।
শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরেও “এবি” একটি ক্রেজের নাম। যার কারণে, বিশ্বের ২৫টির মত দেশে দেড় হাজারেরও বেশি কনসার্টে অংশ নিয়েছেন তিনি। এমনকি এখনো কলকাতার ব্যান্ড শিল্পীরা তাকে আদর্শ ধরে মিউজিক চর্চা করেন।
এই কিংবদন্তী সবসময়ই চাইতেন নতুনদের সাপোর্ট দিতে। যার কারণে ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে নাসিরাবাদের উইন্ড অব চেইঞ্জ রেস্টুরেন্টের রুফটপের এবি লাউঞ্জ উদ্বোধন করেন।
এছাড়াও ২০০৭ সালে দেশের প্রথম ব্যান্ড ও পপ মিউজিশিয়ানদের জন্য ট্যালেন্ট হান্ট “ডিরকস্টার” করেছিলেন তিনিই।
এরপর তিনি ‘গেট সেট রক’ নামের আরেকটি ট্যালেন্ট হান্ট, জনপ্রিয় ও পরিচিত অনেক গায়ক-গায়িকাদের নিয়ে “আর মিউজিক” এবং “সা টু সা” নামে করেছিলেন একটি ইন্সট্রুমেন্টাল শো। নতুন ব্যান্ডদের টিভি পর্দায় আনতে আয়োজন করেছিলেন “আর জেনারেশন”।
আইয়ুব বাচ্চু এবং তরুণ সমাজ
আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন তরুণদের জন্যে একটি অনুপ্রেরণা। তবে তাকে যথার্থ সম্মান হয়ত আমরা দিতে পারিনি। নাহলে, ২০১৪ সালে টি-২০ সেলিব্রেশনের মত একটা গ্লোবাল অনুষ্ঠানে তাকে হয়ত আক্ষেপ করে বলতে হতো না, “আপনারা যারা বাংলা গান শুনছেন তাদের অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের হাত না চলুক, চোখ আর কান তো খোলা আছে?
এতেই চলবে, হাততালি এখন খরচ করে লাভ নেই,এটা পরের জন্য রেখে দিন, চোখ কান খোলা আছে এটাই যথেষ্ট, আপনারা ধৈর্য ধরে বাংলা গান শুনছেন, তার জন্য অনেক ধন্যবাদ, আর একটি গান গাইবো কেবল”।
এছাড়াও একবার পাইরেসি আর জাতীয় পুরষ্কার না পাওয়ার আক্ষেপ থেকে বলেন, “আমার সবগুলা গিটার আগুন দিয়ে পুড়ায় ফেলতে ইচ্ছে করে”।
এবার একটু ব্যক্তিগত আইয়ুব বাচ্চুর দিকে চোখ রাখা যাক। ১৯৯১ সালে বিয়ে করেন প্রেমিকা ফেরদৌস চন্দনাকে। তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় পুত্র আহনাফ তাজওয়ার ও কন্যা ফাইরুজ সাফরা।
আহনাফ তাজওয়ার পরিসংখ্যান নিয়ে পড়াশুনা করছেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে। ২০১৬ সালে একটি কনসার্টে বাবার সাথে গিটারও বাজিয়েছিলেন তাজো।
শারীরিক অসুস্থতা
তবে শারীরিকভাবে দিনকে দিন অসুস্থতা বাড়ছিলো তার। ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর বাচ্চু ফুসফুসে পানি জমার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন।
সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হন। এর আগে ২০০৯ সালে হার্টের সমস্যায় তার হার্টে রিং পড়ানো হয়। তবে ধীরে ধীরে তার হার্টের ক্ষমতা কমে যেতে থাকে।
২০১৮ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি এসে তার হার্টের কার্যক্ষমতা ৩০% এ এসে পড়ে। তখন তিনি হাসপাতালে ছুটে যান চিকিৎসা নিতে। কিন্তু সবকিছু ছিলো স্বাভাবিক পর্যায়ে। তবে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে কনসার্ট থেকে বিরত থাকেননি তিনি।
অসুস্থ শরীর নিয়েই ১৬ অক্টোবর রংপুর জেলা স্কুলে গান বাংলার আয়োজনে কনসার্টে গান করেন তিনি। এই কনসার্টে তার শেষ গান ছিলো, “এক আকাশের তাঁরা তুই”। কিন্তু এর ঠিক দুইদিন পরেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
কিংবদন্তীর শেষ নিঃশ্বাস
১৮ই অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার সকালে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সকাল সোয়া নয়টায় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তী। আকাশের তারার মত মাত্র ৫৬ বছর বয়সে সবার থেকে দূরে চলে যান।
উল্লেখ্য যে, তার মা ২০০৪ সালের ২রা ডিসেম্বর মারা যান। আইয়ুব বাচ্চুর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী চট্টগ্রামে তার মায়ের কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।
Leave a Reply