একটি অনুপ্রেরণার গল্প: জেফ বেজসের শূন্য থেকে শিখরে উঠার যাত্রা

অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজস

জেফ বেজস, একটি অনুপ্রেরণার নাম 

ইন্টারনেটের দুনিয়ায় জেফ বেজস একটি পরিচিত নাম। তাকে ই-কর্মাসের উদ্ভাবক ও পথিকৃৎ বলা হয়। তিনি ই-কমার্স সাইট অ্যামাজন ডট কম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন।

শুধু অ্যামাজন নয়, তিনি তার প্রতিটি উদ্যোগেই সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।

তাহলে চলুন আজ সফল এই মানুষটির জীবনের উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত হওয়া যাক। আজ আলোচনা করার চেষ্টা করবো জেফ বেজসের জীবন ও তার অ্যামাজনের সফলতার গল্প।

কীভাবে শূন্য থেকে আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠানে রুপ নিল অ্যামাজন । দুই পর্বের আয়োজনে আজ থাকছে প্রথম পর্ব– জেফের ব্যক্তিগত জীবনের উত্থান-পতন ।

আর দ্বিতীয় পর্বে থাকবে-  অ্যামাজন শুরুর কথা ও নানান চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে জেফের সাফল্যের গল্প!  

জেফ বেজসঃ জীবন বৃত্তান্ত 

পুরো নাম জেফরি প্রেস্টন জর্গেনসেনতিনি ১৯৬৪ সালের ১২ই জানুয়ারী নিউ মেক্সিকোর অ্যালবুকার্কি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে তার বাবা টেড জার্গেনসন জেফের মায়ের নাম জ্যাকলিন বেজস। টেড জার্গেনসন একজন ইউনিসাইক্লিস্ট ছিলেন।

টেড অ্যালবুর্কিকের স্থানীয় টপ ইউনিসাইক্লিস্টদের মধ্যে একজন। জেফ শিশু থাকা অবস্থায়ই তিনি জাতীয় পর্যায়ের অনেকগুলো অনুষ্ঠানে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

টেড যখন জেফ মাতা জ্যাকলিনকে বিয়ে করেন, তখন টেড ছিলেন মাত্র ১৮ বয়সের এক যুবক আর জ্যাকলিন ছিলেন ১৭ বছরের একজন যুবতী। তারা দুজনেই তখন কেবল হাইস্কুলের গন্ডী পার করেছিলেন।

জেফের জন্মগত বাবা টেড জার্গেনসন একজন মদ্যপ ছিলেন। সাংসারিক কাজের প্রতিও তার খুব একটা মনোযোগ ছিলো না। এর ফলে একটি শিশু সন্তান নিয়ে সংসার পরিচালনা করা জ্যাকলিনের জন্যে কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বিয়ের এক বছরের কাছাকাছি সময় পর-ই জ্যাকলিন ও টেড আলাদা বসবাস শুরু করেন।

জ্যাকলিন জেফকে নিয়ে টেক্সাসে তার মায়ের বাড়িতে চলে আসেন। পরবর্তীতে বিয়ের ঠিক ১৭ মাসের মাথায় জ্যাকলিন টেডের কাছে ডিভোর্সের জন্যে বলেন। টেড কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই ডিভোর্সে রাজি হন।

আইন মোতাবেক সন্তানের অর্থ্যাৎ জেফের জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে তিনি রাজি ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর্থিক সংকটের কারণে তিনি আর অর্থের যোগান দিতে সক্ষম হননি।

অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজস

 

সৎ বাবা এবং জেফ বেজস

ডিভোর্সের তিন বছর পরে, জ্যাকলিন মাইক বেজসকে বিয়ে করেন। মাইক বেজসের জন্মস্থান কিউবাতে। মাইক ১৫ বছর বয়সে আমেরিকায় পালিয়ে আসেন। অতঃপর “ইউনিভার্সিটি অফ আলবুর্কিকে” চাকুরী শুরু করেন।

বিয়ের পরে, জ্যাকলিন-মাইক দম্পতি টেক্সাসে হিউস্টোনে বসবাস শুরু করেন। মাইক স্বেচ্ছায় জেফকে দত্তক নিতে রাজি হন। পরবর্তীতে জেফ মাইকের পদবীই নিজের নামের সাথে যুক্ত করেন।

সৎ বাবার নামের পদবী ব্যবহার ও নিজের বাবার নাম নিয়ে তাকে প্রায়ই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এর জবাবে ১৯৯৯ সালে আমেরিকান ম্যাগাজিন ওয়্যার্ড-এর সাথে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার আসল বাবা টেড জার্গেনসন  সম্পর্কে জেফ বেজোস বলেন,

বাস্তবিক অর্থে, আমি যতদূর জানি তিনি কেবল জন্মসূত্রে আমার বাবা। ডাক্তারের ফরম পূরণের সময় “বাবার নাম” এর ঘরে তার নাম লেখতে গেলেই কেবল তার নাম আমার মনে পড়ে। এমনকি তার সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ হয়েছে বলে মনে পড়ে না”   

সম্পর্কের এমন কাঁটাতারে বিঁধে পড়লেও জেফ ও তার মা পরবর্তীতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। বর্তমান বিশ্বের অন্যান্য সিইওদের মত জেফ কোন সাধারণ ঘরের কেউ ছিলেন না। জেফের শিশু বয়সের সময়কালে জেফের মায়ের টেক্সাসে ২৫ একরের মত সম্পত্তি ছিলো।

পৃথিবীখ্যাত ৮জন সফল ব্যাক্তির গল্প | পড়তে ক্লিক করুন

জেফ বেজসের শৈশব    

জেফ তার শিক্ষাজীবনের শুরুর দিক কাটিয়েছেন হিউস্টোনের রিভার ওকস এলিমেন্টারি স্কুলে। তিনি এই স্কুলটিতে ফোর্থ গ্রেড থেকে সিক্সথ গ্রেড পর্যন্ত পড়েছেন। তিনি গ্রীষ্মকালীন অবকাশ সময়টা তার নানার বাড়িতে কাটাতেন।

তখন জেফ নিজেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখতেন। শখের কাজের পাশাপাশি তিনি ফার্মের বিভিন্ন কাজে দক্ষ হয়ে উঠেন। পরবর্তীতে এসব অভিজ্ঞতা তার অনেক কাজে লাগে বলে তিনি জানান।

তিনি তার নানা “লরেন্স জাইজ” কে নিজের রোল মডেল হিসেবে মনে করেন। এসব কাজের পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই মেকানিক্সের প্রতি তার তীব্র আগ্রহ ছিলো। তিনি স্ক্রুডাইভার দিয়ে খাঁচা ভেঙে ফেলতেন। এছাড়াও একদম ছোট বয়সে তিনি একটি ইলেকট্রিক অ্যালার্ম তৈরী করেন।

মূলত, ছোট-ভাইবোনদের নিজের ঘরের থেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্যে তিনি অ্যালার্মটি তৈরী করেন। জেফ নিজের ঘরকে ছোটবেলায় এক রকম ল্যাবরেটরী বানিয়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে তার বাবা-মা এগুলোকে গ্যারেজে সরিয়ে নিতে বলেন।

অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজস

 

জেফ বেজসের শিক্ষাজীবন 

ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি তার তীব্র আগ্রহ ছিলো। সে আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে স্কুলের সিক্সথ গ্রেডে থাকা অবস্থায় জেফ নিজের স্কুলেই প্রথম ব্যবসা শুরু করেন।

তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন “দ্যা ড্রিম ইনস্টিটিউট”। এটি ছিলো ফোর্থ, ফিফথ, সিক্সথ গ্রেডারদের জন্যে একটি সামার ক্যাম্প। এই সামার ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করতে হলে নির্দিষ্ট কিছু বই পড়তে হতো।

সিক্সথ গ্রেডের পড়া শেষে, তার পুরো পরিবার ফ্লোরিডায় চলে আসে। তখন “মিয়ামি পালমেটো সিনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিনি একাডেমিক পর্যায়ে খুব ভালো করতে থাকেন।

এসময় তিনি কম্পিউটারের প্রতি তার ঝোঁক আবিষ্কার করেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডার “সায়েন্স ট্রেনিং প্রোগ্রাম” এ আমন্ত্রিত হন।

নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর দিয়ে তিনি এই প্রতিযোগিতায় “সিলভার নাইট পুরষ্কার” পান। তিনি তার হাই স্কুলে সর্বোচ্চ নাম্বার প্রাপ্তির জন্যে ভ্যালেডিক্টোরিয়ান হন

মুসলিম স্বর্ণযুগের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ইবনে সিনার জীবনী | পড়তে ক্লিক করুন

অতঃপর তিনি ইউনিভার্সিটি অফ প্রিন্সটন থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। তিনি নিজের আগ্রহের জায়গা অর্থ্যাৎ কম্পিউটার সায়েন্স নিয়েই পড়ার সিদ্ধান্ত নেন।

ফলে তিনি একই সাথে কম্পিউটার সায়েন্স এবং তড়িৎকৌশল বিদ্যায় ইউনিভার্সিটি অফ প্রিন্সটন থেকে ১৯৮৬ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তিনি প্রিন্সটনে পড়ার সময় “দ্যা তাও বেটা পাই অ্যাসোসিয়েশন” এ সদস্য হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সামার জব অর্থ্যাৎ কেবল গ্রীষ্মকালের সময়ে চাকুরী করতেন। এসময় তিনি নরওয়েতে প্রোগ্রামার ও অ্যানালাইসিস্ট হিসেবে কাজ করেন।

সে বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকা অবস্থায় তিনি একটি আইবিএম প্রোগ্রামে কাজ করেন। এছাড়া তিনি “প্রিন্সটন স্টুডেন্ট ফর দি এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ স্পেস” –এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজস

 

কর্ম জীবনে জেফ বেজস  

স্নাতক শেষ করার পর, তিনি “ওয়াল স্ট্রিটে” চাকুরী নেন। এসময়টায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের প্রচুর চাহিদা ছিলো। যার ফলে তিনি অনেকগুলো আইটি ফার্মে চাকুরীর সুযোগ পান।

ওয়াল স্টিটের পর, তিনি ফিটেলে কাজ শুরু করেনএখানে তিনি আন্তর্জাতিক বাজারে নেটওয়ার্কিং করার জন্যে কাজ করেন। কাজের সুবাদে তাকে প্রতি সপ্তাহে নিউওয়ার্ক আর লন্ডনে যাতায়াত করতে হত।

তিনি “ব্যাংকারস ট্রাস্ট” এ চাকুরীকালীন অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটি সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু সেখানেও খুব বেশি দিন স্থায়ী হন নি।

তার চাকুরী জীবনের পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উনি প্রথম দিকে টেকনোলজি ফার্মগুলোতে কাজ করলেও পরবর্তীতে তিনি বিজিনেস ফার্মে কাজ করেন।

তবে বিজনেস ফার্ম কিংবা টেকনোলজি ফার্ম দুই ক্ষেত্রেই নিজের সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এরপর তিনি ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম “ডি ই শ অ্যান্ড কোং” এ চাকুরী করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ছিলো জেফের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনেকটা ভিন্ন।

জেনে নিন ১০টি শখ যা আপনার কর্ম জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে

“ডি ই শ অ্যান্ড কোং” স্টক মার্কেট অর্থ্যাৎ পুঁজি বাজারের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন তৈরী করত। পাশাপাশি তারা স্টক মার্কেট নিয়েও গবেষণা করত। এই প্রতিষ্ঠানটি তার কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রধান মোড় ছিলো

এখানে তিনি তার বর্তমান স্ত্রী “ম্যাকেঞ্জি বেজোস” এর সাথে পরিচিত হন।

প্রেম এবং  দাম্পত্য জীবন 

ম্যাকেঞ্জি বেজোস ইউনিভার্সিটি অফ প্রিন্সটন-এ ইংরেজি সাহিত্যের উপর স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। তিনি একই প্রতিষ্ঠানে সহযোগী গবেষক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি একজন ঔপন্যাসিকও।

তার লেখা প্রথম উপন্যাস The Testing of Luther Albright  ২০০৬ সালে “আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড” পায়। “ডি ই শ” ইন্টারভিউ বোর্ডে জেফ প্রথম ম্যাকেঞ্জির ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। ছয় মাসের প্রণয় পূর্ণতা পায় ১৯৯০ সালের বিবাহ বন্ধনের মধ্য দিয়ে।

ধন্যবাদ এতক্ষণ আমাদের সাথে থাকার জন্য ।  

জেফ বেজসের জীবনীটি ভিডিও আকারে দেখুন নিচে 

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top