জেফ বেজসের জীবন ও তার অ্যামাজনের সফলতার গল্প নিয়ে দুই পর্বের দ্বিতীয় পর্ব এটি । এই পর্বে থাকছে- অ্যামাজন শুরুর কথা ও নানান চড়াই-উৎরাই পেড়িয়ে জেফের সাফল্যের গল্প !
আগের পর্বটি কেউ মিস করে থাকলে এখনি পড়ে আসু নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
পড়ুন-জেফ বেজসের শূন্য থেকে শিখরে উঠার যাত্রা
“ডি ই শ অ্যান্ড কোং” এ চাকুরীকালীন অবস্থায় ১৯৯৪ সালে নতুন একটি প্রজেক্টের জন্যে জেফ বেজস ইন্টারনেটের বিভিন্ন বিষয়ের পরিসংখ্যান অনুসন্ধানে করেন। সেখান থেকে তিনি এক অভাবনীয় তথ্য পেয়ে যান।
তিনি দেখেন, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের ব্যবহার প্রতিমাসে প্রায় ২৩০০ শতাংশ বেড়ে চলেছে। ঠিক তখনই জেফ অনলাইনে প্রোডাক্ট বিক্রির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ খুঁজে পান। এই ভাবনা থেকে তিনি চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জেফ বেজসের সিদ্ধান্ত
তারপর তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা ডি ই শ-র প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড ই শ-কে জানান। তবে ডেভিড ই শ তাকে কোম্পানিতে থাকার জন্যে কেন্দ্রীয় পার্কে লং ওয়ার্কে বিভিন্নভাবে প্রস্তাবনা দেন।
কিন্তু জেফ নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। তিনি এবং ম্যাকেঞ্জি একই সাথে চাকুরী ছেড়ে দেন। শুরু হয় অনলাইন কমার্সের দিকে যাত্রা।

চাকুরী ছাড়ার পর তিনি নিউইয়র্ক থেকে সিয়েটলে চলে যান। মূলত তিনি সিয়েটল থেকে ই-কমার্স সাইট পরিচালনা করার প্ল্যান করেছিলেন।
নিউইয়র্ক থেকে সিয়েটলের প্রায় ২৯০০ মাইলের পথের যাত্রায় তিনি অ্যামাজন ডট কমের মূল পরিকল্পনা করেন। অ্যামাজনের পরিকল্পনা তৈরীর ক্ষেত্রে অনলাইনে বিক্রির উপযোগী প্রায় ২০ ধরণের প্রোডাক্টের লিস্ট করেন।
এর মধ্যে সিডি, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার সহ নানান প্রোডাক্ট ছিলো। তবে এগুলোর মধ্যে থেকে তিনি অনলাইনে বই বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। মূলত অ্যামাজনকে একটি অনলাইন বুক স্টোর হিসেবে তৈরী করতে চেয়েছিলেন।
পাশাপাশি আরেকটি কারণ হলো – আমেরিকান সরকার তৎকালীন সময়ে কোন ক্যাটালগ অভ্যন্তরীণ মেইল-অর্ডারের মাধ্যমে পাঠানোর ক্ষেত্রে ট্যাক্স মওকুফের ঘোষণা দেয়। ফলে জেফ কোন প্রোডাক্ট বিক্রেতার কাছে পাঠালে তাকে কোন ট্যাক্স দিতে হবে না।
ই-কর্মাস সাইট অ্যামাজনের যাত্রা শুরু
পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে তিনি অ্যামাজনকে পুরোপুরি প্রস্তুতের কাজে লেগে যান। অ্যামাজনের শুরু হয় তার সিয়েটলের বাড়ির গ্যারেজ থেকে।
কিন্তু একটি অনলাইন শপ চালু করার জন্যে পুরো মূলধন তার ছিলো না । তাই তিনি পরিচিত সবার কাছে থেকে ফান্ডিং শুরু করেন। তার স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি এসময় ল্যাপটপ, ফোনকল, মিটিংয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী খোঁজা শুরু করেন।
অ্যামাজনের ফান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন জেফের বাবা মাইক বেজস ও মা জ্যাকলিন বেজস। তাদের রিটায়ার্ডমেন্টের ৩ লাখ ডলার তারা অ্যামজনে লগ্নি করেন।
বন্ধু আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে তিনি আরো ৭ লাখ ডলার যোগাড় করেন। সবমিলিয়ে, ১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আমাজনের যাত্রা শুরু হয়।

তবে জেফের এই সম্ভাবনাময় ব্যবসার নাম শুরুতে “অ্যামাজন” ছিলো না। ১৯৯৪ সালের ৫ই জুলাই অ্যামাজন প্রথমে “ক্যাডাব্রা” নামে যাত্রা শুরু করে।
কিন্তু এর ঠিক এক বছর পর, আইনজীবির সাথে সাথে আলাপকালে জেফ “ক্যাভাডার” শব্দটি শোনেন। তিনি জানতে পারেন ক্যাভাডার শব্দের অর্থ “মরদেহ”।
তখন তিনি এই নামটিকে বাদ দিয়ে দেন। এছাড়াও “স্টারটেক” সিরিজের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে “মেক ইট সো ডট কম” কেও বিকল্প নাম হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। লিস্টিংয়ে সাইটকে আগে রাখতে “aard.com” (আর্ড ডট কম) নামে সাইট লঞ্চ করতে চেয়েছিলেন।
সাইটের নাম নিয়ে বিড়ম্বনা
কিন্তু অর্থগত কারণে তিনি এটিকে বাদ দেন। পরবর্তীতে তিনি ডিকশনারীতে A আদ্যক্ষরের নাম খুঁজতে গিয়ে অ্যামাজন শব্দটি পেয়ে যান। শব্দটি প্রথমেই নজর কাড়ে বানানগত কারণে। কেননা AMAZON বানান A থেকে Z কে প্রতিনিধিত্ব করে।
তিনি শুরুতে যেহেতু প্রায় সব ধরণের বই ই-কমার্স সাইটে রাখতে চেয়েছিলেন তাই এই নামটির সাথে তার বিজনেস গোলের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ঠিক এ কারণে অ্যামাজনের লোগোতে অ্যামাজন A থেকে Z এ একটি দাগ রয়েছে।
অ্যামজন ডট কম নাম হিসেবে বেছে নিলেও Awake.com, Browse.com, Bookmall.com, and Relentless.com নামে কয়েকটি ডোমেন রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন।

জেফ ও ম্যাকেঞ্জি একসাথে মিলে তাদের দুইটি শোবার ঘরকে ব্যবসায়িক কাজের জন্যে উপযুক্ত করে তোলেন। গ্যারেজকে গুদাম হিসেবে প্রস্তুত করেন। এরপর শুরু হলো কর্মী নিয়োগ।
জেফের স্ত্রী ম্যাকেঞ্জি অ্যামাজনের শুরু দিকে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে সময়ে কোম্পানির কর্মীদের মিটিংয়ের জন্যে কোন নির্দিষ্ট স্থান ছিল না। কর্মীদের সাথে মিটিং “বার্নেস এবং নোবেলের বুকস্টোরে” হতো।
সাইট লঞ্চের পর, সাইটকে বিভিন্ন প্লাটফর্মে টেস্ট করার জন্যে তারা ৩০০জন কর্মীকে নিযুক্ত করেন। ১৬ জুলাই ১৯৯৫ সালে অ্যামাজন ডট কম চালু হলে তারা এই ৩০০ জন কর্মীকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যেতে বলেন।
ব্যবসার প্রসার এবং সাফল্য
কোন একটা পণ্য বিক্রি হওয়া মাত্রই সেটা জানানোর জন্যেও বলা হয়। কিন্তু বেশি দিন এই ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব হয় নি। কেননা একমাসে মধ্যেই ৫০টি রাজ্যে এবং ৪৫টি দেশে অ্যামাজন ছড়িয়ে পড়ে।
সে বছরের সেপ্টেম্বর তাদের সাপ্তাহিক বিক্রির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ডলারে। অন্যদিকে, এ বছরই ক্লেইনের পারকিন্স কওফিল্ড অ্যান্ড বায়ার্স অ্যমাজনে ৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। কিন্তু তখনো অ্যামাজন অনলাইন স্টোর হিসেবে পরিপূর্ণ ছিলো না।
কারণ তখন ফেস টু ফেস বিক্রি হতো। এসময় অ্যামাজনের কর্মীদের সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টারও বেশি সময় কাজ করতে হতো।
এমন অবস্থায় জেফ বেজোস অ্যামাজনকে একজন IPO-র মাধ্যমে সবার সামনে আনার পরিকল্পনা আনেন। এছাড়াও তিনি নতুন জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।
যে ১১টি লাইফ লেসন আপনার জানা প্রয়োজন | পড়তে ক্লিক করুন
এর মধ্যে ছিলেন কিছু ডেসকো কর্মকর্তা, বার্নেস অ্যান্ড নোবেল থেকে কার্যনির্বাহী, সফটওয়্যার কোম্পানি সিমেনটেক থেকে কর্মকর্তা, মাইক্রোসফট থেকে দুইজন – প্রকৌশল বিভাগের সহ-সভাপতি জোয়েল স্পিজেল এবং ডেভিড রিশার।
এদের মধ্যে ডেভিড রিশার পরবর্তীতে বিক্রয় বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন।
এমন একটি অসাধারণ টিম নিয়ে জেফ তার কোম্পানিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। তার এই টিমকে জে-টিম নামেও অভিহিত করা হয়। এই টিমের অসাধারণ কর্মদক্ষতায় অ্যামাজন সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

অ্যামাজনের এই সফলতার কারণে বার্নেস অ্যান্ড নোবেলের মালিক লিওনার্দো রিগিও এবং স্টিভ রিগিও জেফের সাথে ব্যবসা একীভূত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু জেফ এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। এসময় বার্নেস অ্যান্ড নোবেলের মালিকদ্বয় আগ্রাসী হয়ে যান।
তারা জেফকে বলেন তারাও একটি অনলাইন বুকস্টোর তৈরী করতে চাচ্ছেন। তারা আরো বলেন অ্যামাজন তখন পিছিয়ে পড়তে পারে। কেননা ১৯৯৬ সালের অ্যামাজনের বিক্রির পরিমাণ ছিলো ১৬ মিলিয়ন ডলার আর বার্নেস অ্যান্ড নোবেলের বিক্রির পরিমাণ ছিলো ২ বিলিয়ন ডলার।
এমন হুমকির মুখেও জেফ তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন নি। বরঞ্চ যখন রিগিও ব্রাদার্স তাদের ওয়েবসাইটের পরিকল্পনা করছিলো তখন জেফ ও অ্যামাজনের সিএফও জয় কভে আমেরিকা ও ইউরোপে ভ্রমণ করে নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজছিলেন।
এসময় অনেক বিনিয়োগকারী তাকে বইয়ের বাইরে অন্যান্য প্রোডাক্ট বিক্রির পরামর্শ দেন।

তৎকালীন সময়ে অ্যামাজনের প্রোডাক্ট লাইন ছিলো “Earth’s Largest Bookstore”. অ্যামাজনের এই পরিচয় বিভ্রান্তিমূলক দাবি করে বার্নেস অ্যান্ড নোবেল ১২ই মে, ১৯৯৭ সালে ফেডেরাল কোর্টে মামলা করেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মামলার সকল রায় অ্যামাজনের বিপক্ষে যাচ্ছিল। তখন জেফ প্রোডাক্ট লাইনকে পরিবর্তন করে “Books, Music and More” দেন। অন্যদিকে, প্রোডাক্ট লাইন পরিবর্তন করার ফলে অ্যামাজন বইয়ের পাশাপাশি মিউজিক বাজারেও প্রবেশ করে ফেলে।
অ্যামাজনের সংগ্রাম
১৯৯৭ সাল ছিলো অ্যামাজনের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিলো। এবছর আমাজনের প্রায় তিন মিলিয়ন শেয়ার বাজারে আটকা পড়ে। ক্ষতি লাঘব করতে এ বছর দুইমাসের জন্যে অ্যামাজন পাবলিক ফান্ড করার জন্যে কাজ করে। জেফ বেজোস এবারো সফলভাবে ফান্ডিং করেন।
এরপর ১৯৯৮ সালের বড়দিনে জেফ অ্যামাজনে সাময়িকভাবে গিফট ও খেলনা কেনার সুবিধা যোগ করেন। এছাড়া এ বছরই তিনি অনলাইন রিটেইলারদের কমিশনের ব্যবস্থা করেন। এ বছর অ্যামাজন প্ল্যানেটঅল, বুকপেজেস সহ তিনটি কোম্পানি অধিগ্র হণ করে।
এটি অ্যামাজনের প্রথম অধিগ্রহণ ছিলো। তারপর ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৯ বছরে অ্যামাজনের অধিগ্রহণ করা কোম্পানির সংখ্যা ৪৪টি।
এবছরই জেফ গুগলে ২৫০,০০০ ডলার বিনিয়োগ করেন যার বর্তমান মূল্য ৩.১ মিলিয়ন ডলার। বার্নেস অ্যান্ড নোবেলের পর, অ্যামাজনের নতুন প্রতিযোগী ইবে এবছর অনলাইনে আসে।
পরবর্তী বছর অর্থ্যাৎ ১৯৯৯ সালে অ্যামাজন ১৫০ বিলিয়ন মূল্যের ওষুধ বাজারে প্রবেশ করে। এসময় অ্যামাজন ড্রাগস্টোর ডট কমের একটি শেয়ার কেনে।

সেসময় অনলাইন অকশন ভালো জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল। ইবে ও ইউবিডের মত অ্যামাজন সোদাবিজ হোল্ডিংয়ের সাথে যুক্ত হয়ে সোদাবিজ ডট অ্যামাজন ডট কম নামের একটি নিলামের সাইট চালু করে। এর ঠিক একমাস পরে, খেলনা ও ইলেক্ট্রনিক্স পন্যকে অ্যামাজনে আনা হয়।
এবছর অ্যামাজন ১.২৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। টাইমস ম্যাগাজিন তখন জেফ বেযোসকে পারসন অফ দ্যা ইয়ার হিসেবে অভিহিত করে।
একই বছর ক্লেইনের পারকিন্স কওফিল্ড অ্যান্ড বায়ার্স অ্যামাজনে ৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ৫৫০০০ শতাংশ বেড়ে ফেরত আসে। একই সময়ে জেফ বেজোস অ্যামাজনে ওয়ান ক্লিক অর্ডার প্রসেস যুক্ত করেন।
এর ফলে ক্রেতারা তাদের ক্রেডিট কার্ড, ঠিকানা দিয়ে সহজে কেনাকাটা করতে পারবেন।
পারসন অফ দ্যা ইয়ার
২০০২ সালে ল্যান্ডস এন্ড, নর্ডট্রম এবং দ্যা গাপের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অ্যামাজন পোষাক বাজারে প্রবেশ করে। এ বছর থেকে অ্যামাজনের প্রোডাক্ট সংখ্যা বাড়তে থাকে।
২০০৩ সাল শেষ হতে হতে প্রায় ৩০০ হাজার ব্র্যান্ড অ্যামাজনে যুক্ত হয়। সে বছর অ্যামাজন A9 চালু করেন। A9 মূলত একটি ই-কমার্স ভিত্তিক একটি বানিজ্যিক সার্চ ইঞ্জিন। পরের কয়েক বছরে অ্যামাজনের ব্যবসা ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানী, কানাডা, জাপানসহ উন্নয়নশীল দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
জেফ বেজোস অ্যামাজনকে কেবল ই-কমার্সের ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। তিনি অ্যামাজনকে অন্যান্য ব্যবসার সাথে যুক্ত করেছেন। এমন একটি প্রচেষ্টার ফসল ছিলো – অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস।
অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসের মধ্যে ছিলো স্টোরেজ, ডাটাবেজ, অ্যানালাইটিকস, অ্যালেক্সা, টুইচ, যাপোস সহ আরো অনেক সার্ভিস। ২০১২ সালে অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস থেকে “অ্যামাজন স্টুডিওস” যাত্রা শুরু করে। ফিচার ফিল্ম ও টিভি শো তৈরী করা – এই স্টুডিওর মূল লক্ষ্য।

বই পড়ুয়া মানুষদের জন্যে ২০০৭ সালে অ্যামাজন কিন্ডলে বাজারে নিয়ে আসে। জেফ বেজোস অ্যামাজনের শুরু থেকেই বই পড়া কিংবা বই বাজারে আনার ব্যাপারে যে আধুনিকায়ন করতে চেয়েছিলেন এটি তার একটি ফসল।
অ্যামাজন কিন্ডলে বাজারে আসার কিছুদিনের মধ্যেই ভালো সাড়া ফেলে। বই পাগল মানুষেরা নতুন এই সংযোজন লুফে নেয়। যার ধারাবাহিকতা এই রিডিং ডিভাইসটি ২০১০ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ৯৫ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছিলো।
অ্যাপল এবং অ্যামাজন
২০১০ এ অ্যাপল আইপ্যাড বাজারে আনলে কিন্ডলের ব্যবসায় কিছুটা ধস নামে। তখন জেফ বেজোস এর মূল্য হ্রাস করেন এবং বাড়তি সুবিধা যুক্ত করেন। ২০১০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অ্যামাজন প্রিন্টেড বইয়ের চেয়ে ই-বুক বেশি বিক্রি করে।
এরপর ২০১১ সালে অ্যামাজন “কিন্ডেল ফায়ার” বাজারজাত করে সরাসরি অ্যাপেলের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে। এরপর থেকে অ্যামাজনের আর পিছে ফিরে তাকাতে হয় নি।
২০১১-২০১৫ সালের মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে এই প্রতিষ্ঠানটির আর প্রায় দেড় গুণ বেড়ে যায়। ২০১৩ সালে জেফ অ্যামাজন প্রাইম নামে একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই সেবার আওতায় ড্রোনের মাধ্যমে পাঁচ পাউন্ডের কোন পন্যকে সর্বোচ্চ দশ মাইল দূরে ক্রেতার কাছে পাঠানো সম্ভব।
মুসলিম স্বর্ণেরযুগের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ইবনে সিনার জীবনী
২০১৫ সালে সিয়েটলে অ্যামাজন প্রথম বুক শপ চালু করে। এখন ২০১৮ সালে এসে বিশ্বব্যাপী অনলাইন শপিংয়ের কথা উঠলে অ্যামাজনের নামটি প্রথমে চলে আসে।
জেফ বেজোসের সিয়েটলের গ্যারেজ থেকে শুরু এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্মী সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি। এই ই-কর্মাস জায়েন্ট বর্তমানে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পন্য বিক্রি করে বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করছে।
জেফ বেজোস অ্যামাজনের বাইরেও অ্যারোস্পেস ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করা ব্লু অরিজিন তারই একটি উদাহরণ। বর্তমানে সিয়েটেলের বাইরে প্রায় ২৬ একর জায়গা নিয়ে এটির একাডেমী স্থাপন করা হয়েছে।
পশ্চিম টেক্সাসে রকেট উড্ডয়নের জন্যে ব্যক্তিগত জায়গা রয়েছে। ২০১৫ সালে কক্ষপথে রকেটের সফল উড্ডয়ন সম্পন্ন করে এটি আলোচনায় আসে। এটি এখন পর্যন্ত ১৪টি সফল পরীক্ষামূলক যাত্রা সফলভাবে পরিচালনা করতে পেরেছে।

বিখ্যাত পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট কেনা
জেফ বেজোস তুমুলভাবে আলোচনায় আসেন – ২০১৩ সালের ৫ই আগস্ট বিখ্যাত আমেরিকান দৈনিক “ওয়াশিংটন পোস্ট” ২৫০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেওয়ার মাধ্যমে।
কিনে নেওয়ার ৫ দিন পরেই, ওয়াশিংটন পোস্ট জেফ বেজোসের উপর একটি সুদীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। একই বছরের অক্টোবর মাসে এটির বিক্রি বন্ধ করা হয় এবং বেজোসের নাশ হোল্ডিং এর নিয়ন্ত্রন নেয়।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ওয়াশিংটন পোস্টে আমূল পরিবর্তন আনা হয়। অন্যান্য বিখ্যাত পত্রিকার মত ওয়াশিংটন পোস্টেও পে-ওয়াল সাবস্ক্রাইব ভিত্তিক সেবা চালু করা হয়।
অ্যামাজন, ব্লু অরিজন কিংবা ওয়াশিংটন পোস্টের মত কিছু জায়েন্ট প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে জেফ বেজোসের সঠিক নেতৃত্ব। তিনি কর্মীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় নিজে ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত থাকেন।
এছাড়াও তিনি দীর্ঘক্ষণ কর্মীদের সাথে কথা বলেন। বিভিন্ন প্রশ্ন উপাত্ত লিখে রাখেন। নিয়োগের ব্যাপারে তিনি সবসময় খেয়াল রাখেন যেন তার নতুন কর্মীরা আগের কর্মীদের থেকে বেশি দক্ষ হয়। এছাড়াও তিনি কর্মীদের আত্মবিশ্বাস যোগাতে অনেক ভালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
তিনি অ্যামাজনের জে-টিমের প্রতিটি মেম্বারকে শুরু দিকে বলেছিলেন, “যদি আমরা আমাদের পরিকল্পনার মোতাবেক কাজ করতে পারি তাহলে ২০০০ সালের মধ্যে আমরা আমাদের কোম্পানিকে বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে রূপান্তর করতে পারবো”।

তিনি কর্মক্ষেত্রে সবসময় কর্মীদেরকে অর্গানাইজ করতে চেষ্টা করেন। তার ব্যাপারে অন্যতম মজার ব্যাপার হলো – তিনি কর্মীদের কাছ থেকে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন নেন না। তার কাছে যে কোন আইডিয়া মেমে আকারে প্রকাশ করতে হয়।
জেফ বেজোস স্পেস ভ্রমণে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী। তিনি স্পেস স্টেশনে মানুষের জন্য কলোনি তৈরির কথাও বলেন। তবে তিনি হেলিকপ্টারে খুব বেশি যাতায়াত করেন না। এর প্রধান কারন হলো – ২০০৩ সালে একটি মারাত্নক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মাথায় গুরুতর আঘাত পান।
জেফ বেজস এবং তাঁর টিম ওয়ার্ক
কোন কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে তিনি টিম ওয়ার্কে বেশি বিশ্বাসী। তবে ছোট টিমে ভাগ করে কাজ করাতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
তার এই ভাবনা থেকেই তিনি “টু পিৎজা রুল” উদ্ভাবন করেন। এই রুলের আওতায় দুইটি পিৎজাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে মিটিংয়ে উপস্থিত সবাইকে খাওয়ানো হয়।
এখানে মূল বিষয় হলো – ঐ মিটিংয়ে দুটো পিৎজা শেষ করার মত সংখ্যক লোক উপস্থিত হবেন। এতে করে মতোবিরোধ হবার সম্ভাবনা কমে যায়। কোন সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়।
জেফ বেজোস কেবল নিজেকে উদ্যোক্তার মাঝে বেঁধে রাখেননি। তিনি ২০০৪ সালে জ্যাক স্কট পরিচালিত “টুথ ফেয়ারী” চলচ্চিত্রে সিকিউরিটি গার্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
পরবর্তীতে ২০১০ সালে “দি ভার্চুয়াল রিভোলেশন” নামে একটি টিভি সিরিজে অভিনয় করেন। সবশেষ ২০১৬ সালে জাস্টিন লিন পরিচালিত “স্টার ট্রেকঃ বেয়ন্ড” চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। উল্লেখ্য যে, জাস্টিন লিল পরিচালিত “স্টার স্ট্রেক” তার অন্যতম পছন্দের চলচ্চিত্র।
শুধু কাজের সফলতা নয়, কাজের স্বীকৃতিসরূপ অনেক সম্মাননাও পেয়েছেন জেফ বেজোস। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা দেয়।

এসময় তার সম্পদের পরিমাণ ছিলো – ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে পরেরদিনই শেয়ার বাজারে অ্যামাজনের দাম পড়ে যাওয়ায় তিনি আবার বিল গেটসের পরের অবস্থানে চলে যান। বেজোস ২০০৮ সালে কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
এছাড়াও ইউ এস নিউজ অ্যান্ড রিপোর্ট তাকে আমেরিকার “বেস্ট লিডার” হিসেবে অ্যাখ্যা দেয়। ২০১১ সালে “দ্যা ইকোনোমিস্ট” তাকে অ্যামাজন কিন্ডলের জন্যে ইনোভেশন এ্যাওয়ার্ড দেয়। একই বছর ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে বিজনেস পার্সন ওফ দ্যা ইয়ার ঘোষণা করে।
সে বছর তিনি সুইজারল্যান্ডের বিল্ডারবার্গ সম্মেলনে অংশ নেন। ২০১৩ ইংল্যান্ডের ওয়াটফোর্ডে অনুষ্ঠিত বিল্ডারবার্গ সম্মেলনেও তিনি অংশ নেন। তিনি ২০১১ ও ২০১২ সালে বিজনেস কাউন্সিলে কার্যনির্বাহী কমিটিতে সদস্য ছিলেন।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় রিটেইল ফেডারেশন অ্যামাজনকে ঐ বছরের টপ রিটেইলার হিসেবে ঘোষণা করে এবং তাকে গোল্ড মেডেলে ভুষিত করে। ইন্টারনেট ইকোনমিতে অবদানের সম্মাননাসরূপ ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিলে এক্সেল স্পিংগার গ্রুপ তাকে “এক্সেল স্প্রিংগার এ্যাওয়ার্ড ২০১৮” তে ভূষিত করবে।
জেফ বেজোস শূন্য থেকে শিখরে উঠার একটি উদাহরণ। ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে তার বর্তমান সম্পদের মূল্য এখন ১০৫.১ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ২৪ বছরের তার পথচলা, উত্থান-পতন, সাফল্য সে কোন উদ্যোক্তার জন্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
এই সফল মানুষটির সামনের দিনগুলির জন্যে অভিযাত্রীর পক্ষ থেকে শুভকামনা।
ধন্যবাদ এতক্ষণ আমাদের সাথে থাকার জন্য ।
জেফ বেজসের এই সংগ্রাম এবং অনুপ্রেরণার গল্পটি ভিডিও আকারে দেখুন নিচে
Leave a Reply