সার্চ জায়েন্ট গুগল ২০১৫ সালের ১০ই আগস্ট একটি চমকপ্রদ খবর নিয়ে হাজির হয়। এইদিন ল্যারি পেজ ভারতীয় বংশদ্ভূত একজনকে গুগলের নতুন সিইও হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সেই নামটি হলো সুন্দর পিচাই। বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে কোন ভারতীয়র দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়টি পুরো ভারত জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সুন্দর পিচাইয়ের সংগ্রামের গল্প
পিচাইয়ের আসল নাম “পিচাই সুন্দারারাজান”। তিনি ১৯৭২ সালের ১২ই জুলাই ভারতের তামিলনাডু প্রদেশের মধুরাই অঞ্চলের একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড়। বাবা রেগুনাথ পিচাই আমেরিকা ভিত্তিক ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি জিইসিতে সহকারী ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন।
মা লক্ষ্ণী পিচাই সুন্দরের জন্মের আগ পর্যন্ত শ্রুতিলেখক হিসেবে কাজ করতেন। সুন্দরের শৈশব খুব একটা উচ্চবিত্তের মধ্যে কাটেনি। চেন্নাই শহরের একটি ছোট দুই রুমের ফ্লাটে তার শৈশব কেটেছে।
শৈশবে পিচাই সুন্দারারাজান
শৈশবে তিনি ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও দাবা ও ক্রিকেট খেলায় তার ঝোঁক ছিলো। তিনি “জহর বিদ্যালয়” ও “ভানাভানি ম্যাট্রিকুলেশন হাইয়ার সেকেন্ডারী বিদ্যালয়” থেকে স্কুলের পাঠ শেষ করেন।
ছোটবেলা থেকে সংখ্যা মুখস্ত করতে ও মনে রাখতে তিনি পটু ছিলেন। ১২ বছর বয়সে তার বাবা বাসায় প্রথম ল্যান্ডফোন নিয়ে আসেন। তিনি তখন ডায়াল করা সব নাম্বার মুখস্ত বলে দিতে পারতেন।
তিনি মাদ্রাজের আইআইটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। কিন্তু আইআইটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির জন্যে তার যথেষ্ট র্যাংক ছিল না।
ভারত থেকে আমেরিকায় যাত্রা
পরবর্তীতে তিনি খড়গপুর আইআইটি থেকে ধাতব প্রকৌশল বিদ্যায় ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। অতঃপর আইআইটির অধ্যাপকের সুপারিশে তিনি ১৯৯৩ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জনের উদ্দেশ্যে আমেরিকায় পাড়ি জমান।
কিন্তু পিএইচডির পরিবর্তে তিনি স্ট্যানফোর্ড থেকে ফলিত পদার্থে এমএস সম্পন্ন করেন। এমএস সম্পন্ন করে তিনি “সিলিকন ভ্যালি”তে ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন।
তবে সেখানে বেশিদিন চাকুরী করেন নি। চাকুরী ছেড়ে তিনি ওয়ার্টন স্কুল অফ ইউনিভার্সিটি অফ পেনিসেলভেনিয়া থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। ওয়ার্টন স্কুল তাঁকে সিবেল স্কলার এবং পামার স্কলারের স্বীকৃতি দেয়।
এমবিএ সম্পন্ন করার পর, সুন্দর “ম্যাকিন্স ও কোম্পানি”তে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসেবে যোগদান করেন। ঠিক এই সময়টিতে তিনি তার একাকী জীবনের সাথে এক রকম যুদ্ধ করেছিলেন। নিজের জীবনের এই খারাপ সময়কে মোকাবেলা করে সাফল্য পাওয়া তার জন্যে চ্যালেঞ্জ ছিলো।
এসময় তার বর্তমান স্ত্রী অঞ্জলি পিচাই তাঁকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন। তার সকল সফলতার পেছনে অঞ্জলি পিচাইয়ের অবদান রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, কেবল সুন্দরের জন্যেই অঞ্জলি এমএস করতে আমেরিকায় যান এবং পরবর্তীতে তারা পারিবারিক সম্মতিক্রমে বিবাহ সম্পন্ন করেন।
গুগলে পিচাইয়ের যাত্রা
২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল এই প্রযুক্তি ব্যক্তিত্ব গুগলে যোগদান করেন। একই দিনে জিমেইলের পথচলা শুরু হয়। গুগলে যোগদানের পর ২০০৬ সালে সুন্দরের সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে। মূলত তখন বেশিরভাগ মানুষ “ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার”কে ওয়েব ব্রাউজার হিসেবে ব্যবহার করত।
অন্যদিকে, ২০০৬ সাল থেকে মাইক্রোসফট তাদের নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন “বিং” কে “ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের” ডিফল্ট সার্চে যুক্ত করে। এসময় গুগল তাদের ইউজার হারাতে বসে। ঠিক সেই বছর তিনি “গুগল টুলবার” নিয়ে আসেন।
এটি গুগলকে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে সাহায্য করে। কেননা একজন ইউজার খুব সহজে গুগল টুলবার ইন্সটল করার মাধ্যমে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগলকে ব্যবহার করতে পারবেন। এরপর তিনি গুগল গিয়ার এবং গুগল প্যাক লঞ্চ করেন।
গুগল টুলবারের সফলতা পিচাইকে নিজস্ব ব্রাউজার তৈরীর পরিকল্পনা দেয়। তিনি গুগলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে এই পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তখন গুগলের তৎকালীন সিইও “এরিক স্মিড” ব্রাউজার তৈরীকে ব্যয়সাপেক্ষ উল্লেখ করে এটির ঘোর বিরোধিতা করেন।
কিন্তু পরবর্তীতে গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা লরি পেজ ব্রাউজার তৈরীর পক্ষে মত দেন। “গুগল ক্রোম” এর আত্মপ্রকাশে সুন্দর পেচাই অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
২০০৮ সালে ক্রোমে সরাসরি গুগল সার্চের সুবিধা যুক্ত হয়। এর ফলে খুব কম সময়ের মধ্যে এটি জনপ্রিয়তা পায় এবং প্রতিযোগী ব্রাউজারগুলোকে পেছনে ফেলে দেয়। এই সাফল্যের সুবাদে সুন্দর গুগলে নিজের অবস্থান মজবুত করেন।
ক্রোমের সাফল্য ক্রোমবুক, ক্রোম ওএস এবং ক্রোম কাস্টের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রোডাক্তের জন্ম দেয়। সে বছরই তিনি গুগলের প্রোডাক্ট ডেভেলমেন্টের সহ-সভাপতি পদে নিযুক্ত হন। এর ফলে তিনি গুগলের প্রোডাক্ট প্রেজেন্টেশনে আরো সক্রিয় হয়ে উঠেন এবং নিজের অবস্থানকে আরো সামনে এগিয়ে নিতে থাকেন।
গুগলের উচ্চ পদে পিচাই সুন্দারারাজান
২০১২ সালে গুগল অ্যাপসের প্রধান ডেভ গিরোয়ার্ড গুগল ছেড়ে দিলে তিনি ক্রোম ও অ্যাপসের সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। সহ-সভাপতি নিযুক্ত হয়েই তিনি ক্রোম ও অ্যাপসের অগ্রগতিতে কাজ শুরু করে দেন। গুগল ড্রাইভের পেছনে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন।
এছাড়া গুগল ভিডিও কোডে তার অবদান রয়েছে। ২০১৩ সালে অ্যান্ড্রয়েডের প্রধান নির্বাহী অ্যান্ড্রু রুবিন গুগল ছেড়ে দিলে তিনি রুবিনের স্থলাভিষিক্ত হন। ২০১৪ সালে তিনি “অ্যান্ড্রয়েড ওয়ান” নামের একটি প্রজেক্ট হাতে নেন। এই প্রজেক্টের লক্ষ্য ছিলো – “ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রেখে ঘরে ঘরে অ্যান্ড্রয়েড ফোন পৌঁছে দেওয়া”।
তিনি অ্যান্ড্রয়েডের জেলি বিন, কিটক্যাট, ললিপপ ভার্সন তৈরীর কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। তার দক্ষ নেতৃত্বের ফলে আমেরিকার মোবাইল বাজারের শতকরা ৬৫ শতাংশ অ্যান্ড্রয়েড দখল করে নেয়। একই বছরে তিনি গুগল প্রোডাক্ট ডেভেলমেন্টের সহ-সভাপতি থেকে নির্বাহী প্রধান হন।
সফল সুন্দর পিচাই
সুন্দর “নেস্ট”এর প্রতিষ্ঠাতা টনি ফ্যাডেলকে “নেস্ট”কে গুগলের সাথে যুক্ত করতে রাজি করান। ২০১৩ সালে তিনি লরি পেজ এবং গুগলের সিবিও নিকেশ অ্যারোরার সাথে দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত স্যামসাংয়ের ফ্যাক্টরী পরিদর্শন করেন এবং গুগল প্রোডাক্টের সাথে পার্টনারশিপের জন্যে প্রস্তাব দেন।
কর্মদক্ষতার বলে ধীরে ধীরে তিনি ল্যারি পেজের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেন। গুগলের প্রধান মুখপাত্র হিসেবেও সবার কাছে পরিচিতি পেতে থাকেন। তখন থেকে গুগলের প্রতিটি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে থাকেন।
তিনি গুগলে কাজের পাশাপাশি অন্যান্য প্রযুক্তির দিকেও মনোনিবেশ করতে শুরু করেন। ২০১৪-র শেষের দিকে তিনি টুইটারের সিইও হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব পান। টুইটার ছাড়াও তিনি মাইক্রোসফটের সিইও হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব পান।
কিন্তু গুগলের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তিনি সেসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। অন্যদিকে, গুগল সুন্দরকে ধরে রাখার লক্ষ্যে প্রতিবছর প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার বেতন প্রদান করছে।
একই সময়ে ল্যারি পেজ গুগলের মাতৃ-প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। প্রতিষ্ঠাতা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যালফাবেট নিয়ে ব্যস্ত হবার সুবাদে, তারা সুন্দরকে গুগলের নতুন সিইও হিসেবে ঘোষণা করেন।
প্রযুক্তিবিদরা তাঁর দুরদর্শীতা, বাজারের চাহিদা পূরণের ক্ষমতা, নতুন নতুন ব্যবসা পরিকল্পনার ক্ষমতা, মানুষের কাছে প্রোডাক্টের গ্রহণযোগ্যতা তৈরীর গুণের জন্যে ল্যারি পেজের থেকেও তাঁকে সিইও হিসেবে এগিয়ে রাখছেন।
চমক নিয়ে বিশ্বের সামনে হাজির সুন্দর
বর্তমানে তিনি গুগলের আরো কিছু প্রোডাক্ট লঞ্চ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি গুগলকে “AI First” কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করানোর কথা প্রকাশ করেন।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে Artificial Intelligence কে অধিক গুরুত্বের সাথে দেখছে বলেও জানান। একই সাথে তার নেতৃত্বে গুগল সফটওয়্যার বাজারের পাশাপাশি হার্ডওয়ার বাজারে আরো সক্রিয় হতে যাচ্ছে। সিইও নিযুক্ত হবার পর, পিক্সেল ও পিক্সেল এক্সএল লঞ্চ ছিলো তার প্রধান কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।
অন্যদিকে, প্রজেক্ট লুন, ফাইবার, প্রজেক্ট ফাই সহ অন্যান্য গুগল প্রজেক্টকে এগিয়ে নিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
২০১৭ সালের ২৪শে জুলাই পিচাই গুগলের মাতৃ-প্রতিষ্ঠান “অ্যালফাবেট”এ ১৩তম বোর্ড মেম্বার হিসেবে যোগদান করেছেন। অ্যালফাবেটের সিইও লরি পেজ সুন্দরের কাজের প্রশংসা জানিয়ে অ্যালফাবেটে যোগদান সম্পর্কে বলেন, “সুন্দর গুগলের সিইও হিসেবে খুব ভালো করছেন।
তিনি কোম্পানির উন্নয়ন, অংশীদারিত্ব তৈরী, বিস্ময়কর সব প্রোডাক্ট উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তার সাথে কাজ করতে পেরে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি এবং অ্যালফেবেট বোর্ডে তার যোগদান নিয়ে আমি আশাবাদী”। তিনি হলেন সফলতার উন্মোচক, একজন সফল সুন্দর পিচাই।
একটি সাধারণ ঘরে জন্মে নিয়ে সুন্দর পিচাই প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছে থাকলে যেকোন অবস্থানে থেকেও সফলতা অর্জন করা যায়। তিনি নিজ কাজের ব্যবসায়িক মূল্যকে ১৯৯ মিলিয়ন আমেরিকান ডলারে নিয়ে গেছেন। পাশাপাশি স্বীয় কর্মদক্ষতা দিয়ে গুগলের বাজারমূল্য ১০১.৮ বিলিয়ন আমেরিকানে ডলারে নিয়ে গেছেন এবং যা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় সম্পদশালী প্রতিষ্ঠান।
নতুন ভাবনার উদ্ভাবন করে শুধু গুগল নয়, এই কিংবদন্তী পুরো প্রযুক্তি দুনিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
Leave a Reply