নড়াইলের চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটা দুরন্ত এক কিশোর ‘কৌশিক’ যে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তি মাশরাফি বিন মর্তুজা হয়ে উঠবেন, কে ভেবেছিল? শুধু কি অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তি? না, আমার কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার তিনি।
চলুন, একটু অতীতে যাই। ২০১৪ সাল। ভারত আসলো তাঁদের “বি” দল নিয়ে বাংলাদেশে। মুশফিক তখন বাংলাদেশের অধিনায়ক। রক্ষণাত্মক ক্যাপ্টেনসির কারণে সমালোচিত হচ্ছিলেন সব জায়গায়। ভারতের সঙ্গে প্রথম ম্যাচটায় অসাধারণ অভিষেক করলেন তাসকিন আহমেদ। নিলেন ৫ উইকেট। ১০৫ রানের মধ্যেই অল-আউট ভারত।
কিন্তু চেজে নেমে আমরা গুটিয়ে গেলাম ১০০ রানের আগেই। স্কোর বলে আর লজ্জা পেতে চাই না। তখন সব পত্রিকায়, গণমাধ্যমে হায় হায় রব। বাংলাদেশ ক্রিকেট গেল তাহলে!
২০১৫ সালে বিশ্বকাপের আগে আগেই অধিনায়কত্ব হারালেন মুশফিক। চোট থেকে তখন ফিরে এসেছেন মাশরাফি। তাঁকে দিয়ে দেওয়া হলো অধিনায়কত্ব। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের মোড় ঘুরানো পারফরম্যান্স দেখালো বাংলাদেশ।
দেখালো আমরাও জিততে নামি, ভালো খেলতে না। বিশ্বকাপের পরপরই বাংলাদেশ সফরে আসল ভারত। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম চার পেসার নিয়ে নামল বাংলাদেশ। সিরিজের ফল আপনাদের জানা। নেপথ্যে কে ছিলেন? মাশরাফি!
একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশে মাশরাফির সতীর্থ মঞ্জুরুল ইসলাম রানা বাইক দুর্ঘটনায় মারা যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ বসে সে খবর পান মাশরাফি। বন্ধুর অকাল প্রস্থানে ভয়াবহ কষ্ট পান মাশরাফি।
কিন্তু সেই শোককে শক্তি বানান তিনি। ভারত ম্যাচের আগে এক সাংবাদিককে বলেন, ভারতকে “ধরে দিবানে”। অথচ ম্যাচের আগের দিনও ১০২ জ্বরে ভুগছিলেন মাশরাফি। হাবিবুল বাশার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “পারবি তো খেলতে?” পরের দিন কলার উচু করে সেই চেনা পরিচিত রান-আপে শেবাগকে বোল্ড করেন।
গুণে গুণে ঠিক চার উইকেট নিয়েছিলেন মাশরাফি। সেই ম্যাচটা পাঁচ উইকেটে জিতেছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু ম্যাচ জয়ের আভাস যে আগের দিনই দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
মাশরাফি অভিষেকটা একটু অন্য রকম ছিল। অনূর্ধ্ব-১৯ এ থাকাকালীন নজর কেড়েছিলেন এন্ডি রবার্টসের। তাঁর পরামর্শেই বাংলাদেশ-এ দলে সুযোগ পান তিনি। ‘এ’ দলে একটা ম্যাচ খেলে সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় দলে।
প্রথম টেস্টটি স্মরণীয় রাখেন ১০৬ রানে চার উইকেট নিয়ে। গ্রান্ট ফ্লাওয়ার ছিলেন তাঁর প্রথম শিকার। কিন্তু নিজের তিন নম্বর টেস্টেই প্রথম ইনজুরিতে পড়েন মাশরাফি। ২০০৬ সাল ছিল তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সফল বছর। এ বছর ৪৯টি উইকেট নিয়েছিলেন ওডিয়াইতে।
ক্রিকেট বিশ্বে অন্যতম পরাশক্তি হয়ে উঠছে বাংলাদেশ | পড়তে ক্লিক করুন
২০০৬ সালের মধ্যে অবশ্য পায়ে সার্জারি হয়ে গিয়েছিল দুইবার। ক্যারিয়ারে ১৭ বছর চলছে তাঁর এখন আর ইঞ্জুরির শিকার হয়েছেন ১২ বার। তাই, যখনই বলের উপর লাফ দেন এখনো, বুকটা কেপে উঠে। উঠতে পারবেন তো আবার?
কিন্তু বাঘের মত প্রতিবার উঠে দাড়ান তিনি। আমাদের বুকে আবার সাহস ফিরে আসে।
জানতে চান, ২০১৪-র সেই দল থেকে ২০১৫ পরবর্তী দলের এত পরিবর্তন কিভাবে? একজন কলার উচু করা লোক, যে কখনো হারতে শিখে নাই। যিনি ভারতের সামনে ২২৩ এর টার্গেটকে ২৫০ এর সমান টার্গেট বানিয়ে দেন। ঘাম ঝরিয়ে ফেলেন যেকোনো প্রতিপক্ষের।
পায়ে সাত-সাতটা ইনজুরি নিয়ে ৪ মিটারের বেশি দূরত্বের ক্যাচ ধরেন। সেই ক্যাচ ধরে ঘুরিয়ে দেন ম্যাচের মোড়। তরুণ খেলোয়াড় ফিফটি করার পর ব্যাট উঠালে মনে করিয়ে দেন, কাজ এখনো শেষ হয় নাই। চালিয়ে যাও। দেশের জন্য খেলো।
যখনই দেখেন প্রতিপক্ষ পার্টনারশিপ করে ফেলছে, তখনই বল হাতে নিয়ে ভাঙ্গেন পার্টনারশিপ কিংবা মাঝে-মধ্যে এমন সব পরিবর্তন আনেন বোলিংয়ে যে ম্যাচই ঘুরে যায়। যখন নতুন বল হাতে প্রথম ব্রেক-থ্রু দেন, তখন বাংলাদেশি মানুষ বুঝে যায়, এ ম্যাচ আমাদের।
ভাঙ্গা দুই আঙুল নিয়ে খেলেছেন শেষ ম্যাচ। পায়েও নাকি ইনজুরি ছিল। এ লোকটা কি আসলেই মানুষ?
ফিক্সিং কেলোঙ্কারির পর ভারতের দায়িত্ব নেন এক বাঙালি ছেলে। নাম সৌরভ গাঙ্গুলী। দলের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন সেই বাঙালি ছেলে। জেতা শিখিয়েছিলেন ভারতকে। কলার উচু করতে শিখিয়েছিলেন। ফল? পরবর্তী প্রজন্মের হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি।
সৌরভের কথা কেন আনলাম, জানেন? কারণ, বাংলাদেশের যেকোনো দলের সাথে চোখে চোখ রেখে খেলার সাহস কে দিয়েছেন, জানেন? মাশরাফি বিন মর্তুজা। জেতা শেখাচ্ছেন তিনি আমাদের। মাথাটা উচু করে চলতে শিখাচ্ছেন। দলে হার না মানা এক মনোভাব এনেছেন। এরা আর মাঠে নামার আগে হারে না, যেই প্রতিপক্ষই হোক।
যে লোক বলেছেন, “ দুই পা বেইমানি করলেও ঘাড়ের রগটা বাঁকা করে ঠিকই মাঠে নামবেন দেশের জন্য ”, তাঁর থেকে তরুণ ক্রিকেটাররা কিরকম অনুপ্রাণিত হবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মাশরাফি একটা ট্রফির প্রাপ্য অবশ্যই। কিন্তু তিনি কোনো ট্রফিও না পান, তাও তাঁকে আমরা বিচার করবো না। মাশরাফি এতো সস্তা না যে ট্রফি দিয়ে বিচার করতে হবে। হয়তো পরবর্তীতে আমরা অনেক ট্রফি পাবো, কিন্তু মাশরাফি যে আর দ্বিতীয়টা পাবো না।
এই লোক কতটা ক্যারিশমাটিক, তাই না? না হলে কিভাবে রমিজ রাজার মতো লোক তাঁকে এশিয়ার সেরা ক্যাপ্টেন মানেন কিংবা আকাশ চোপড়া হয়ে যান বাংলাদেশের ফ্যান শুধুমাত্র তাঁর জন্যই।
শুভ জন্মদিন, গুরু। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আপনার সুস্থ থাকায় যে ভালো থাকে ১৬ কোটি বাঙালি।