মারিয়ানা ট্রেঞ্চ | রহস্যে ঘেরা এক খাতের আদ্যোপান্ত

Author:

Published:

Updated:

রহস্যে ঘেরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ

পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ও রহস্যময় স্থানগুলো নিয়ে অনেক আগে থেকেই রয়েছে মানুষের অপরিসীম উৎসাহ আর কৌতূহল। আর এই কৌতূহল দমনের জন্য মানুষ কখনো ছুটে গিয়েছে পাহাড়ে, কখনো অভয়ারণ্যে, আবার কখনো নেমেছে সমুদ্র অভিযানে। রহস্যে ঘেরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর ব্যতিক্রম নয়।

বিস্ময়কর এই খাতটিকে বলা হয় পৃথিবীর গভীরতম স্থান। মারিয়ানা খাতের গভীরতম বিন্দুতে মানুষ এখন পর্যন্ত চারবার অবতরণ করেছে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র মারিয়ানাকে National Monument হিসেবে ঘোষণা করে।

মারিয়ানা খাতের মত এমন অসংখ্য খাদ ছড়িয়ে আছে সাগর মহাসাগরের তলদেশে। আসলে খাতগুলো সাগরের তলদেশ থেকে নেমে যাওয়া এক একটি ফাটল বা খাদ। এগুলো কিছুটা বিস্তৃত এবং সরু আকৃতির হয়ে থাকে। আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সাগরের তলদেশে এরকম ২৬টি খাতের সন্ধান পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরেই রয়েছে ১৮টি খাত। রহস্যময় মারিয়ানাও প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য খাতগুলোর একটি।

আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেও মারিয়ানা খাদ সম্পর্কে আজও পুরোটা জানা সম্ভব হয়নি। তাই এর রহস্য ভেদ করতে এখনো চলছে নিত্য নতুন অভিযান। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর ও দুর্গম এই খাতের কিছু জানা অজানা তথ্য নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

রহস্যে ঘেরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ
স্যাটেলাইট থেকে মারিয়ানা

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ কি?

প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মারিয়ানা দীপপুঞ্জের প্রায় ২০০ কিলোমিটার পূর্বে রয়েছে মারিয়ানা খাত। এই খাতের সৃষ্টি হয় অধোগমন নামক এক ভৌগোলিক প্রক্রিয়ায়। পৃথিবীর অভ্যন্তরে সচল টেকটোনিক প্লেট গুলোর সংঘর্ষের কারণে ট্রেঞ্চ বা খাতগুলো গঠিত হয়।

প্রশান্ত মহাসাগরের দৈত্যাকৃতির সচল প্লেটটি নবীন ফিলিপিন প্লেটের সাথে সংঘর্ষের ফলে ফিলিপিন প্লেটের নিচে চলে যায়। আর এভাবেই জন্ম হয় অতিকায় এবং গভীর মারিয়ানা খাত বা পরিখার।

১৮০ মিলিয়ন বছরের পুরানো এই সীবেডকে অনেকে বলেন মৃত্যুপুরী। গ্রীক উপকথা অনুসারে দেবতারাজ জিউস এবং সমুদ্রের দেবতা পোসাইডনের আরেক ভাই মৃত্যুদেবতা হেডিস থাকতেন সমুদ্রের সবচেয়ে দুর্গম ও গভীরতম স্থানে। তাই এর আরেক নাম হ্যাডাল জোন।

সতের শতাব্দীতে স্পেনের রাজা ছিলেন চতুর্থ ফিলিপ। ১৬৬৭ সালে স্পেনিয়ার্ডরা প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু দ্বীপ দখল করে সেখানে একটি কলোনী স্থাপন করেন। তারা রাজা চতুর্থ ফিলিপের স্ত্রী মারিয়ানার নামে কলোনীটির অফিসিয়াল নামকরণ করেন লা মারিয়ানাস। পৃথিবীর গভীরতম এই খাতটি মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের কাছে বলে এর নামকরণ করা হয় মারিয়ানা খাত বা পরিখা।

মারিয়ানা খাতের গভীরতা

মারিয়ানা সাগরের তলদেশে একটি বৃত্তচাপের আকারে উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে প্রায় ২৫৫০ কিমি বা ১৫৮০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত। তবে চওড়ায় এটি মাত্র ৬৯ কিমি বা ৪৩ মাইল। ধারণা করা হয় খাতটির সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ১১ কিমি বা ৩৬,০৭০ ফুট।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা মনে করেন এর গভীরতা আরো বেশি হতে পারে। গভীর সমুদ্রের নিচে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সমস্যা থাকায় এর সঠিক গভীরতা এখনো অজানাই রয়ে গেছে।

রহস্যে ঘেরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ
দেবতা জিউস এবং হেডিস । গ্রীক পুরাণ মতে মৃত্যুদেবতা হেডিস এই রহস্য ঘেরা মারিয়ানাই বসবাস করতো।

মারিয়ানার সবচেয়ে গভীর অংশটি প্রশান্ত মহাসাগরের চ্যালেঞ্জার ডিপ নামের ভ্যালিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। খাতটির দক্ষিণ প্রান্তসীমায় অবস্থিত গুয়াম দ্বীপ থেকে ৩৪০ কিমি দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে পৃথিবীর গভীরতম বিন্দুটি। এর গভীরতা প্রায় ১১,০৩৩ মিটার।

এই খাতের গভীরতা এত বেশি যে এই জায়গায় যদি মাউন্ট এভারেস্টকে তুলে এনে রাখা হয় তবুও এভারেস্টের চূড়া সমুদ্রের উপর থেকে দেখা যাবে না। বরং এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আরো ২ কিমি নিচে থাকবে।

সমুদ্রের এই গভীরতম অংশে পানির চাপ বেশি হওয়ায় মানুষের পক্ষে এখানে যাওয়া বেশ কঠিন। তবে কৌতূহলী মানুষ তাতেও থেমে নেই। ১৮৭২ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ১৮৭৬ সালের মে মাস পর্যন্ত বেশ কয়েকবার মারিয়ানা খাতে চ্যালেঞ্জার এক্সপিডিশন নামে পরীক্ষামূলক অভিযান চালানো হয়।

এই অভিযান শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলীয় শহর পোর্টস্মাউথ থেকে। অভিযানের প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন দুইজন। একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদ এবং আরেকজন সামুদ্রিক প্রাণিবিজ্ঞানী স্যার চার্লস ওয়াইভিল থমসন। এছাড়া ক্যাপ্টেন জর্জ নারেসের নেতৃত্বে অভিযানের সাথে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাও যুক্ত ছিলেন।

বিশাল আর দুর্গম এলাকা এবং সীমিত প্রযুক্তিক সুবিধার কারণে অভিযানটি সফল হতে কয়েক বছর সময় লাগে। এসময় তারা অনুসন্ধান করে বলেন খাতের গভীরতা ৪৪৭৫ ফ্যাদম বা ২৬,৮৫০ ফুট।

১৮৯৯ সালে আরেক মার্কিন অনুসন্ধানী নৌযান USS Nero খাতের গভীরতা ৩১,৬১৪ ফুট বলে ঘোষণা করে। এই সময় বিজ্ঞানীরা খাতের গভীরতা মাপার জন্য বিভিন্ন ধরণের সাউন্ডিং মেশিন বা শব্দ উৎপন্নকারী যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন।

১৯৫১ সালে বিজ্ঞানীরা আগের তুলনায় সহজ ও নির্ভুলভাবে এই স্থানের গভীরতা মাপার চেষ্টা করেন। সেসময় পরীক্ষামূলক অভিযানের জন্য চ্যালেঞ্জার ২ নামের জাহাজ ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানীরা ইকো সাউন্ডিং বা প্রতিধ্বনি গ্রহণ পদ্ধতিতে মারিয়ানা খাতের সর্বোচ্চ গভীরতা মাপেন ৩৫,৭৬০ ফুট।

এ পর্যন্ত মারিয়ানা খাত অনেক অভিযান চালানো হলেও চারটি ডুবজাহাজের অভিযান সফল বলে ধরা হয়।

১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে চ্যালেঞ্জার ডিপে অবতরণ করে বাথিস্কাফ ত্রিয়েস্ত নামের জলযান। এই ডুবজাহাজের অভিযাত্রী ছিলেন সুইস মহাসাগর প্রকৌশলী জ্যাকুস পিকার্ড ও মার্কিন নৌবাহিনীর ল্যাফটেন্যান্ট ডোনাল্ড ওয়ালশ। তারাই প্রথম মারিয়ানার তলায় অবতরণ করেন। তারা এই জলযানে চড়ে ১০,৯১৫ মিটার গভীর পর্যন্ত যেতে সক্ষম হন। এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে গভীরতম ডুব।

এরপর ১৯৯৬ সালে মনুষ্যবিহীন ROV Kaiko এবং ২০০৯ সালে Nereus এর মাধ্যমে মারিয়ানা খাতের গভীরে অভিযান চালানো হয়। তখন পর্যন্ত এর গভীরতা মাপা হয়েছিল প্রায় ১০,৯০২ থেকে ১০,৯১৬ মিটার বা ৩৫,৯০০ ফুটের কাছাকাছি।

সর্বশেষ ২০১২ সালে পৃথিবীর গভীরতম স্থানে অবতরণ করেন কানাডার চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন। অ্যাভাটার খ্যাত এই পরিচালক সাগরের তলদেশে ৩৫,৭৫৬ ফুট গভীর পর্যন্ত পৌঁছান। এই অভিযানের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল ১২ টন ওজনের সাবমেরিন। অভিযান শেষে জেমস ক্যামেরন মারিয়ানা টেঞ্চকে চাঁদের মতই বিরান বলে অভিহিত করেন।

খাতে বসবাসকারী প্রাণী

সমুদ্রের তলদেশের মত মারিয়ানার তলেও মৃত প্রাণীর কঙ্কাল বা খোলস জমতে থাকে। তাই এখানকার পানির রঙ কিছুটা হলুদ বলে মনে হয়। মারিয়ানা খাতের শেষ অংশে পানির চাপ সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক বায়ুচাপের তুলনায় প্রায় ১০০০ গুণ বেশি।

গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে পানির চাপ প্রায় ৮ টন। পানির অতিরিক্ত চাপের কারণে এখানে সাধারণ সাবমেরিন চলতে পারে না।

চ্যালেঞ্জার ডিপে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির ঘনত্ব প্রায় ৫ শতাংশ বেশি। মারিয়ানা খাতের এই অংশে পানির তাপমাত্রা ১-৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। স্থানটির তাপমাত্রা কম হওয়ার কারণে বিজ্ঞানীরা একে সাগরের তলদেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার স্থান বলে মনে করেন।

কখনো কখনো চ্যালেঞ্জার ডিপের ছিদ্রপথ দিয়ে হাইড্রোজেন সালফাইডসহ বিভিন্ন ধরণের খনিজ সমৃদ্ধ গরম পানিও বের হয়। সাগরের তলের এই বৈরি পরিবেশে টিকে থাকা কোনো প্রাণির পক্ষে সত্যিই কঠিন। তবে এই পরিবেশেও টিকে রয়েছে কেবল ব্যারোফিলিক ব্যাকটেরিয়া আর বিশেষভাবে অভিযোজিত প্রাণীরা।

রহস্যে ঘেরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ
বিখ্যাত চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরুনের মারিয়ানর উদ্দেশ্যে যাত্রা।

চ্যালেঞ্জার ডিপের মত প্রতিকূল পরিবেশেও জীবনের চক্র থেমে নেই। এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণি এবং মাছ। এছাড়া রয়েছে বৈচিত্র্যময় কিছু অদ্ভুত বাসিন্দার বসবাস। এই প্রাণিগুলো পানির ঠান্ডা, গরম এবং অতিরিক্ত চাপময় পরিবেশের মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে। এই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এদের শরীর বিশেষ ধরণের প্রোটিন দ্বারা গঠিত। এই প্রাণিগুলোর আয়ু একশো বছরের ও বেশি হয়ে থাকে।

ধারণা করা হয়, এমন পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণিগুলো বিবর্তিত বা অভিযোজিত হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই প্রাণিগুলোকে পৃথিবীর প্রাগৈতিহাসিক জীবের নমুনা বলে মনে করেন। তাদের মতে, এরা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়নি, বরং অপরিবর্তিতই থেকে গেছে।

রহস্যে ঘেরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চ

অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও সমুদ্রের নিচে এগুলো ব্যবহারে এখনো সমস্যা থাকায় মারিয়ানা ট্রেঞ্চের রহস্য পুরোপুরি ভেদ করা আজও সম্ভব হয়নি। তবে আধুনিক বিজ্ঞান ও উন্নত প্রযুক্তির সাথে অদম্য ও কৌতূহলী মানুষ যে একদিন পৃথিবীর গভীরতম এই স্থানও জয় করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest posts

  • সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    নাকের এলার্জি হচ্ছে নাকের ঝিল্লি প্রদাহের কারণে নাকের একটি সমস্যা। এটি সারা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নাকের এই রোগে আক্রান্ত। নাকের এলার্জি কোন মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ না হলেও এ রোগের কারণে দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ব্যাহত হয়। এলার্জিজনিত সর্দি এবং হাঁচি জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এই রোগে হঠাৎ…

    Read more

  • কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    গলায় বুকে কফ জমে থাকা বেশ বিরক্তিকর একটি সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। আর আবহাওয়ার এই দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শরীর খাপ খাওয়াতে পারে না, যার কারণে সৃষ্টি হয় ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাশির। ঠান্ডা সর্দি কাশি এগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত রোগ হলেও এই ঠান্ডা সর্দি কাশি থেকে আমাদের দেহে অনেক বড় বড় অসুখ…

    Read more

  • ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    সুস্থ স্বাভাবিক এবং রোগমুক্ত জীবন আমরা কে না চাই। আর এই সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে শারীরিক ওজন ঠিক রাখা। কেননা ওজন বেড়ে গেলে যে কোন রোগের ঝুঁকি ও বেড়ে যায়। এজন্য বাড়তি ওজন অনেকের মানসিক অসুস্থির প্রধান কারণ। তাই রোগ প্রকোপ কমাতে এবং মানসিক শান্তির উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের উচিত শারীরিক ওজন…

    Read more