দিন দিন মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে। আয়েশ করে বসে মুভি বা নাটক দেখার দর্শকও কমে গেছে আগের তুলনায়। তবে ইউটিউব বা অনলাইন মাধ্যমে দর্শক বাড়ছে। বিনোদনের জায়গাটিতে অন্যান্য অনেক বিষয় যুক্ত হয়েছে। যে কারণে মানুষ আজকাল তাদের স্বল্প সময়টুকুতে ইউটিউবে ঢুকে সেরা পাঁচ নাটক বা সেরা অমুক বা সেরা তমুক সার্চ দিয়ে দেখে নেয়। ইদের সময় একটু বাড়তি সময় পাওয়া যায়। আশার কথা হলো সে সময়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নাটক দেখার চল এখনো বাংলাদেশে আছে।
গত কয়েক দশক থেকে ইদ আনন্দের একটা অংশ হিসেবে টিভি অনুষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ভুমিকা নিয়ে আসছে। প্রযুক্তির বিবর্তন আর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবার কারণে তরুণ প্রজন্মের কাছে টিভি চ্যানেলগুলো কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
অন্যদিকে, সে জায়গাটা নিয়েছে অনলাইন পোর্টাল আর ইউটিউব। তবে টিভি চ্যানেলগুলোও পিছিয়ে থাকছে না। ইদের নাটকগুলো টিভিতে দেখানোর পাশাপাশি ইউটিউবেও সমান তালে আপলোড হচ্ছে। আর তাই মাধ্যম পরিবর্তন হলেও আবেদন একই রয়ে যাচ্ছে।
ইদের নাটক নিয়ে মানুষের মধ্যে একটু বেশি আগ্রহ কাজ করে বলে সেসব নাটকের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে পুরোদমে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লেখক কিংবা সমালোচকরা নিজেদের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
আজকের এই পোস্টও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। তাহলে চলুন দেখে নেওয়া যাক এবারের ইদের সেরা পাঁচ নাটক কোনগুলো।
১) কলি ২.০
রোমান্টিক ক্রাইম জনরর নাটক কলি ২.০। পরিচালনায় ছিলেন আবরার আতহার। শুধু পরিচালনা নয়, নাটকের চিত্রনাট্য ও প্রযোজনায়ও তিনি ছিলেন। অভিনয় করেছেন, নূসরাত ইমরোজ তিশা, ইরফান সাজ্জাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অনেকে। আবরার আতহার নাটকে আসার আগে হাত ঘুরিয়েছেন বিজ্ঞাপনে।
পাশাপাশি সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন “লাইফ ইন আদার ওয়ার্ডস” নামের কমেডি ঘরনার শর্ট ফিল্ম দিয়ে। অস্কার কোয়ালিফাইয়িং ফিল্ম ফেস্টিভাল সহ একাধিক ফিল্ম ফেস্টিভাল ঘুরে এসেছে এই শর্টফিল্মটি। এই শর্টফিল্মের ট্রেলার অমিতাভ রেজা চৌধুরী ফেসবুকে শেয়ার করে এক নতুন সম্ভাবনার আশা ব্যক্ত করেছিলেন।
অন্যদিকে, কলি ২.০ মুক্তির কথা ছিলো এই বছরের ফেব্রুয়ারীতে। কিন্তু চ্যানেল জটিলতায় টিভিতে কলির উন্মোচন সম্ভব হয় নি। তাই এবারের ইদে চলে এলো বায়োস্কোপে।
নিজের জায়গা থেকেও দেশকে পরিবর্তন করা যায় এই চিত্র দেখানো হয়েছে- মনসুর রানার “আমার নাম মানুষ নাটকে“
কলি ২.০ কে ইদের সেরা নাটক তকমা দেওয়ার পেছনে মূলত ক্রাইম গল্পের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ ডেভেলপ করা ছিলো। সায়রা তালুকদারের অসাধারণ সাউন্ড ডিজাইন আপনাকে একটা ক্রাইম ক্রাইম আবহের মধ্যে ফেলে দিবে। সাথে সোহেল মন্ডলের কালার গ্রেড দেখে মনে হতেই পারে বলিউডের কোন কমার্শিয়াল মুভি দেখছেন।
আর প্রত্যেকটা অভিনয় শিল্পীকে যেন নিজ চরিত্রের মধ্যে মিশে যেতে দেখেছি। মূলত, একটা চিত্রনাট্য আর চিত্রকল্পে কিছু মূল বিষয় থাকে। আর জনর অনুসারে সেগুলোকে সাজানোও একটা মূল বিষয় হয়ে থাকে। এই ছাঁচে গল্পকে সাজাতে হয়। কলি ২.০ তে সেই কাজটি আমি খুব সুনিপুণভাবে লক্ষ্য করেছি। দর্শককে ধরে রাখার সব উপাদানই রয়েছে এই নাটকে।
২) আমার নাম মানুষ
পর্দায় ভিন্ন কিছু নিয়ে বরাবরই উপস্থিত হন শাফায়েত মনসুর রানা। শুধু পর্দার সামনে নয়, পেছনে তার ভিন্নধর্মী মেকিং টেকনিক নিয়েও অনেক কথা হয়। তবে একজন পরিচালকের সফলতা মূলত পর্দার কাজের জোরেই মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। জিটিভিতে উন্মুক্ত হওয়া এই নাটকের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গাটা হলো – নাটকের ধারণা ও গল্প বিন্যাস।
“আমার নাম মানুষ” মূলত অ্যান্থোলজি টাইপ একটা নাটক। নিজের জায়গা থেকেও দেশকে পরিবর্তন করা যায় এই চিত্র দেখানো হয়েছে।
কয়েকটি গল্পকে একসাথে করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু সবগুলো গল্পের মূল থিম ছিলো- জনসচেতনতা ও প্রতিবাদ। এই ঘরনার উপস্থাপনা আগেও বাংলা নাটকে দেখা গিয়েছে। তবে “আমার নাম মানুষ”- আলাদা এই কারণেই যে এটি একটি ইতিহাসকে ধারণ করেছে, দেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেছে।
আলঝেইমার নামের একজন রোগীকে নিয়ে আবর্তিত একটি গল্প- বাংলা নাটকে রেদওয়ান রনির নতুন সংযোজন “ঝরা পাতার দিন“
সুশিক্ষার প্রভাব কতটা সুন্দর হতে পারে সে উপলব্ধিও আপনার মনে জন্মাবে। অন্যদিকে, মানুষের মনোজগতের কিছু ছোট ছোট দর্শন নাটকে দেখা গিয়েছে। নাটকের যারা অভিনয় করেছেন তাদের অভিনয় ভালোই ছিলো। তবে শাফায়েত মনসুর রানা নাটকে তার নিজ চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্যে একটু বেশি বাহাবা পেতেই পারেন।
অন্যদিকে, নাটকের খুব ছোট একটা চরিত্রে তারিক আনাম খান থাকলেও সেটি নাটকে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।
৩) ঝরা পাতার দিন
নিট অ্যান্ড ক্লিনভাবে গল্প বলার সক্ষমতাতে রেদওয়ান রনিকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তার চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় এবারের ইদের নাটক ঝরা পাতার দিন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে পুরো নাটক লেখা হলেও নাটকের মূল ভাবনা ছিলো আরেক প্রতিভাবান নির্মাতা আদনান আল রাজীবের। চ্যানেল আইতে “ভাই ব্রাদার এক্সপ্রেসের অংশ হিসেবে দেখানো হয় এই নাটকটি।
মূলত গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। অন্যদিকে, অনেক দিন পর টিভি নাটকে দেখা গেল রুমানা রশিদ ঈশিতাকে। এছাড়া খুব কম সময়ের জন্যে হলেও বন্যা মির্জাকেও টিভি নাটকে পার্সোনালি অনেক দিন পর দেখলাম। “ঝরা পাতার দিন” নাটকের সব মূল উপজীব্য বিষয় – এই গল্পের টুইস্ট।
দীর্ঘ ১১ বছর পর আয়েশাকে নিয়ে টিভি নাটকে ফিরলেন – মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী
একটা আকাঙ্ক্ষা পর্দায় চোখ দুটো আটকে ছিলো। নাটকের শেষ দৃশ্যের আগ অব্দি আপনার ধারণার সাথে গল্পের পথচলা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিলবে না। একটি ড্রামা জনরর নাটকের মূল বিষয় এই জিনিসটিই। গল্পটি আলঝেইমার নামের একজন রোগীকে নিয়ে আবর্তিত। শুধু এই রোগের প্রভাব নয়, বৃদ্ধ বাবা-মা আর সন্তানের সম্পর্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার আপনি পড়ে ফেলতে পারবেন নাটকে।
আর জাহিদ নিরবের আবহ সঙ্গীতের সাথে অসাধারণ সাউন্ড ডিজাউন আপনার ইমোশনের সাথে সাথেই দোলা দিবে।
8) আয়েশা
পাঠক আয়েশাকে চতুর্থ অবস্থানে দেখে লেখকের উপর খানিকটা মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন। তবে বিচার বিশ্লেষণ করে বলতেই হয়, মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী টেলিভিশনের জন্যে একটি সিনেমা বানিয়েছেন “আয়েশা” দিয়ে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন নূসরাত ইমরোজ তিশা। আনিসুল হকের “আয়েশামঙ্গল” অবলম্বনে চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছিলেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। উল্লেখ্য যে, এই কাজের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ ১১ বছর পর টিভি নাটকে ফিরেছেন এই স্বনামধন্য প্রতিভাবান পরিচালক।
“আয়েশা” দেখতে গিয়ে আপনি ক্ষণে ক্ষণে হোঁচট খাবেন, আপনার মনে হবে আয়েশা চরিত্রটি আপনার সামনে পুরোপুরি জীবন্ত। মূলত যারা “আয়েশামঙ্গল” পড়ে ফেলেছেন তারা কাহিনীটি আগে থেকে জানবেন এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও আপনার আগ্রহ কমবে একটুখানিও। একজন হতাশ ও ভারাক্রান্ত মনের নারী বাস্তবিকভাবে কিভাবে কথা বলতে পারে তা আপনি কড়ায়-গন্ডায় উপলব্ধি করতে পারবেন এই নাটক থেকে।
একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জয় পরাজয়ের গল্প নিয়েই সোনালী ডানার চিল নাটকটি
অন্যদিকে, ফারুকী ফিক্সড ফ্রেম আর স্লো স্টেডি গল্প বলার দিকে বেশি ঝুঁকছেন তা ডুবের পর আবার আভাস পেলাম। অন্যদিকে, ১৯৭৭ সালের সময়কার একটা গল্প ধারণ করা খুব একটা সহজ নয় যেকোন পরিচালকের জন্যে। সেখানে ফারুকী যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। নাটকে ফারুকীর পরিচালনার পাশাপাশি পাভেল অরিনের মিউজিক আপনাকে গল্পের সাথে আরো আটকে রাখবে। আর একদম শেষের দিকে বাড়তি পাওনা হিসেবে যোগ হয়েছে “আবৃত্তিকার ফারুকী”।
যদিও নাটকটি দেখতে দেখতে আপনার গত বছর “অস্থির সময়ে স্বস্তির গল্প” সিরিজে তানভীর আহসান পরিচালিত “বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো”-র সাথে মিলে যেতে পারে। তবে গল্পের সরল-সাদা উপস্থাপন দর্শকের মনে দাগ কাটতে বাধ্য।
৫) সোনালী ডানার চিল
এবারের ইদে ভাই ব্রাদার্স এক্সপ্রেসের আরেকটি নাটক। পরিচালনায় ছিলেন আশফাক নিপুন। গল্পের প্রধান চরিত্রে ছিলেন মেহজাবিন চৌধুরী, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সাবেরি আলম, আবির মির্জা। নাটকের পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রনাট্যও আশফাক নিপনেরই।
আশফাক নিপুনের সিগনেচার মেকিং যথারীতি ছিলো এই নাটকে। গল্পের মূল বিষয় ছিলো – একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। পরিবারটিতে বাবা-মা-মেয়ে মাঝে যে ধরণের বন্ডিং দেখানো হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসা পাবার মত। পাশাপাশি মেহজাবিন চৌধুরী দিনকে দিন পরিণত অভিনেত্রী হচ্ছেন এর প্রমাণ পেতে পারেন নাটকে।
সমাজ বাস্তবতার একটি চিত্র তুলে এনেছেন পরিচালক। বয়োজোষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সাবেরী আলম নিজের নামের মান রেখেছেন। গল্প নির্মাণে কিছুটা ভিন্ন কিছু ছিলো। আরাফাত মহসিনের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর গল্পের চিত্রায়নে যথেষ্ট ভালো ভূমিকা রেখেছে। সব মিলিয়ে, আপনি পুরো ৪০ মিনিট ১৮ সেকেন্ড ধরে একটি পরিবারের গল্প দেখছেন বলেই মনে হবে আপনার কাছে। আর গল্পটা হয়ত আপনার পাশের বাড়ির কারোর।
আর্টিকেলের একদম শেষ দিকে বলা যায়, প্রতিটা নাটকের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সেরা পাঁচ বের করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য কাজ, অসম্ভবও বটে। তবে রোমান্টিক ঘরনার নাটক থেকে একটু দূরে থাকার চেষ্টা নিজের দিকে ছিলো। তাই রোমান্টিক ঘরনার নাটকের রিভিউ লেখাও অনেকটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। সব মিলিয়ে, বাংলা নাটক এগিয়ে যাচ্ছে। আর এগিয়ে যাচ্ছে বলেই সেরা ৫ কিংবা ১০ বের করা কঠিন।
জয় হোক বাংলা নাটকের।