শিশু নির্যাতন, শিশু ধর্ষণসহ বাল্যবিবাহ দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। অথচ দাবী করা হয় যত দিন যাচ্ছে আমরা সভ্য হচ্ছি, বিজ্ঞানে উন্নত হচ্ছি, আচার-আচারণে শিল্পেগুণে পরিশীলিত হয়ে উঠছি। কিন্তু এই যদি হয় আমাদের সভ্য হওয়া তবে তা লজ্জার।
চাইল্ড পর্ণোগ্রাফি, চাইল্ড ট্রাফিকিং, বিশ্বজুড়ে এক বিশাল বানিজ্যের নাম- এটা যেমন আমরা জানি, জানে বিশ্বের তাবৎ নেতারা অথচ কেউ ভ্রুপেক্ষও করছে না এই দিকে। কেনো?
চাইল্ড ট্রাফিকিং এবং চাইল্ড পর্ণোগ্রাফি
একটি মেয়ে শিশু তাঁর জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে যে নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হোন তাঁর রূপ কমবেশি পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় সমান। এবং এই পুরো ব্যপারটার বিশ্লেষণ একটা বিরাট পটভূমি যা এক লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়।
এখানে প্রতিটি বিষয় সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং সমান ভাবে একটির সাথে আরেকটির সংযোগ আছে। তাই পাঠকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে আমি পুরো লেখাটিকে তিন ভাগে ভাগ করেছি। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন।
বানিজ্যে শিশু ধর্ষণঃ
শিশু ধর্ষণ দুইভাবে বানিজ্যে যুক্ত হয়। ১। শিশু পাচার ও বিক্রি এবং ২। বাল্যবিবাহ।
১। পাচার ও বিক্রি
২০১৫ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে প্রতি বছর ১.২ মিলিয়ন শিশু পাচারের অংশ হয়। ২০১২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী নারী এবং শিশু পাচারের মাধ্যমে প্রতি বছর ৩২ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়ে থাকে। এই সংখ্যা কি ২০১৭ সালে আরও বেড়েছে!
সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শরনার্থীদের সংখ্যা যত বাড়ছে, শিশু পাচারের সংখ্যাও সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাচারকৃত শিশু সন্তানদের মধ্যে কন্যা এবং ছেলে উভয় শিশুদেরকে যৌনদাস হিসাবে ব্যক্তির কাছে বা বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হয়।
তুমি আমার একটিমাত্র মেয়ে। তুমি ছাড়া আমাদের গরু পাওয়া হবে না।
তাদের পর্ণোগ্রাফী এবং ভিডিও ব্যবসায়ে বিক্রি হয়। দক্ষিন এশিয়ায় সম্প্রতিকালের বৃহত্তম শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব এলাকায়। একটি সঙ্ঘবদ্ধ দল ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জন শিশুকে ধর্ষণসহ বিভিন্নরকম যৌননির্যাতন চালায় এবং তার ভিডিও ধারণ করে। এই ভিডিওগুলির হাজার হাজার কপি বিক্রি করা হয়।
৬ বছরের একজন শিশুসহ অধিকাংশ শিশুই ১৪ বছরের কম বয়সী ছিল। একজন শিশু জানায়, নির্যাতন করার আগে তার মেরুদন্ডে ড্রাগ ইনজেকশন দেয়া হত।
বিশ্বায়নের ফলে অন্য সব বাণিজ্যের মত মানব পাচারের সুবিধা বেড়েছে, বিশ্বের যে কোন স্থানের সেক্স ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার সুবিধা বেড়েছে। সেক্স ব্যবসায় শিশুদের মূল্য সবচাইতে বেশী, তাই মুনাফাও বেশী।
কোন কিছু যখন ব্যবসায়িক পণ্য হিসাবে বেশী মুনাফার উৎস হয় তখন তার বিজ্ঞাপন হয় বেশী। তাই শিশু পর্ণোগ্রাফী্র ছবি এবং ভিডিও বিজ্ঞাপণ ব্যবসা হিসাবে খুবই সুলভ। এই বিজ্ঞাপন ব্যক্তি মানুষকে আরও প্রলুব্ধ করে। শিশু ধর্ষণ একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে তাদের মনে স্থান পায়।
অনলাইনে নিলামের মাধ্যমে শিশুদের যৌন দাস হিসাবে বাজারজাত করা হয়। বিশ্বব্যাপী, উন্নয়নের মূল্য হিসাবে হোক বা প্রাকৃতিক ও কৃত্তিম দুর্যোগের কারণে হোক বা যুদ্ধের কারণে হোক দেশে দেশে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
দারিদ্র এবং অস্থিতিশীল মানবগোষ্ঠী শিশু পাচারকারীদের বা ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অত্যন্ত সুখবর। তারা সুলভে শিশু ক্রয় করতে পারে বা চুরি করে পাচার করতে পারে।
দ্য রিয়েলিটি অফ চাইল্ড ট্রাফিকিং রিংস বলছে, নরওয়েতে বিশাল শিশু আকর্ষক চক্রের ৫১ জন গ্রেফতার হয়েছে। নেদারল্যান্ড থেকে ইন্টারনেট পেডোফিলের চক্র ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ড ট্রাফিকিং নেটওয়ার্ক অপারেটেড হয়। পর্তুগালে এক দশক ধরে রাষ্ট্রীয় এতিমখানায় দ্য কাসা পিয়া সরকারী ছত্রচ্ছায়ায় শিশু ধর্ষণের কেস হয়েছে।
টিভি ব্যক্তিত্ব এবং ডিপ্লোম্যাটরা এতে জড়িত ছিল। ১০০ জনেরও বেশী ছেলে এবং মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের জন্য ৫ জন জেলখানায় আছে। ২০০২ সালে বিবিসির শিরিন হুইলার জানান, বেলজিয়ান ক্ষমতাসীন কর্মকর্তারা এই চক্রের সাথে জড়িত ছিলো।
২০০৪ সালের দিকে জিল ডান্ডো নামের বিবিসি টেলিভিশন একজন উপস্থাপক খুন হোন। খুন হওয়ার আগে তিনি তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন যে বিবিসির স্টাফ, ডি’জেস, এবং বড় বড় সেলেব্রিটিরা চাইল্ড ট্রফিকিং রিং এর সাথে জড়িত ছিল।(জন কার, জুলাই ২১, ২০১৪)। এটা নিয়ে কোন তদন্ত হয়নি।
২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী ইংল্যান্ডে ১৪৩৩ জনকে সম্ভাব্য শিশু ধর্ষক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এদের মধ্যে ২১৬ জন মৃত। ২৬১ জন খুবই জনপরিচিত ব্যক্তিত্ব যাদের মধ্যে ১৩৫ জন টিভি, ফিল্ম বা রেডিও অঙ্গনে আছে। বাকীদের মধ্যে ৭০ জন রাজনীতিবিদ, ৪৩ জন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি থেকে এবং ৭ জন খেলার জগত থেকে আগত।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ৬৬৬টি অভিযোগ জড়িত যার মধ্যে ৩৫৭টি পৃথক প্রতিষ্ঠান ছিল। এর মধ্যে ১৫৪টি স্কুল, ৭৫টি শিশুদের বাড়ি, ৪০টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ১৪ টি মেডিকেল, ১১ কম্যুনিটি, ৯টি স্পোর্টস ভেনু এবং অন্যান্য ২৬টি প্রতিষ্ঠানে মিলিটারী গ্রুপ এবং গেস্ট হাউজ জড়িত আছে।
হলিউডে ১১ বছরে অভিনেতা কওরে হেইম ধর্ষিত হয়েছে অনেকবার। প্রডিউসার, এবং অন্যান্যরা এতে জড়িত ছিল। কোরে ফেল্ডম্যান নামে হলিউড রিপোর্টার মিডিয়ার সাক্ষাৎকারে জানান, হলিউডে অনেকে জড়িত ছিল, আছে, থাকবে।
তিনি নিজে যখন ১৪ বছর বয়সী ছি্লেন তখন তিনি এই চক্রের মানুষদের দ্বারা চারিদিক থেকে পরিবেষ্টিত ছিলেন। এই চক্রের মানুষদের অবস্থান খুবই শক্তিশালী স্থানে।
শিশু ট্রাফিকিং রিং, এবং ধর্ষণের এরকম অগনিত দৃষ্টান্ত আছে। এর অনুসন্ধানে গিয়ে মনে হয়েছে আমি শিশু ধর্ষণের একটি খনিতে প্রবেশ করেছি। সেখানে জড়িত আছে সর্বস্তরের প্রভাবশীল মানুষ। যারা রক্ষকের ভূমিকায় সমাজে বিচরণ করে এবং ভক্ষকের ভূমিকায় নিয়োজিত থাকে।
২। বাল্য বিবাহ
বাল্যবিবাহ বানিজ্য বিশ্লেষণে দুই্টি প্রেক্ষাপট দেখা যায়। একটি হলো চাহিদা এবং সরবরাহ তত্ব। অন্যটি হলো বিয়েতে যৌতুক, এবং কনে-দামের প্রচলন।
চাহিদা এবং সরবরাহ তত্বঃ
শিশুদের বিয়ে একটি বানিজ্যে পরিণত হয় যখন বিয়ের পাত্রীর চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এক সন্তান নীতির কারণে চীনে বিয়ের বাজারে নারীর সংখ্যা পুরুষের সংখ্যার চাইতে ৩০ লাখ কম। কন্যাদের চাহিদা বেশী, এবং কন্যা-দামও বেশী।
এই শূন্যস্থানের চাহিদা পূরণের জন্য ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন থেকে ১২/১৩ বছরের শিশু কন্যাদের পাচার করে চীনে বিক্রি করা হয়। চীনের মানুষ এই শিশুদের ক্রয় করে বিয়ে করে থাকে। তারা কিন্তু অবগত থাকে যে এই শিশুরা ভিয়েতনাম থেকে পাচার হয়ে এসেছে, এবং শিশু কন্যাটিকে বাধ্য করা হচ্ছে বিয়ে করতে।
পরিবার ভিত্তিক কন্যা শিশু ব্যবসা
আরেক ধরণের চাহিদা-সরবরাহে ভারসাম্যহীনতার উদাহরণ হলো ভারতের হরিয়ানা রাজ্যসহ আরও কিছু অঞ্চলের মত দাস-স্ত্রী হিসাবে নারী এবং কন্যা-শিশু ব্যবসা।
এই সমস্ত অঞ্চলে আল্ট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে কন্যা শিশু জন্মের তথ্য পেলে সেই কন্যা ভ্রুণকে অপসারণ করা হয়। ফলে পুরুষের চাইতে নারীর সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। ইতিহাসে কন্যা-সন্তানকে জন্মের পর হত্যা করার কাহিনী সর্বজনবিদিত।
একজন শিশু কন্যার বিনিময়ে তারা গরু থেকে শুরু করে যে কোন সামগ্রী, এবং আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকে।
শুধু ভ্রুণ হত্যা নয়, জীবিত যারা তাদের জীবনেও বঞ্চনা বিদ্যমান। তথ্যসূত্র অনুযায়ী হরিয়ানা রাজ্যের ১০০০০ পরিবারের সমীক্ষা থেকে ৯০০০ পরিবারেই বিবাহিত নারী অন্যান্য প্রদেশ থেকে পাচার হয়েছে এবং বিক্রির মাধ্যমে বিয়ে দেয়া হয়েছে। পাচারের সময় এদের অনেকের বয়স ১৫ বছরের নীচে ছিল।
এই পাচার এবং বিক্রিতে কখনও স্বামী, বাবা, মা এবং নিকট আত্মীয় জড়িত থাকে। বিক্রির জন্য এই সব নারী, শিশুদের নীলামেও উঠানো হয়। পাচারের মাধ্যমে বিবাহিত নারীরা সামাজিক সম্মান পায় না। প্রয়োজনে একই নারীকে বারংবার বিয়ে করানো হয়।
দাসীর মত কাজ করা এবং যৌনসঙ্গী হওয়াই এদের মূখ্য ভূমিকা। ভারতে এই দাস-স্ত্রীর ব্যবসা এখন সারা বিশ্বেই আলোচিত বিষয়।
বিয়েতে যৌতুক এবং কনে-দামের প্রচলন বানিজ্য
বিয়ে-বানিজ্যের দ্বিতীয় ক্ষেত্র হলো যৌতুক এবং কনে-দাম। যৌতুকে বরপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কন্যাপক্ষকে অর্থ এবং অন্যান্য সামগ্রী প্রদান করতে হয়। এই ক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী পাত্রীর বয়স বেশী হলে এই যৌতুকের পরিমান বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অনেকে ‘যৌতুক’ এবং ‘কনে-দাম’কে সমার্থক করে ফেলেন। ব্রাইড প্রাইস বা ‘কনে-দাম’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। এই প্রচলন দেশভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। দরিদ্র সমাজে কন্যার অভিভাবক এই ‘কনে-দাম’ পাবার আশায় দিন গুনতে থাকে।
পরিবারের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পিত হয় এই কনে-দামকে কেন্দ্র করে। পারিবারিক মর্যাদা এবং বয়সের উপর ভিত্তি করে এই দাম উঠানামা করে। একজন শিশু কন্যার বিনিময়ে তারা গরু থেকে শুরু করে যে কোন সামগ্রী, এবং আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকে। বিয়ের পূর্বশর্ত হিসাবে এই দরকষাকষি চুড়ান্ত হতে হয়।
চুক্তি অনুযায়ী এই কন্যা-দাম বিভিন্ন সময়ে ভাগ করেও দেয়া হয়। শিশু-কনের সম্মতি না দেয়ার কোন উপায় থাকে না। যদি কোন শিশু বঁধু স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যায় তাহলে বরপক্ষ তাদের দেয়া সকল অর্থসামগ্রী ফেরত চায়।
ফেরত না দিতে পারলে পুলিশ কেস হয়। তখন শিশু বয়সে কন্যাকে বিয়ে দেয়া আর ‘কনে মূল্য’ ফেরত না দিতে পারার জন্য অভিভাবক এবং স্বামী আইনের ঝামেলায় পড়ে।
পালিয়ে যাওয়া মেয়েটি বাবা-মায়ের কাছে আর সমাদর পায় না। তাকে সামাজিক কোন সংস্থার শরণাপন্ন হতে হয় বা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ে এই কন্যা-দামভিত্তিক বিয়ে প্রচলিত।
গরুর বিনিময়ে নারী
উগান্ডার একটি ডকুমেন্টারীতে দেখেছি, অনেক বয়সী এক পাত্রের সাথে বিয়ের প্রসঙ্গে বিয়েতে অনিচ্ছুক শিশু কন্যার মা বলছিলেন, “তুমি আমার একটিমাত্র মেয়ে। তুমি ছাড়া আমাদের গরু পাওয়া হবে না। মেয়েরা বিয়ে হলে চলে যায়, কিন্তু গরু থেকে যায়। তাই কন্যার চাইতে গরুর দাম বেশী”।
কন্যার চাইতে আরও কত কিছুর মূল্য বেশী সেই মানসিকতা আমরা আশেপাশে অনেক দেখে থাকি। তাই আইনে ১৬ বছর বা ১৮ বছরে বিয়ের নিয়ম থাকলেও এই প্রচলন টিকে থাকায় শিশু বিয়ে আছে। তাই শিশু ধর্ষণও আছে। কন্যার যত কম বয়স তত বেশী গরু বা অন্যান্য সামগ্রী।
লিখেছেনঃ ফাতেমা বেগম
fatemaorama@gmail.com