শচীন টেন্ডুলকারের জীবনী
শচীন টেন্ডুলকার: গড অফ ক্রিকেট
১৯৮৯ সালের ঘটনা। ভারত-পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ। প্রথম ইনিংসে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে পাকিস্তান এবং ইনিংস শেষে সংগ্রহ করে ৪০৯ রান। জবাবে ৪১ রানেই ৪ উইকেট পড়ে যায় ভারতের।
তখন ব্যাটিংয়ে নামেন একজন কিশোর যার বয়স মাত্র ১৬ বছর। ব্যাটিংয়ে নেমেই ওয়াকার ইউনুসের একটি বলে মাথায় আঘাত পান সেই কিশোর। কি মনে হয় আপনার? রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছেড়েছিল সেই কিশোর নাকি ভয় পেয়ে গিয়েছিল সেই কিশোর মন?
নাহ, আপনি যদি মনে এই দুইটার একটাও হয়েছিল সেই কিশোরের সাথে, তাহলে আপনি ভুল। লড়াই ছাড়েনি সেই কিশোর। ২৪ বলে খেলেছিলেন ১৫ রানের একটি ছোট ইনিংস কিন্তু বাউন্সারে হার না মানা সেই কিশোরটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সবুজ মাঠের এই গোল স্টেডিয়াম এক সময় তাঁর নামেই কেপে উঠবে।
কিশোরটির নাম জানতে চান? তিনি শচীন টেন্ডুলকার। ক্রিকেট ঈশ্বর।
শচীন টেন্ডুলকারের জন্ম ও পরিবার:
২৪শে এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে ভারতের মুম্বাই শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। বাবা রমেশ টেন্ডুলকার ছিলেন একজন অধ্যাপক এবং লেখক। পিতা ছেলের নাম রেখেছিলেন বিখ্যাত সুরকার “শচীন দেব বর্মণ” এর সাথে মিলিয়ে।
শচীন টেন্ডুলকারের ক্রিকেটে হাতেখড়ি:
যখন শচীনের বয়স ১১ বছর তখন তাঁকে একটি ক্রিকেট ব্যাট উপহার দেন তাঁর বড় বোন। এরপর থেকেই শুরু হয়ে যায় একটি সাধারণ ছেলের অমরত্বের পথে যাত্রা। বড় ভাই অজিত টেন্ডুলকার ১১ বছর বয়সেই ছোট ভাইকে নিয়ে যান শিবাজি পার্কে যেখানে শ্রী রমাকান্ত আচরেকার এর অধীনে ক্রিকেট প্র্যাক্টিস শুরু করেন শচীন। ঘন্টার পর ঘন্টা সেখানে প্র্যাকটিস করতে শুরু করেন শচীন।
প্রতিবার শচীন নেটে যাওয়ার আগে স্টাম্পে একটি কয়েন রাখতেন গুরু রমাকান্ত। শর্ত ছিল এরকম যে, একমাত্র আউট না হলেই সেই কয়েন পাবেন শচীন। বলা বাহুল্য, শচীন গুরুদেবের ১৩টি কয়েন নিজের কাছে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শচীন টেন্ডুলকারের ক্রিকেটে অভিষেক:
১৪ বছর বয়সে বন্ধু বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে ৬৬৪ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ করেছিলেন শচীন। সেই পার্টনারশিপে ৩২৬ রান করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। এর ঠিক এক বছর পরেই ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেন শচীন, যার বদৌলতে ঠিক এক বছর পরেই আন্তর্জাতিকের দরজা খুলে যায় শচীনের। আর রেকর্ড বুকে নাম তোলেন সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে।
প্রথম সেঞ্চুরি পান ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে করেন জোড়া সেঞ্চুরি যার মধ্যে একটি করেছিলেন পার্থের ওয়াকাতে যা ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গতিময় পিচগুলোর একটি। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে শচীনের। ৯০ এর দশকে হাজারো সমস্যায় ভুগতে থাকা ভারত শচীনের মধ্যে খুজতে শুরু করেছিল একজন “অতিমানব”কে।
লেখাটি ভিডিও আকারে দেখুন:
ভারতীয় ক্রিকেটের ত্রাতা:
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের ফিক্সিং কেলোঙ্কারিতে যেখানে ভারতীয় ক্রিকেট একজন ত্রাতাকে খুজছিল, শচীনের মধ্যে সেই ত্রাতাকে খুজে পেয়েছিল ভারতীয়রা। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হোন শচীন। সেই বছরেই ক্যাপ্টেন্সি পান শচীন কিন্তু দলের সেরা খেলোয়াড় যে সবসময় দলের সেরা অধিনায়ক হতে পারবে না, তাঁর প্রমাণ ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। টেস্টে ২৫টি ম্যাচ ক্যাপ্টেন্সি করে জিতেছিলেন মাত্র ৪টি ম্যাচ।
শচীন টেন্ডুলকারের ক্রিকেটে সেরা সময়:
১৯৯৮ সাল হয়তো শচীন এর ক্যারিয়ারের সেরা বছরগুলোর একটি। সেবার, অস্ট্রেলিয়ার সাথেই প্রথম ডাবল-সেঞ্চুরি করেন শচীন। ২০০১ সালে ওডিয়াই ক্রিকেটে ১০০০০ রানের গন্ডি পার করেন শচীন এবং ২০০২ সালে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৩০টি টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙ্গেন শচীন। পরের বছরের বিশ্বকাপে আবারো সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হোন শচীন কিন্তু কাপ অধরাই থেকে যায় শচীনের জন্য।
টেন্ডুলকারের বোলারদের উপর রাজত্ব ৩০ বছরের গন্ডির পার হওয়ার পরও চলতে থাকে। বিশেষ করে শেন ওয়ারন কিংবা ব্রেট লিদের সামনে শচীন যেনো হয়ে উঠতেন ক্ষুরধার তলোয়াড়। একবার তো সাক্ষাতকারে ওয়ারন বলেছিলেন, তাঁর দুঃস্বপ্ন ছিলেন শচীন, তাঁর বলে সামনে এগিয়ে টেন্ডুলকারের ছয় যেনো তাঁর সামনে ফিরে আসতো বারবার।
রেকর্ড বুকে শচীন টেন্ডুলকারের আগ্রাসন:
২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ২৪১ রানের একটি অপরাজিত ইনিংস খেলেন শচীন টেন্ডুলকার। ২০০৮ সালের অক্টোবরে ব্রায়ার লারার ১১৯৫৩ টেস্ট রানের রেকর্ড ভাঙ্গেন শচীন।
১০০টি ইন্টারন্যাশনাল সেঞ্চুরির মালিক এই ক্রিকেটার তাঁর শততম সেঞ্চুরি করেন বাংলাদেশের সাথে ২০১২ সালে। ৫১টি টেস্ট সেঞ্চুরিতে তাঁর টেস্ট ক্রিকেটে রান ছিল ১৫৯২১ রান, ওডিয়াই ক্রিকেটে করেছেন ১৮,৪২৬ রান যেখানে সেঞ্চুরি ছিল ৪৯টি।
কিন্তু একটি অপ্রাপ্তি সবসময়ই শচীনকে তাঁর অমরত্বের পথে কাটা হয়ে দাড়িয়েছিল। তা হলো বিশ্বকাপ ট্রফি। ২০১১ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দুর্দান্ত অধিনায়কত্বে এবং যুবরাজের অল-রাউন্ডিং পারফরম্যান্সে শচীন তাঁর মাথার মুকুটে একমাত্র বাকি থাকা হীরেটিও যোগ করে নেন। বিশ্বকাপের মত মঞ্চে সবমিলিয়ে ২০০০ এর উপর রান এবং ৬টি সেঞ্চুরি ছিল তাঁর যা এখনো বিশ্বকাপে কোনো ক্রিকেটার এর সর্বোচ্চ রান।
এত এত রেকর্ড তাঁর নামে কিন্তু তিনি কি শুধু রেকর্ডের কারণেই থাকবেন ক্রিকেট ইতিহাসে? নাহ। ক্রিকেটপ্রেমীরা শচীনকে মনে রাখবেন শোয়েব আখতারের বলে স্কয়ার কাটে মারা ছয়কে, মনে রাখবেন ব্রেট লিকে স্ট্রেইট ড্রাইভে মারা চারের জন্য, মনে রাখবেন মুরালিকে মারা পারফেক্ট সুইপের জন্য কিংবা ওয়াকার ইউনুসের ইনসুইং-এ কবজির মোচড়ে মারা চার এর জন্য।
ভারতীয় ক্রিকেটের ভার ২৪ বছর ধরে বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। কত জয়, কত আনন্দের উপলক্ষ ছিলেন এই “লিটল মাস্টার”। তরুণদের জন্য ছিলেন একজন অনুপ্রেরণা, একজন আদর্শ। অন দ্যা ফিল্ড এবং অফ দ্যা ফিল্ড, তিনি ছিলেন ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের চূড়ান্ত বিজ্ঞাপন।
“শচীন, শচীন” এই স্লোগানটি আমি আমার জন্মের পর থেকেই শুনে আসছি। ৯০ এর দশকে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ে বড় হয়েছেন শচীনের মাস্টার ব্লাস্টার ইনিংসগুলো দেখে। ভারতে কখনো খেলা হলে শচীন যখনই নামতেন, তখন এই স্লোগানে মুখরিত হয়ে যেত ভারতের ইডেন গার্ডেন কিংবা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম।
১০০ কোটির মানুষের এই প্রত্যাশার চাপ কি একজন সাধারণ মানুষ বয়ে বেড়াতে পারেন? শচীন ছিলেন মানুষ হয়েও একজন ঈশ্বর, যার ছোয়ায় বদলে গিয়েছিল ভারতের ক্রিকেট। এমনকি ভারতের উঠতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনেও নাকি শচীনের অবদান ছিলো, এমনটাও দাবি করেছিলেন ভারতের অর্থনীতিবিদেরা।
শচীনের ১৫৯২১ রানের রেকর্ড মনে হয়না কেউ ভাঙতে পারবেন। তাঁর ১০০টি সেঞ্চুরির রেকর্ডও হয়তো থেকে যাবে অধরা। অবশ্য রেকর্ড গড়া হয় ভাঙ্গার জন্যই, হয়তো বিরাট কোহলি তাঁর অমানবিক ফর্ম যদি আরো ৫-৭ বছর চালিয়ে যান তাহলে হয়তো ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু একজন শচীনের স্ট্রেট ড্রাইভ কি আমরা কখনো ফিরে পাবো? উত্তরটা আপনারাই দিন।
শচীন টেন্ডুলকার প্রকৃত অর্থে একজন ক্রিকেটের ঈশ্বর
ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারকে নিয়ে লেখাটা কেমন লেগেছে আপনাদের? কমেন্টে লিখুন। আর কাকে নিয়ে লেখা পড়তে চান সেটাই জানান আমাদের।
সফলদের জীবনীর আরও লেখা পড়ুন:
ভারতীয় ক্রিকেটের উত্থানে দাদা সৌরভ গাঙ্গুলি
লিটন দাস, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আগামীর তারকা
গ্রামের দুরন্ত এক কিশোরের মাশরাফি বিন মর্তুজা হয়ে উঠার গল্প
অ্যালিস্টার কুকঃ টেস্ট ক্রিকেটের এক ঋষির গল্প