লেখক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার দিয়ে শুরু করি-
(সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বিপ্লব রহমান। ডিসেম্বর ১৯৯৩।)
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আহমদ ছফা
বিপ্লব : বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক কাদের বলে আপনি মনে করেন?
ছফা : জনপ্রিয় লেখক হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ।
বিপ্লব : বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছেন এ যুগের শরৎচন্দ্র। আপনি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত?
ছফা : জনপ্রিয়তার দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ূন শরৎচন্দ্রের চাইতে বড়। মেরিটের দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ূন নিমাই ভট্টাচার্য্যের সমান। আর হুমায়ূনের প্রশ্নটা হচ্ছে — হি ইজ রাইটিং ফর বাজার।
বিপ্লব : অর্থই এখানে মূল?
ছফা : আমার তো মনে হয় না এখানে অন্যকোন উদ্দেশ্য আছে। হুমায়ূন সম্পর্ক বলতে আমার কষ্ট হয়। হি ইজ পার্টলি মাই ক্রিয়েশন। তারপরেও এগুলোকে পুত্রজ্ঞানে দেখাই ভার।
কেমন ছিল হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা?
আমরা সাধারন পাঠক হিসেবে হুমায়ূনের এই বাজারের ভোক্তা হতে পেরে কতটা সৌভাগ্যবান সে আলোচনায় যাবো। যারা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি তাদের জন্য সময়টা খুব অস্থির, কেননা আমরা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে প্রযুক্তি আর তার অবাধ ব্যবহার আমাদের করে ফেলেছে অনেক দ্রুত আর ব্যস্ত।
তাই সময় গড়ানোর সাথে সাথে আমরা হয় মানিয়ে নিয়েছি, নয়তো একজন থেকে আরেকজন পিছিয়ে গেছি বিভিন্ন দিকে। সাহিত্যকে বলা হয় স্রোতস্বিনী নদীর মত, কালের বিবর্তনে সাহিত্য তার সাথে বয়ে নিয়ে যায় সময়ের সাক্ষী তার স্মৃতি আর মনে রাখার মত ঘটনা আর কিছু মানুষকে। শুধু নব্বইয়ের এই যৌবনদলকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাদের কাছে সাহিত্যের উপহার কি?
হুমায়ূন আহমেদের গল্প, উপন্যাস
আমাদের সৌভাগ্য হুমায়ূন নব্বইয়ের দশকে মোটামুটি শিল্পের সব শাখায় বিচরণ করতে শুরু করেছেন হিমুর মত। চলচ্চিত্র, নাটক নির্মান যোগ হল তার লেখনীর সাথে আর ক্ষুধিত মানুষেরা পেল তাদের বিনোদনের নতুন স্বাদ।
শিল্পের সব শাখায় হাত দিয়ে কবিগুরু যেমন তার জীবনকে করে গেছেন পূজনীয়, তেমনি হুমায়ূন বারবার নিজেকে টিভি, ফিল্ম আর কাগজের পাতায় এনে আমাদের সময়টাকে করে গেছেন উপভোগ্য।
মেহের আফরোজ শাওন প্রায়ই একটা কথা বলেন, ‘হুমায়ূন তার প্রথমজীবনে যে সাংসারিক দৈন্যতায় অনেক সাধ মেটাতে পারেননি, লেখার পসারে তার উপার্জন বেশিরভাগ তিনি ব্যয় করতেন তার যখন যেটা করতে মন চাইতো তাতেই।’
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তসলিমা নাসরিন
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে তসলিমা নাসরিন তার এক লেখায় বলেছিলেন-
হুমায়ুন আহমেদের জন্য সম্ভবত আমার কষ্ট হবেনা দীর্ঘদিন। কারন হুমায়ূন আহমেদ জীবনে যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন, যা চেয়েছেন তাই করেছেন। রাজা হতে চেয়েছেন, রাজা হয়েছেন।
বাদশাহী উপভোগ করতে চেয়েছেন, উপভোগ করেছেন। পৃথিবীর খুব কম মানুষই জীবনে এত ভোগ বিলাস করার সুযোগ পান। খুব কম মানুষই জীবনে তার যাবতীয় স্বপ্নকে সফল করার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
এই জীবনে কে কার চেয়ে বেশি যশ আর খ্যাতিলাভ করতে পারে তার একটা ভীষন রকম প্রতিযোগিতা চলে। হুমায়ূন আহমেদ সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশে যারা সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে যুক্ত তাদের থেকে হাজার মাইল এগিয়ে ছিলেন। তার নাগাল কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। তার মত সৌভাগ্যবান মানুষ আমি আর দেখিনি।’
আসলেই কি তাই? মাসিক বেতন নব্বুই টাকা বেতনে বাবা ফয়জুর রহমান একটা অংশ পাঠিয়ে দিতেন গ্রামের বাড়িতে, এক অংশ দিয়ে প্রতি মাসে বই কিনতেন, আর বাকী যা থাকতো তা তুলে দিতেন স্ত্রীর হাতে।
একজন ছাপোষা দারোগার সন্তান হয়ে এই জনপ্রিয়তার শিখরে আসতে তার যে পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল তা কেমন ছিল? যুদ্ধে পাকিস্তানীদের জন্য আর পরে রক্ষীবাহিনীর জন্য বারবার নিঃস্ব পরিবারটিকে নিয়ে যখন ঘুরতেন, তখন কি ছিল এমন বিলাসী বাস্তবের চিন্তা? পারিবারিক টানাপোড়েন না হয় আজকে উহ্য থাকুক।
হুমায়ূন আহমেদ বাঙালি জাতিকে ‘ঘরমুখো’ থেকে ‘বইমুখো’ করেছেন পড়ুন
লেখাকে যখন গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেন তার আগের আর পরের সময়টা কেমন ছিল? ক্যান্সার হাসপাতাল বানানো যদি তার শেষ স্বপ্ন আর ইচ্ছা হয়ে থাকে তা কি আলাদীনের চেরাগের বদৌলতে এখন আমাদের সামনে দৃশ্যমান?
আরো ছোট ইচ্ছাতে যদি যাই তার প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোণার ‘শহীদ স্মৃতি স্কুল’টির কি হাল এখন? শিক্ষকেরা এম পিও ভূক্ত হতে পেরেছেন কি? আর স্বপ্নের কথা বলতে গেলে হতে হয় আরো আবেগপ্রবণ।
হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে অভিনেতা ডাঃ এজাজ বলেছিলেন-
” হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে শুটিং করতে গিয়েছিলাম বনুর গল্প নাটকের। এক বাসে আমরা সবাই। স্যার সামনের দিকে বসা, আমি পেছনে। কিছুক্ষণ পর স্যার আমাকে ডাকলেন, তাঁর পাশের সিটে বসতে বললেন। বসলাম।
স্যার বললেন, ‘আমার খুব ইচ্ছা একটা সুন্দর বাগানবাড়ির। তোমাকে দায়িত্ব দিলাম, তুমি সব করবে।’
শুরু করলাম জায়গা খোঁজা। নির্ভেজাল জায়গা পাওয়া খুব কঠিন কাজ। অবশেষে বাড়ির জায়গা পেয়ে গেলাম। স্যারকে জানালাম। স্যার দেখতে এলেন। এত মুগ্ধ হতে স্যারকে আমি কখনো দেখিনি।
পুরো জায়গা দেখার পর স্যার আমাকে কাছে ডাকলেন, পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি আমার জীবনের একটা বড় স্বপ্ন পূরণ করে দিলে।’ আমার চোখে তখন পানি।”
আরজ আলী মাতুব্বর, একজন কৃষকের দার্শনিক হয়ে উঠার অবিশ্বাস্য গল্প
নিন্দামুখর তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে আবার হুমায়ূনের কিছু কথা শুনলে আমি বারবার চমকিত হই, কেননা তার সময়কার ক’জন পুরুষ এভাবে বলতে পেরেছেন তার পাঠকসমাজকে আমি জানিনা।
তিনি লেখায় বলেছেন, ‘আমি মনে করিনা মানুষ এমন কোন অপরাধ করতে পারে যার শাস্তি তার কাছ থেকে তার দেশ কেড়ে নেয়া। কেন বাংলাদেশের একটা মেয়ে ভবঘুরে হয়ে এভাবে দেশে দেশে ঘুরবে? তসলিমা নাসরিন যদি বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, তিনি থাকবেন তার বিভ্রান্তি নিয়ে, আমরা কেন তাকে দেশ ছাড়া করবো? ভয়ংকর সব যুদ্ধাপরাধী তো ঠিকই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের তো দেশ ছাড়া করা হয়নি।’
হুমায়ূন আহমেদের একটা বড় সীমাবদ্ধতা
হুমায়ূন আহমেদ এর একটা বড় সীমাবদ্ধতা কি ছিল তার লাজুকতা?
নিজেকে ‘গর্তজীবী’ বলার মধ্যে কি আমরা মিসির আলির মত রহস্যের গন্ধ পাই না? আজকালের লেখকেরা তাদের লেখা নিয়ে যেভাবে প্রচার করে, সমানে কলাম লেখে কিংবা টকশোতে মুখ দেখাতে, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে মুখিয়ে থাকেন, তিনি এতটা প্রচারবিমুখ কেন ছিলেন?
এটা কি তার নিজস্বতা, না জনপ্রিয় হয়ে আর সেদিকে মন দেয়ার অনীহা ছিল তা পরিস্কার না। নাকি এটাও এক ধরনের অহমিকা ছিল তা পাঠক ভাবতে রাজি নন।
ইমদাদুল হক মিলনের একটা সাক্ষাৎকার ছিল হুমায়ূন পরে তা নিজের ভাষায় লিখেছিলেন।
তার কিছুটা তুলে ধরলাম।
অভিযাত্রী সাহিত্য পাতায় কবিতা পড়ুন
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বহু দিন ধরে টিভিতে, পত্র-পত্রিকায়, এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও যান না, এর কারণ কী? আপনি কি এগুলো অ্যাভয়েড করতে চান? আপনি বলছেন সব কিছু পরিষ্কার বলতে চান, কিন্তু আপনি তো বলেন না।
হুমায়ূন আহমেদ : শোনো, এ ধরনের প্রোগ্রামে যাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক দিন হলো। একটা সময় ছিল, লেখালেখি জীবনের শুরুর কথা বলছি, যখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতাম। পত্রিকার অফিসে বসে থাকতাম।
বাংলাবাজারের প্রকাশকদের শোরুমে সময় কাটাতাম। ওই সময়টা পার হয়ে এসেছি। আমার বয়সও হয়েছে। এসব ভালো লাগে না। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে বেশির ভাগ সময়।
তা ছাড়া হয়েছে কী, মানুষ তো গাছের মতো। গাছ কী করে? শিকড় বসায়। প্রতিটি মানুষেরই শিকড় আছে। আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত যে শিকড় আছে, সেগুলো ছিঁড়ে গেছে।
আমি ফর ফাইভ ইয়ারস বাইরে বাইরে ঘুরেছি। কখনো মায়ের কাছে থেকেছি, কখনো হোটেলে থেকেছি, কখনো উত্তরায় একটি বাসা ভাড়া করে থেকেছি, কখনো বন্ধুর বাসায় থেকেছি, দখিন হাওয়ায় থেকেছি।
যখন দখিন হাওয়ায় থাকতে শুরু করলাম তখনো সমস্যা। সপ্তাহের তিন দিন থাকি দখিন হাওয়ায়, চার দিন থাকি গাজীপুরে। প্রায়ই রাতে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, আমি এখন কোথায়? ঢাকায় না গাজীপুরে?
একজন মানুষের শিকড় যখন ছিঁড়ে যায়, তখন তাকে অস্থিরতা পেয়ে বসে। এই অস্থিরতার জন্যই বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, নিজের মতো থাকি। ঘরে বসে থাকি, ছবি দেখি, গান শুনি। আমি এই বয়সে এসে এ রকম একটা সময় পার করছি। গর্তজীবী হওয়ার পেছনে এটাও হয়তো কারণ।
হুমায়ূন যে শিক্ষক জীবনে নির্বাচন করেছিলেন এবং হেরেছিলেন তা অনেকেই জানেন না। তার কারন নিয়ে কথা বলেছিলেন এমিরেটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচন হল। নির্বাচনে আমরা এস্টাব্লিশমেন্ট-বিরোধী শিক্ষকরা অংশ নিয়েছিলাম। হুমায়ূন আমাদের দলের একজন প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। মূলত দুটো কারণে। শিক্ষকদের মধ্যে তার পরিচিতি তেমন ছিল না।
দ্বিতীয় কারণ তার লাজুকতা। যারা তাকে চিনতেন, তার লেখারও ভক্ত ছিলেন, তাদের সঙ্গেও তিনি ওভাবে কথা বলতে পারেননি। হয়তো তারা তার প্রশংসা করে কথা বলছেন, হুমায়ূন কিছুই বললেন না- ওরা ধরে নিলেন তিনি অহঙ্কারী। আসলে হুমায়ূন মোটেই অহঙ্কারী ছিলেন না। তার চুপচাপ স্বভাবটার জন্য অনেকেই তাকে ভুল বুঝতেন।
কোহিনুর হীরা নিয়ে চমৎকার একটি লেখা পড়তে ক্লিক করুন
হুমায়ূন আহমেদ মূলত লিখেছেন বাংলাদেশের নাগরিক মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে। নিজের লেখায় যৌনতার খোলামেলা বর্ণনা তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন, এড়িয়ে গেছেন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সাংঘর্ষিক ইস্যু এবং তাঁর অনেক গল্পেই শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের পারিবারিক মূল্যবোধেরই জয় দেখানো হয়েছে।
কিন্তু এই জনপ্রিয় লেখক নিজে যখন প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তিরিশ বছরের সংসার ভেঙ্গে মেয়ের বান্ধবী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন, তখন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন তাঁর ভক্তরাও। কিন্তু সেই বিতর্কও এক সময় থিতিয়ে এসেছিল।
নিজের লেখালেখি, টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ তার ভক্তদের মাতিয়ে রেখেছেন। সেই ভক্তরা তো তাকে নিয়ে মেতে আছে এখনো।
হিমু পরিবহন কাজ করে যাচ্ছে তার স্বপ্ন নিয়ে, পাঠকেরা এখনো মেলায় বা দোকানে লাইন করে যে বই কিনছেন, সেই বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দেখে মোনার মত আজো ব্যথিত হন কিংবা ঘেটুপুত্রের মৃত্যুতে যে আজো মন খারাপ করেন তাদের মাঝেই তো বেঁচে থাকবেন তিনি।
হুমায়ূনের জীবন নিয়ে লেখার মত জ্ঞান, তথ্য কিংবা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই, তবে হুমায়ূন তো নিজেই উসকে দিয়েছেন জীবনকে এতকিছু দিয়ে জটিল না ভেবে বইয়ের পাতার চরিত্রগুলোর মত সহজ করে ভাবতে। যখন নীলক্ষেতে যাই বইয়ের গাঁয়ে ‘হুমায়ূন’ নামটা দেখে ঠিক আগের মতই রোমাঞ্চিত হই। ঠিক আগের মতই মুগ্ধ হয়ে তাকাই ‘হাবলংগের বাজার’ এর চরিত্ররা কি সহজাতভাবে লোক হাসিয়ে যায়। থমকে যাই আজো জোছনা দেখলে, হয়তো অনেক যুবক বনে যেতে চায় আজ রাতে। এখনো।’’
মারুফ ইমন
চিত্রনাট্যকার , দীপ্ত টিভি
(১২ নভেম্বর ২০১৮)
মেইল – maruf.hasan12040@gmail.com