দুই পরিবারের সংঘর্ষের মধ্যে গড়া উঠা হাজার বছরেরও আগের প্রেম কাহিনী যাদের অন্তিম পরিণতি হয় মৃত্যু। বেসিক্যালি, রোমিও-জুলিয়েটের মতোই এদের গল্প।
এসব কাহিনী আমরা ছোট থেকে শুনে আসছি। এবার আসুন, কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া ভারতীয় চলচ্চিত্র “লায়লা মজনু” নিয়ে একটু কথা বলি।
ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, আমি প্রচুর পরিমাণে মুভি দেখি অথবা বলা যেতে পারে, মুভি গ্রোগাসে গিলি। কিন্তু গত কিছু বছর ধরে ভারতীয় মুভি বিশেষ করে বলিউডের উপর আমার আস্থা উঠে গিয়েছিল।
লায়লা মজনু সিনেমাটি বলিউডের জগতে এক অনন্য সংযোজন
সাম্প্রতিক “রেস-৩”, “থাগস অফ হিন্দুস্থান” কিংবা “ফ্যানি খান” এর মতো মুভি দেখে বলে ফেলেছিলাম, টাটা বাই বাই বলিউড! আর দেখব না তোমাদের মুভি।
বিশেষত বলিউড মুভির একটা সিম্পল নিয়ম আছে। নিয়মটা হলো, আপনি অনেক সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মুভি বানাতে পারেন কিন্তু ওটার মধ্যে আপনাকে লাভ স্টোরি ঢুকাতেই হবে। প্লটের ঠিকমতো ডেভেলপমেন্ট কি জিনিস তা হয়তো তাঁরা বুঝেই না গোটা কয়েকজন পরিচালক বাদে!
এই এত এত বাজে মুভির মধ্যে যদি একটা “ফ্রেশ” মুভি দেখে ফেলার সৌভাগ্য হয় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? আপনার মন ভালো হয়ে যাবে এমন মুভি দেখলে। যদিও এই মুভির এন্ডিং জানা তবুও এন্ডিং দেখার পর আপনি কিছুক্ষণ খারাপ লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন।
পরিচালনা এবং চিত্রনাট্য
“লায়লা মজনু” পরিচালনা করেছেন সাজিদ আলী এবং এর চিত্রনাট্য ছিল তারই বড় ভাই ইমতিয়াজ আলীর হাতে। সাজিদ আলীর এটা প্রথম মুভি হলেও তিনি ভালো করেছেন বলা যায়। ফার্স্ট হাফ কিছুটা বেখাপ্পা কিংবা স্টোরিটেলিংটা দ্রুত হচ্ছে মনে হলেও সেকেন্ড হাফ বেশ ভালো লাগবে।
এই মুভির মধ্যে একটা ব্যাপার আছে যা এটি অন্য রোমান্টিক মুভি থেকে আলাদা করেছে। আর সেই ব্যাপারটি হলো, তাঁরা ভালোবাসার এক অন্য রুপ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। প্রেম কিংবা কামে মনোযোগ দেননি। দিয়েছেন ভালোবাসার বিরহে।
ছবিটিতে অভিনয় করা লিড রোলের দুইজনই বলিউডে নবাগত। অভিনাশ তিওয়ারি এবং তৃপ্তি ডিমরি দুইজনই তাঁদের সেরা ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে বলতে গেলে, আমি অভিনাশ তিওয়ারির অভিনয়ের ভক্ত হয়ে গেলাম আজ থেকে।
মুভির সেকেন্ড হাফে নিজের অভিনয় দিয়ে সবাইকে নিজের মায়ায় ফেলে দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে তাঁর অভিনয় কিছুটা মনোটোন কিংবা বিরক্তিকর মনে হলেও সেকেন্ড হাফে তিনি ছিলেন অনন্য। বিশেষ করে যতক্ষণ তিনি স্ক্রিনে থাকবেন সেকেন্ড হাফে, আপনি তাঁর দিকেই মনোযোগ দিতে বাধ্য থাকবেন।
সে হিসাবে, তৃপ্তি খুব একটা ভালো অভিনয় করেননি। আমার কাছে মনে হয়েছে, চিত্রনাট্যে লায়লা(তৃপ্তি) কিছুটা ফিকে ছিল মজনু চরিত্রের কাছে।
মধ্যযুগের লায়লা মজনুর প্রেম, বনাম আধুনিক যুগের লায়লা মজনু্র প্রেম
ছবির আরেকটি বিশেষত্ব হলো এর আবহ সংগীত এবং গান। অসাধারণ কম্পোজিশন করেছেন জয় বড়ূয়া এবং নিলাদ্রি কুমার। একটা গানও জোর করে ঢুকানো হয় নাই গল্পে। আবহ সঙ্গীত নিজের জাত চিনিয়েছেন হিতেশ সনিক।
মুভির গল্প শুরু হয় কাশ্মীরে যেখানে দুই প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের ছেলে এবং মেয়ে একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। লায়লা মজনু গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হলেও গল্পের সেটিং করা হয়েছে বর্তমান যুগের আদলে।
যেখানে নায়িকাকে রক্ষণশীল মেয়ে হিসেবে দেখানোর বদলে দেখানো হয়েছে, অতি আদরে বড় হওয়া একটি মেয়ে যে চায় শহরের সবাই তাঁর প্রেমে পড়ুক। এরই মধ্যে কায়েস(মজনু)(অভিনাশ) নায়িকার পিছনে ঘুরতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না নায়িকা তাঁকে মোবাইল নাম্বার দেয়।
সিনেমার এই পার্টটি টিপিক্যাল বলিউড মুভির এক উদাহরণ। যা আমার কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। তবে মুভি তাঁর গিয়ার চেঞ্জ করতে শুরু করে তাঁদের প্রেমে পড়ার পর থেকে। বেশি কিছু বলব না আর। বললে স্পয়লার হয়ে যাবে কিন্তু কায়েস(অভিনাশ) এর অসাধারণ অভিনয় দেখার জন্য আপনাকে শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে।
সিনেমোটোগ্রাফি
ছবিটিতে সিনেমোটোগ্রাফি যে করেছেন তাঁর পুরষ্কার পাওয়া উচিত। কাশ্মীর এর সেটিং-এ এর থেকে কোনো লাভ স্টোরি এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হত না যদি সায়ক ভট্টাচার্য তাঁর বিল্রিয়ান্স না দেখাতেন।
মুভি কেনো দেখবেন? এটা বলিউডের গতানুগতিক কোন লাভ স্টোরি না। এই গল্পে নায়ক ভালোবাসার বিরহে পাগল হয়েছে। ভালোবাসা ব্যাপারটা কত পবিত্র হলে তা আর দুইজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আপনি আপনার ভালোবাসাকে খুজে পাবেন সব জায়গায়, যা কায়েস পেরেছিল।
আবার লায়লার চলে যাওয়ার আগমুহূর্তেও সে চেষ্টা করেছে লায়লাকে ধরে রাখার। মুভির এক পর্যায়ে যখন দুই পরিবার জেনে যায় তাঁদের ব্যাপারে তখন নায়িকা ভয় পেয়ে সম্পর্ক ব্রেক-আপ করতে চেয়েছিল।
নায়ক উত্তরে বলেন, করলাম ব্রেক-আপ, কিন্তু ব্রেক-আপ জিনিসটা কি? নিমিষেই ভালোবাসা দূর হয়ে যাওয়া নাকি ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া! এই ডায়লগটা যেনো এখনকার মেকি গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কের উপর এক ধরনের চপেটাঘাত। এতই সোজা ভালবাসার মৃত্যু?
আমরা সাধারণত লাভ স্টোরিতে হ্যাপি এন্ডিং আশা করে থাকি। কিন্তু লায়লা-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট কিংবা পুরাণের রাধা-কৃষ্ণ এদের ভালোবাসা অমর কেনো? বিরহে যে লুকিয়ে আছে সত্যিকারের ভালোবাসার প্রকাশ।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে, “লায়লা মজনু” আপনার সময় নষ্ট করবে না এই গ্যারান্টি দেওয়া যায়। সো, হ্যাপি ওয়াচিং!