রাধারমণ দত্ত | বাংলা সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র, ভিন্ন ধারার সাধক লোককবি

রাধারমণ দত্তের জীবনী

রাধারমণ দত্ত, এক সাধক কবি 

আমরা এমন এক জাতি যারা ভুলে যেতে পছন্দ করি। যেমন, আজকের দিনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরের দিন আমরা ভুলে যাই। কোনো কিছু নিয়ে ক্ষণিকের হুজুগ তৈরি হলে তা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

আজ যে ব্যক্তিকে নিয়ে কথা বলব, তাঁর নাম হয়তো অনেকেই শুনেননি। কিন্তু তাঁর অবদান বাংলা সাহিত্যে যে অসীম। বিশেষ করে লোক সংগীতে। তাঁর রচিত ধামাইল গান বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।  

কথা এবং সুরের স্রষ্টা             

“শ্যাম কালিয়া সোনা বন্ধুরে ”, “ভ্রমর কইয়ো গিয়া” কিংবা “ মা তুই জলে না যাইও, ওহে কলঙ্কিনী রাধা” এই গানগুলি অবশ্যই আপনারা শুনেছেন। শুনে না থাকলে শুনে নিবেন। এই কালজয়ী গানগুলোর  সষ্ট্রা এই রাধারমণ দত্ত।

রাধারমণ দত্তের জীবনী

রাধারমণ দত্তকে জানতে গেলে আমাদের ইতিহাসে প্রবেশ করতে হবে। সেন বংশের রাজাদের “মাৎস্যন্যায়” রাজত্বের ঠিক পরেই আবির্ভাব হয় শ্রীচৈতন্যের। তাঁর হাত ধরে প্রচারিত হয় বৈষ্ণববাদী সহজিয়া ধর্মের। তাঁর এই ভাবধারায় তখন প্রভাবিত হয়েছিল সারা বাংলা।

বৈষ্ণববাদী সহজিয়া

এই সহজিয়া ধর্মের মূল তত্ত্ব বোঝাতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে কিন্তু রাধারমণ দত্তকে নিয়ে কথা বলতে গেলে এই সহজিয়া ধর্মের কথা বলতেই হয়। তাই দুইটি সহজ ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। 

ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্তের ভারতকোষ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়া সম্প্রদায় পূর্ববতী বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের যুগোচিত বিবর্তন।

বৌদ্ধ সহজিয়ার মতো বৈষ্ণব সহজিয়াগণও বলিয়াছেন যে প্রত্যেক নরনারীর দৈহিক রূপের মধ্যেই তাঁহাদের স্বরূপ লুক্কায়িত আছে। নররূপে নর, স্বরূপে কৃষ্ণ, তেমনি নারী রূপে নারী, স্বরূপে রাধা। রূপ ছাড়িয়া স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে হইবে।

আবার গোপীনাথ কবিরাজের মতে, সহজ মানুষ হইবার সাধনা দুরূহ। সামান্য মানুষ সর্বত্রই আছে। কিন্তু সহজ মানুষ চৌদভুবনের কোথাও নাই, তাহাকে গড়িয়া নিতে হয়। গড়িতে হয় কি ভাবে? তাহা হয় রাগনুগা ভজনে। এই ভজনের একটি ক্রম বর্তমান। এই ক্রমের প্রথমটি প্রবর্ত অবস্থা। প্রবর্ত অবস্থায় প্রথমে নামকে আশ্রয় করিয়া সাধনা চলে।

তখন গুরুর আজ্ঞা পালন এবং অকৈতবা কৃষ্ণ প্রেম, সাধুসঙ্গ করিয়া চলিতে হয়, দ্বিতীয় অবস্থা সাধক অবস্থা। এ সময় আশ্রয় ভাব। তৃতীয় অবস্থা সিদ্ধ অবস্থা।

রাধারমণ দত্তের জীবনী

ইহার দুইটি আশ্রয়, একটি প্রেম, অপরটি রস। প্রবর্ত অবস্থায় ইন্দ্ৰিয় সংযম ও শৌচাদি আচরণ পূর্বক গুরুর নিকট হইতে নাম প্রাপ্ত হইয়া নাম এবং নামীয় অভেদ জ্ঞানপূর্বক তাহা অনুক্ষণ জপ করিতে করিতে অন্তর ও দেহের কলুষ নিবারিত হয় ও সাত্তিক বিকারাদির উদয় হইয়া থাকে।

সাধক অবস্থায় ভাবই আশ্রয়। এই অবস্থায় কামজয় একান্ত আবশ্যক। যখন কাম নিজের বশীভূত তখন নিজের ভাব অনুসারে নায়িকা গ্রহণ করিতে হয়।

সাধক অবস্থায় নিজেকে প্রকৃতি মনে করিতে হয়। কিন্তু সিদ্ধাবস্থায় নিজের প্রকৃতি ভাব সম্পন্ন হইয়া যায়, যাহার ফলে প্ৰেম সাধনায় অগ্রসর হইবার পথ খুলিয়া যায়।

রাধারমণ দত্ত এবং তাঁর দর্শন 

রাধারমণ দত্ত ছিলেন এই ভাবধর্মের অনুসারী। তাঁর গীতে বারবার শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার প্রেমমূর্তি ফুটে উঠেছে।

১৮৩৩ খিষ্ট্রাব্দে এক শুভক্ষণে তৎকালীন শ্রীহট্টে (বর্তমানে সিলেট) রাধামাধব দত্ত এবং সুবর্ণা দেবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এই গীতি জাদুকর।

রাধামাধব ছিলেন অত্যন্ত গুণী একজন ব্যক্তি ছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর তিনটি রচনাবলী রয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যেও কৃষ্ণলীলা কাব্য,পদ্মপুরাণ,সূর্যব্রতের গীত ইত্যাদি রচনাবলী দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

রাধারমণ দত্ত তাঁর বাল্য জীবন থেকেই প্রচন্ড তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছিলেন। তিনি কৌতুহলের বশে বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব ধর্মের চর্চা করেছিলেন।

কিন্তু এতে তাঁর মনে শান্তি আসে নাই। পরবর্তীতে তিনি সহজিয়া ধর্ম এবং তাঁর পিতার ভাবধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হোন।

রাধারমণ দত্তের জীবনী

৩৫ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় তৎকালীন শ্রীহট্টের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে গুণময়ী দেবীর সাথে। তবে তাঁর সংসারধর্ম খুব একটা সুখের হয়নি। ১৫ বছরের মধ্যে তিনি তাঁর স্ত্রী এবং চার পুত্রের তিন জনকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়েন।

চলে যান মৌলভীবাজার জেলার ঢেউপাশা গ্রামের সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের কাছে। এভাবেই তাঁর সাধনা শুরু করেন রাধারমণ। জগন্নাথপুর উপজেলার নলুর হাওরের পাশে একটি আশ্রমে বসবাস শুরু করেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর অমরত্বের পথে যাত্রা।

কৃষ্ণপ্রেমিক এই গীতিকবি যেভাবে রাধা-কৃ্ষ্ণ প্রেমের বিরহকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর গানগুলোর মাধ্যমে সেভাবে হয়তো কেউই আজ পর্যন্ত ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।

প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহের বেদনা যে কতটুকু বুকে আঘাত দিতে পারে তা তাঁর গান না শুনলে বুঝা যাবে না। একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। চেনা গান দিয়েই বুঝালে ভালো বুঝবেন।

“ভ্রমর কইয়ো গিয়া” গানে প্রতিটা বাক্যে শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার জন্যে রাধার আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। গানটির মূলকথাটি এমন যে, রাধা তাঁর কৃষ্ণ হারানোর বেদনা কারো কাছেই প্রকাশ করতে পারেন না। কিন্তু কাউকে না পেয়ে ফুলের ভোমরাকেই বলতে বাধ্য হোন তাঁর বেদনার কথা। যেন ভ্রমর শ্রীকৃষ্ণকে গিয়ে বলে, তাঁর বিচ্ছেদের ব্যথার কথা।

এও বলেন যে, তিনি কৃষ্ণহারা হয়ে মারা যাবেন। গানের মাধ্যমে বিরহ-ব্যথা এর থেকে ভালো ভাবে কিভাবে প্রকাশ সম্ভব?  

রাধা-কৃষ্ণের মিলনের এই অপূর্ণ বাসনা যে এর থেকে ভালোভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। হয়তো বিরহে তাঁরা অমর হয়ে আছেন।

সত্যিকার প্রেমিক-প্রেমিকারা হয়তো ইহজীবনে কখনো এক হতে পারেন নাই। রাধা-কৃষ্ণ,লায়লা-মজনু কিংবা রোমিও-জুলিয়েট, মৃত্যুতেই হয়তো তাঁদের এক হওয়া।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, রাধারমণ তাঁর জীবনে তিন হাজারের বেশি গান সৃষ্টি করেছিলেন কিন্তু তা পুথিবদ্ধ তিনি নিজে কখনোই করেননি।

 গান সংগ্রহ 

তাঁর গান শুনে তাঁর ভক্তরা গান পুথিবদ্ধ করে ফেলতেন। যে কারণে তাঁর বর্তমানে সব গান পাওয়া যায় না। গুরুসদয় দত্ত, নির্মলেন্দু ভৌমিক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, কেতকী রঞ্জন গুণ, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, হুছন আলী, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, নরেশ চন্দ্র পাল, যামিনী কান্ত র্শমা, মুহম্মদ আসদ্দর আলী, মাহমুদা খাতুন, ডঃ বিজন বিহারী পুরকাস্থ, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, মোঃ আজিজুল হক চুন্নু, জাহানারা খাতুন, নরেন্দ্র কুমার দত্ত চৌধুরী, অধ্যাপক সুধীর চন্দ্র পাল, অধ্যাপক দেওয়ান মোঃ আজরফ, নন্দলাল শর্মা, শামসুল করিম কয়েস, শুভেন্দু ইমাম-এরা সবাই রাধারমণের গান সংগ্রহ করেছিলেন সিলেটের বাড়ি বাড়ি ঘুরে।

অনেকে হয়তো জানেন না, রাধারমণ দত্ত এবং হাছন রাজা সমসাময়িক ছিলেন। তাঁদের মনের মিলের কারণে তাঁদের মধ্যে পত্রালাপ হইতো নিয়মিত।

তাঁরা কবিতার মাধ্যমে একে অপরের সাথে কথা বলতেন। একবার হাসন রাজা রাধারমণের কুশল জানতে গানের চরণ বাঁধেন : রাধারমণ তুমি কেমন, হাছন রাজা দেখতে চায়। উত্তরে রাধারমণ লিখেনঃ- কুশল তুমি আছো কেমন – জানতে চায় রাধারমণ

আমারে আসিবার কথা কইয়া মান করে রাই রইয়াছ ঘুমাইয়া- এ যেন চিরজীবনের অপেক্ষা। রাধার আসার আগ পর্যন্ত যে এই অপেক্ষা ফুরানোর নয়।

প্রেমের এক কঠিন সত্যের মুখে আমাদের বারবার ফেলেছেন রাধারমণ দত্ত। প্রেমে তো মানুষ অনেকবারই পড়ে কিন্তু প্রেমের বিরহ ব্যথা সহ্য করা ক্ষমতা কি আছে আমাদের?           

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top