অভিযাত্রী ডট কমে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে তরুণ লেখক মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল। আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(নবম কিস্তি)
সন্ধার দিকে রিচির ঘুম ভাঙলো। তার গায়ে কেমন শীত শীত লাগছিলো। সে চোখ না খুলেই পাশ থেকে কম্বলটা টেনে দিল গায়ে, ঘরটায় মৃদু আলো জ্বালানো বলে তার চোখে লাগছে না। খুব আরাম লাগছে। অনেকদিন এমন ঘুম হয়নি। এসি চলছিলো, তবে সাউন্ডলেস এবং ঘরের সব গ্লাস লাগানো বলে কোথাও কোন শব্দ নেই। ইংরেজিতে একে বলে পিনড্রপ সাইলেন্স।
রিচি চাইলেই এমন আরামে আরো ঘন্টা দুয়েক ঘুমাতে পারতো, ঘুমটা এখনো কাঁচা। কিন্তু কি ভেবে সে হুড়মুড় করে উঠে বসলো। আর ভয়ে হাপাতে লাগলো। সে মুহূর্তেই ঘরের চারপাশটা দেখে নিলো। এই ঘরে আগে কখনো আসেনি রিচি। কোনভাবেই সে জ্ঞান হারানোর পরের অবস্থা মনে করতে পারছে না।
গা থেকে কম্বলটা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। সোফার ওপর তার ভ্যানিটি ব্যাগ রাখা। ব্যাগের চেইন খুলে মোবাইলটা খুঁজলো, কিন্তু পেল না। তার শরীরের কোথায় যেন ব্যাথা করছে কিন্তু ধরতে পারছে না।
এমন সময় আমিন উদ্দিন রুমে ঢুকলো। তার চেহারায় কোন ভীতির ছাপ নেই। যেন বাড়িতে কিছুই হয়নি।
রিচি অনেকটা ধমকের সুরেই বলল, ‘আমি কোথায়? কোন রুম এটা।’
তার গলাটা কেপে উঠলো। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি, রুমে এসি চলছে এবং টেম্পারেচার অনেক কম।
আমিন উদ্দিন তার জবাব না দিয়েই বলল, ‘স্যার আপনারে ঘুম থেকে উঠলে যেতে বলেছে। আপনি গেলে আমি ঘরটা তালা দেব, তারপর চলে যাব। আমার ডিউটি টাইম অনেক আগেই শেষ।’
রিচি আবার চিৎকার করে বলল, ‘আমার মোবাইল কই, ফাজলামো হচ্ছে? আমি বাইরে যাবো। এখনি বাইরে যাবো।’
আমিন উদ্দিন এবারো কিছু না বলে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, সে মৌন ভাষায় বোঝাচ্ছে, আপনি বেরিয়ে গেলেই আমি খুশি।
রিচি ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। সে টের পাচ্ছে এতক্ষণ তার হাতেই ব্যাথাটা করছিল, সে আরো ভালোভাবে দেখতে গিয়ে দেখলো তার কনুইয়ের উল্টো পাশে সিরিঞ্জ পুশ করার দাগ। শরীরে খুব বেশি শক্তিও পাচ্ছিলো না সে।
রেজা খান ডাইনিং টেবিলেই বসা। রিচি অবাক হলো, তার ঠিক সামনের চেয়ারে তার মা বসে আছেন। তার গায়ে লাল রংয়ের একটা শাল। রিচি কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। তাকে দেখেই রেজা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমার বোধহয় ভালো ঘুম হয়নি। চাইলে তুমি আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে পারো। তোমার শরীর দূর্বল।’
রিচির মা আবেদা খানম চেয়ার ছেড়ে এসেই তার কাধে হাত রাখলেন। তার মুখেও তেমন শঙ্কা নেই, যেন কোথাও কিছু হয়নি বা হলেও সবাই তা খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে।
আবেদা কাধে একটা হাত রেখে বললেন, ‘এখন কেমন লাগছে? যেতে পারবি তো? আমি সিএনজি ডেকে আনি, তুই বোস।’
রিচি কিছুক্ষনের জন্য চুপ হয়ে গেল। রেজা খান খুব সময় নিয়ে জুস খাচ্ছেন। রিচি মাকে বলল, ‘যাও সিএন জি ডাকো, আমি আসছি।’
রেজা শুনেই বললেন, ‘মিসেস খানম, আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, সে ড্রপ করে দিয়ে আসবে। আপনি উতলা হবেন না প্লিজ। বরং আপনি এক কাপ কফি খান।’
আবেদা হাসিমুখে বললেন, ‘এখন আর কফি খাবো না। আপনি বরং ড্রাইভারকে বলুন, আমরা যাই। এমনিতেই ওর ওপর দিয়ে খুব ধকল গেছে, ওকে এখন বাসায়ই নিয়ে যাই।’
রেজা মুচকি হাসলেন। তারপর ফোন থেকে ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি বের করতে।
আবেদা বাইরে গেলেন। রিচি একদৃষ্টিতে রেজার দিকে তাকিয়ে আছে, রেজা সেটা টের পেয়েও তার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘রিচি, বোসো।’
রিচি চাপা গলায় বলল, ‘আপনি কি করে ভাবলেন, এরপরেও আমি আপনার সাথে এক টেবিলে বসবো?’
রেজা আবার মুচকি হেসে জুসে চুমুক দিলেন।
‘ডাক্তার বলেছে, তোমার শরীর দূর্বল। হাই প্রেসার। তোমার এক্সাইটেট না হওয়াই ভালো।’
‘মানে কি? বলুন আপনি কি করেছেন? বলুন আমি এতক্ষণ ধরে ঘুমিয়ে ছিলাম কেন? আপনি আমার মা কে কি বলেছেন, বলুন।’
‘আমি আপাতত তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব না। দিলে হয়তো তুমি আর আসবে না। কিন্তু আমি চাই তুমি জবটা কন্টিনিও কর।’
‘আশ্চর্য। আপনি কি করে ভাবলেন আমি আপনার চাকরি করব আরো। আপনার মত একটা….ছিঃ। লজ্জা করলোনা আপনার? মেয়ের বয়সী একজনের সাথে….ছিঃ’। রিচির মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে। তার বোধহয় উত্তেজিত না হওয়াই ভালো ছিল। সে আর কিছুক্ষনের মধ্যেই বোধহয় আবার মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু তার তো জানতেই হবে রেজা খান তার কোন ক্ষতি করেছে কিনা।
রেজা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই রিচি বলল, ‘খবরদার, আপনি আমার কাছে আসবেন না।’
‘আমি তোমার কাছে আসবো না। তোমার চেঁচামেচি করার মত কিছুই হয়নি। তুমি যদি রেপড হতে তবে কয়েক ঘন্টায় সুস্থ হতে পারতে না। সো তুমি এই ব্যাপারে শিউর থাকতে পারো।’
রিচির চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। তার নিজেকে এমন অসহায় কোনদিন লাগেনি। আবেদা আবার এসে রিচিকে দরজা থেকে ডাক দিলেন, ‘কি ব্যাপার তুই কাঁদছিস কেন? গাড়ি বের করেছে, মা চলে আয়।’
রিচি দরজার দিকে পা বাড়ালো। তার যেন পা আর চলছেই না। রেজা খান তার দিকে এতদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রিচি সব কিছু কেমন ঘোলা দেখছে আবার। সে কোনরকম তার মায়ের হাতটা ধরে তার উপর ভর দিয়ে বের হয়ে গেল। পেছন থেকে রেজা আর ডাকলেন না। তার বলতে মনে নেই, রিচির মোবাইলটা তার মায়ের কাছেই আছে।
রিচি বাসায় গিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার আবার ঘুম পাচ্ছে। সে তবু জেগে থেকে ভাবার চেষ্টা করলো। তার এখনো কিছুই মনে পড়লো না। আবেদা কাপড় না ছেড়েই রিচির রুমে এলেন। ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘তুই এত সেনসিটিভ, আমি ভাবতেই পারিনি। রেজা সাহেব ভদ্রলোক আমাকে সব বলেছেন।’
রিচি চমকে গেল। ‘কি বলেছে সে?’ রিচি মায়ের হাত চেপে ধরেছে।
‘বলেছে সে তোকে ভয় দেখিয়েছিল, ভাবতে পারেনি তুই এভাবে সেন্সলেস হয়ে যাবি।’
‘তুমি জানো, সে আমাকে কি করেছে। জানো না মা। আমি তোমাকে জানাতেও পারবো না। আমার খুব লজ্জা করছে মা।’ বলেই সে কেঁদে দিলো। আবেদা রিচির মুখটা তার কোলের কাছে এনে মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন।
‘আমি তোকে এর চেয়েও অনেক শক্ত থাকতে দেখেছি। তুই এমন কান্নাকাটি করছিস কেন?’
‘আমি বলতে পারবো না মা। আমি বলতে পারবো না।’
‘কান্না বন্ধ কর। রেজা আমাকে সব বলেছে।’
রিচি কিছুটি থমকে গেল। তার মনে হল সে কোন কিছু ভুল শুনেছে। আবেদা আর কোন কথা বলছেন না। রিচি মুখ তুলে আবেদার দিকে তাকালো। তারপর বলল, ‘মা, তুমি উনাকে নাম ধরে ডাকলে যে। তুমি আগে থেকেই চেনো?’
আবেদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হ্যা চিনি, তোর জন্মের আগে থেকেই চিনি।’
রিচি অনেকটা বোবার মত তাকিয়ে আছে আবেদার কথা শুনতে, কোথেকে কি সব হয়ে যাচ্ছে সে যেন মেলাতে পারছে না কিছু । কেমন তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।
‘আমার জন্মের আগে থেকেই চেন? কিভাবে? কোনদিন বলনি তো? আর আমিতো তোমাকে কোনদিন বলিনি তার কথা।’ রিচি বিছানায় উঠে বসলো। তার মাথা ব্যথাটা বেড়ে গেছে, মনে হচ্ছে ছিড়ে বের হয়ে যাবে সব।
আবেদা রিচির চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘রেজা আমার ক্লাসমেট ছিল। আর আজকের ঘটনাটা আমি আগে থেকেই জানতাম কি ঘটবে।’ রিচি অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যেন অন্য গ্রহের কারো ভিন্ন ভাষার কিছু শুনছে।
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি