মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | সপ্তদশ কিস্তি | অষ্টাদশ কিস্তি | উনবিংশ কিস্তি | বিংশ কিস্তি |একুশতম কিস্তি | বাইশতম কিস্তি | তেইশতম কিস্তি | চব্বিশতম কিস্তি | ২৫’শ কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(২৫’শ কিস্তি)
পুকুরের হাঁসগুলো উঠে আসছে। তবে ঘাটে দাঁড়ানো দুজন মানুষ তাদের পথে বাধার সৃষ্টি করছে বলে তারা যে পথ দিয়ে নেমেছিল সে পথ দিয়েই উঠে গেল। রিচি জানে সাদমান যে কাজটি করেছে সেটা তার জন্যই করেছে। কিন্তু এখন কেউ তার জন্য কিছু করলে রিচি সেটা পছন্দ করে না । বরং তার সাথে এমন দূর্ব্যবহার করে যেন তার জন্য ভবিষ্যতে আর না করে এমন। সাদমান বুঝতে পারছেনা রিচির এখানে এতটা চটে যাবার কারন কি।
‘আপনি শুধু ওদের চড়ই মারেন নি, একজনকে ফেলেও দিয়েছেন।’ রিচি এক পা এগিয়ে সাদমানকে বলল।
‘হ্যা, ফেলেছি। আর আপনি বসে বসে সেটা দেখে আমাকে বাধাও দেননি।’ সাদমান গরমে ঘেমে তাকিয়ে আছে রিচির দিকে।
‘আশ্চর্য, আমি কিভাবে? আমার শরীরের অবস্থা..’
‘হ্যা, আমি জানি আপনার শরীরের অবস্থা ভাল না, তাই ফার্মেসীর কাছে আমি ওয়েট করতে চেয়েছিলাম। আপনি সেখানেও..’
‘আপনি ছেলেগুলোর গায়ে হাত তোলার আগে অন্তত একবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন। ওরা আমাকে রিক্সায় তুলে পেছন পেছন গাড়ি পর্যন্ত দিতে এসেছে যেন সেফ থাকি আর আপনি? আপনি ওদের মারলেন..আই জাস্ট..’
‘শুনুন, এটা আমার ভুল মানছি, কিন্তু আপনি এখন ওভার রিয়েক্ট করছেন।’
‘আমি ওভার রিয়েক্ট করছি?’ রিচির কন্ঠে ক্ষোভ।
‘হ্যা, করছেন।’ সাদমান চলে যেতে চাইলো।
পেছন থেকে রিচি আবার কথায় আটকে দিল, ‘বাই দ্য ওয়ে আপনি কি আমাকে ইম্প্রেস করতে চেয়েছিলেন, আই মিন ছেলেগুলোকে মেরে হিরো সাজতে চেয়েছিলেন?’
‘কিহ? আপনার কি মাথায় সমস্যা? আপনাকে আমি কেন ইম্প্রেস করতে যাবো?’ সাদমানের গলা চড়ে এল।
এমন সময় আবার ঘাটের উপর থেকে বাচ্চা মেয়েটির আওয়াজ কানে এল দুজনের, ‘আয়ে না ক্যান, খাইবার ডাহে তো।’
বলে মেয়েটি হেসেই আবার দৌড়, যেন একটু দাঁড়ালেই তাকে কেউ ছুঁয়ে ফেলবে। সাদমান আরেকবার বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে চলে এল। রিচি ঘাট থেকে পুকুরের দিকে তাকালো, সেখানে আবার শ্যাওলা জমে গেছে। হাঁসগুলোর প্যাক প্যাক আওয়াজটাও নেই। হুট করেই পুকুরটা কেমন নিরব হয়ে গেল কথাহীন বইয়ের পাতার মত। রিচির মনটা সকাল সকাল খারাপ হয়ে গেল।
মেম্বার সাহেবের নাম নিয়াজ মোল্লা। বয়স খুব বেশি না, চল্লিশ হয় নি এখনো বোঝাই যায়। নিয়াজ মোল্লার বাবা মোকারম মোল্লা ছিলেন তিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, তুমুল জনপ্রিয় আর বাঘা লোক।
তার সময়ে নির্বাচনে বিপক্ষে কেউ দাঁড়াতেই সাহস পেত না। সেই হিসেবে বাবার তুলনায় ছেলের অবনতিই হয়েছে। তিনবার নির্বাচন করে প্রথম দুইবার ফেল, এবার পাস করেছেন কোনরকমে, খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে। রিচি আর সাদমান কে এসব তথ্য অবশ্য মেম্বার নিজেই দিচ্ছেন।
খাবার টেবিলে বসে আছে মেম্বার আর তারা দুজন, আর মেম্বার সাহেবের স্ত্রী জেবুন্নেসা খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন।
রিচি এক পিস পরোটা আর কুমড়া ভাজি খেয়ে উঠে যেতে চাইলো, তার কোন কিছুই ভাল লাগছে না। কিন্তু না ওঠে বসে রইলো কেন যেন।
নিয়াজ রিচির দিকে তাকিয়ে টের পেলেন সে প্লেটে দূর্বোধ্য কোন চিত্রাঙ্কন করছে। তিনি সৌজন্যতা নিয়ে বললেন, ‘আপনার শরীরটা কি এখন ভাল? মানে জেবু বলছিলো অনেক দূর্বল নাকি!’
‘না, আমি এখন আমি ঠিক আছি। কাল আসলে হঠাৎ অনেকদিন পর বাইরে এসে, পানি ধরে ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছি। তাই হয়তো এমন লাগছিলো।’ রিচি একটু পানি খেয়ে নিলো।
‘তবু, আপনারা আমার মেহমান, এইখানে আইসা যদি অসুস্থ হয়া যান তাইলে আবার রেজায় কি বলবে।’
‘না না, রেজা স্যার কে আমরা কিছু বলিনি। আর উনার এখন এসব নিয়ে ভাবার মত সময় আছে বলে মনে হয় না।’ সাদমান এক নিঃশ্বাসে বলে গেল। রিচি কথায় কিছুটা অপমানিত হল বলেই মনে হল।
নিয়াজ সেটা দেখে একটু মুচকি হাসলো।
‘আপনারা রেজার অফিসে কতদিন ধইরা আছেন?’
সাদমান বলল, ‘আমি এই অফিসে আছি মাস দুয়েক, কিন্তু আগে থেকেই স্যারের কাজ করি প্রায় বছর পাঁচেক।’
‘গুপ্তচরের কাজ, তাইনা?’ কথার মাঝে ফোড়ন কাটলো রিচি। নিয়াজ আর জেবু কিছুটা অবাক, সাদমান একবার রিচির দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না। তবে তার তাকানোতে রাগের ভাব স্পষ্ট। আর রিচিকে দেখা গেল প্লেটে রাখা তরকারিতে মনোযোগ দিতে, যেন হঠাৎ সেটার স্বাদ বেড়ে গেছে।
‘জেবু, উনাকে আরেকটু ভাজি দাও। রুটি কই, রুটি দাও আরে দুইটা।’ সাদমান কে দেখিয়ে বললেন নিয়াজ। সাদমান কোন রকম প্লেট সরিয়ে বাঁচলো, ‘আর না, তিনটা খেয়েছি অলরেডি।’
তার মোটামুটি ভালই খাওয়া হয়েছে। রিচি উঠে চলে গেল।
পরিবেশ কিছুটা ভারী, সাদমান সেটাকে হালকা করতে বললো, ‘স্যারের সাথে আসলে আপনার সম্পর্কটা কি?’
নিয়াজ মোল্লাকে এবার কিছুটা শান্ত মনে হচ্ছে। এই প্রশ্নটা তার জন্য মনে হয় কিছুটা কঠিন হয়ে গেল। জেবু কোন কথা না বলেই খাবারের প্লেটগুলো নিয়ে চলে গেলেন।
‘আপনার কয়দিন আছেন? মানে, যে কাজে আসছেন কেমন সময় লাগবে?’ নিয়াজ জিজ্ঞেস করলো।
সাদমান পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমরা সাদাত সাহেবকে পেয়ে গেলে দুদিনের মধ্যে চলে যাব, আর দেরি হলে স্যার কি বলে সেটার ওপর আসলে..।’
‘বুঝতে পেরেছি, খুঁজে পাওয়াটাই আসল ব্যাপার।’
‘হ্যা, আসলে স্যার নিজের সোর্সে চেষ্টা করেছে, কাজ হয় নি। ইরাজের কোন খোঁজ নেই, একদম লাপাত্তা। আপনাকে ক’দিন একটু আমাদের হেল্প করতে হবে।’
কথাটা শুনেই হাসিতে ফেটে পড়লেন নিয়াজ, ‘হেল্প? আমি আপনার স্যারের জন্য জীবনও দিতে পারি।’
রেজা আলীর সাথে সম্পর্কের কথাটা কেন কাটিয়ে নিয়াজ মোল্লা অন্য প্রসঙ্গে নিলো সেটা সাদমান বুঝতে পারলো না। রেজা আর নিয়াজের সম্পর্কটা মামা-ভাগ্নের এটা সাদমান শুনেছে, কিন্তু বিষয়টা পরিস্কার না। কারন, রেজা আলীর কোন বোন নেই। তার চেয়েও বড় কথা, তাদেরকে দূর সম্পর্কের একটা আত্নীয়ের বাড়িতে পাঠানোর বিষয়টা অদ্ভূত, চাইলেই কোন হোটেলে থেকে ইনফরমেশন নেয়া যেতো।
নাস্তার টেবিল থেকে উঠে বের হবার পর যে জিনিসটা সাদমানকে সবচেয়ে চিন্তায় ফেলে দিল সেটা হচ্ছে, ড্রাইভারকে আশপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সে নাশতা খেয়েছে আগেই, কিন্তু ঘুম থেকে উঠার পর সাদমানের সাথে তার দেখা হয় নি আজ। এদিকে রিচি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।
কাজটা কিভাবে এগুবে সেটা বুঝতে পারছে না সাদমান। রেজা আলী কে এখনি কিছু জানানো যাবে না। সাদমান নিজের ঘরের দিকে হাটা দিল, পেছনে আরেকজনের পায়ের আওয়াজ পেল সে। পেছন ফিরতেই দেখে বাচ্চা মেয়েটা। মুখে আঙুল দিয়ে সে একমুহূর্ত তাকালো, সাদমান তাকাতেই সে আবার দৌড় দিল।
নিয়াজ মোল্লার বাড়ির বাকি লোকদের ব্যাপারে জানা হয় নি, জানার আগ্রহও কম। কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েটি সত্যিই দারুন, খুব চঞ্চল আর লাজুক। তবে নিয়াজ সন্তানাদি আছে বলে মনে হয় না, থাকলে সে নিজেই হয়তো জানাতো।
আকাশের অবস্থা ভাল নেই। হালকা মেঘ, তবু যেন পুরো সূর্যটাকে ঘিরে রেখেছে। রিচি কাঠের জানালাটা খুলে তাকালো বাইরে। শহর আর গ্রামের আকাশ তো একই, তবু এই আকাশ তার কাছে অচেনা লাগছে তার কাছে। এই নীল রংটা তার হুড খোলা রিক্সায় চড়ে বেড়ানো দিনগুলোর আকাশের নীলের মতই লাগছে।
আকাশ তো একই থাকে, মানুষের মনের রংটাই বদলে যায়। এই যেমন রিচির টা বদলে গেছে। কয়েক বছর আগেও সে আয়োজন করে আকাশ দেখতে উঠতো ছাদে, রিক্সায় কিংবা কার্জন হলের সামনের ঘাসটায় শুয়ে। এখন আর হয় না তেমনটা। সাদমানের সাথে তার ব্যবহারটা বেশি বাজেই হয়ে গেছে। ছেলেটা আসলে কেমন, সে বুঝতে পারছে না।
মেয়েদের মত রহস্যময় ছেলে রিচির পছন্দ নয়। ছেলেরা থাকবে ঝর্ণার পানির মত স্বচ্ছ, চাইলেই একটা মন খারাপ করা বিরহী মেয়ের মন যেন তাতে অনায়াসে ডুবে যেতে পারে। সাদমানের মন তেমন নয়। অনেকটা এই গ্রামের আকাশের মত।
কয়েক মিনিট দমকা হাওয়ার পরেই সে হাওয়া থেমে গেল, নেমে গেলো বৃষ্টি। ফাল্গুনের শুরুর বৃষ্টির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিচি। তার চোখ গেল উঠানটায়, সেখানে একটি ছেলে আর একটি বাচ্চা মেয়ে ভিজছে আর মজা করে দৌড়াদৌড়ি করছে।
ছেলেটি সাদমান আর বাচ্চা মেয়েটি যেন তার সাগরেদ। তারা দুজন কি আনন্দ নিয়েই না বৃষ্টি বরণে মেতেছে, সেদিকে তাকিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো রিচির চোখে।
(চলবে)