ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল- মারুফ ইমন | ২৪’শ কিস্তি

যখন থামবে কোলাহল

মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:


আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | সপ্তদশ কিস্তি | অষ্টাদশ কিস্তি | উনবিংশ কিস্তি | বিংশ কিস্তি |একুশতম কিস্তি | বাইশতম কিস্তি  | তেইশতম কিস্তি | ২৪’শ কিস্তি  


যখন থামবে কোলাহল

(২৪’শ কিস্তি)


কলমিকান্দার মত গ্রাম এলাকায় ‘বেড টি’ পাওয়াটা সৌভাগ্যের চেয়েও বড় কিছু।

সাদমান আজ তেমন সৌভাগ্যবান বলাই যায়। সকাল সকাল তার রুমে এসে একজন চা দিয়ে গেল। যদিও চিনি আর লিকারের উপস্থিতি খুবই অবিবেচিত, তবু মন্দ লাগেনি খেতে। সাদমান আর রিচি যে বাড়িটায় উঠেছে সেটা পাগলা এলাকা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে।

এলাকার মেম্বারের বাড়ি, যথেষ্ট আলিশান। এমন প্রত্যন্ত জায়গায় এমন বাড়ি পাওয়া যাবে সেটা সাদমান বা রিচি কেউই ভাবেনি। মেম্বার সাহেব রেজা খানের কি যেন দুঃসম্পর্কের ভাগ্নে হয়, তাই আসার কথা আগেই বলা ছিল। রাতে এসে পৌছতে  প্রায় বারোটা বেজে গেলো।

এখানে গাড়িতে আসার ইটের রাস্তা আছে, তবে সেটার অবস্থা খুব দূর্বিষহ। সন্ধ্যার ঘটনা আর সারাদিনের ভ্রমন ক্লান্তির পর রাতের ঘুম বেশ ভাল হয়েছে সাদমানের। রিচি এখনো ঘুমুচ্ছে । সে রাতে কিছু খায়নি। সাদমান বিছানা ছেড়ে অনেকটা ধ্যান ধরেই বসে আছে মিনিট পনের হল। ঘরের জানালা দিয়ে বাধানো পুকুর ঘাটটা দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা হাস ডাকতে ডাকতে সেই ঘাট দিয়ে নেমে গেল পানিতে। একটু দূরে শোনা যায় গরুর ডাকও। মনে হয় এ বাড়িতে গৃহপালিত পশুপাখির সংখ্যা ভালই আছে। 

সাদমান চা খেয়ে রুম থেকে বের হয়ে পুকুরঘাটের দিকে গেল হাটতে হাটতে। পুকুরের পানি একটু লালচে। এক ধরনের প্রাকৃতিক ছত্রাকের জন্য পানির রংটা এমন হয়ে যায়। নাড়া দিলে সেটা সরে যায়, আবার পরে কচুরীপানার মত জমে যায়।

সাদমান ঘাটের উপরের দিকে চেয়ারের মত করে রাখা জায়গাটাতে বসলো। আশপাশে তাকালো, তবে বাড়ির লোক কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। বোধহয় তারা বাড়ির ভেতর দিকে। সাদমানদের গাড়িটা রাস্তার পাশে একটা চালা ঘরে রাখা, আগে এটা গোয়াল ছিল বোঝাই যায়, তবে এখন ফাঁকা। এখান থেকে গাড়িটাও দেখা যাচ্ছে।

পুকুরের দিকে কিছুক্ষণ তাকাতেই সাদমানের মনে পড়লো গতকালের সন্ধ্যার কথা। প্রায় আধঘন্টার বেশি খোঁজাখুঁজি করেও যখন বাজারের ভিড়ে রিচি কে পাওয়া গেল না, সাদমানের তখন মাথাখারাপের মত অবস্থা। শেষ কবে সে এমন ভয় পেয়েছে মনে পড়ে না।

প্রথমত, রিচি একটা মেয়ে মানুষ তার উপর অচেনা জায়গা, তাকে কয়েকটা ছেলেও ফলো করছিল। আশপাশের গলি, বাড়ি, বাজারের ভেতর কোন জায়গা বাদ দিল না সে। শেষমেশ কোথাও না পেয়ে দাড়িয়ে ছিল সেই ফার্মেসির সামনেই, যদি আবার রিচি সেখানেই ফিরে আসে সে আশায়। সে ভাবছিল রেজা খানকে এবার জানানো দরকার। 

খানিক বাদেই ড্রাইভারের ফোনটা আসলো। তখন তার রক্ত আরো হিম হয়ে গেল। ফোন ধরতেই ড্রাইভারের মোটা গলার আকুতি শোনা গেল,

‘স্যার, আপনে গাড়ির কাছে আসেন, তাত্তাড়ি। ম্যাডাম তো..আইসা..নড়ে চড়ে না।’

সাদমান আর কিছু জানা দরকার মনে করেনি। দৌড়ে গাড়ির কাছে গেল দু মিনিটেই। গিয়েই তার চোখ পড়লো সেই বখাটে ছেলেগুলোর ওপর, তারা গাড়ির পাশে দাড়িয়ে ছিল গোল হয়ে। পাশে মাটিতে পড়ে আছে রিচি, তার চোখ বন্ধ আর ড্রাইভার তাকে উঠানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, কাউকে সে হাত দিতে দিচ্ছে না।

সাদমানের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। যা বোঝার সে বুঝে নিলো কয়েক সেকেণ্ডেই।  গিয়েই ছেলেগুলোর একজনের কলার ধরে টান দিয়ে দিল কষে থাপ্পড়। ছোটখাটো একটা জটলা হয়ে গিয়েছিলো সেখানে, সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় একদম চুপ। এরমধ্যে রিচি উঠে বসেছে গাড়ির ব্যাকসিটে।

‘কুত্তার বাচ্চারা, মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, না?’ সাদমান আরেকজনকে ঠেলা দিয়ে প্রায় ফেলে দিল মাটিতে।

ড্রাইভার এসে তাকে টানতে লাগলো,‘থাক স্যার, চইলা আসেন। ওগোরে মাইরা লাভ নাই। ম্যাডাম ঠিক আছে এহন। চইলা আসেন।’

সাদমান মুহুর্তের মধ্যে তাকিয়ে দেখলো গাড়ির ভেতর চোখ মেলে বসে আছে রিচি। এরমধ্যে চড় খাওয়া যুবকদের হুশ ফিরে এসেছে। মুহূর্তেই কেন যেন সাদমানের মনে হল, যে কোথাও একটা ভুল করে ফেলেছে। ছেলেগুলো যদি রিচির কোন ক্ষতিই করে তবে তাকে গাড়ির কাছে নিয়ে আসবে কেন !

আবার মনে হল, সে যার গায়ে হাত তুলেছে তারাই এলাকার ছেলে আর সাদমান বাইরের লোক, মানে বড় ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। রাতও হয়ে যাচ্ছে, ড্রাইভারের মুখ গলা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। সাদমান তাকে একটা ইশারা দিল, ড্রাইভার সেটা ধরতে পারলো।

একটা স্টার্ট, একটা হর্ণ আর সাদমানের সেকেণ্ডের মধ্যে গাড়িতে উঠে পড়া এই তিনটি ঘটনা একসাথে হল। ছেলেগুলো কোথা থেকে কয়েকটা ইট পাটকেল ছুড়তে লাগলো, একটা ইটের টুকরো এসে লাগলো হেডলাইটে। কোনরকমে হাট পেরিয়ে গাড়িটা বাইপাসের দিকে চলে এল দ্রুতবেগে।

রিচি অনেকটাই দূর্বল হওয়ায় কোন কথা বলল না গাড়িতে, সে আবার চোখ বুজে ফেলল। সাদমান শুধু একবার জিজ্ঞেস করলো,

‘হাসপাতাল নিয়ে যাব? ঠিক আছেন?’

রিচি চোখ বুজেই বলল, ‘আমি ঠিক আছি এখন।’

মেম্বার সাহেব কাঁচারাস্তার মাথায় দাড়িয়েই ছিলেন। এ বাড়ির মেয়েরা ধরাধরি করে নিয়ে এল রিচিকে। মাথায় পানি ঢালার পর কয়েকটা কি যেন ট্যবলেট খেলো রিচি, তারপর ঘুম। তবে সাদমানের বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল। ড্রাইভার এরমধ্যে একদফা খেয়ে নিয়েছে। টেবিলের সামনে গিয়ে সাদমানের চোখ ছানাবড়া। পিঠা, শরবত, ভাত তিনধরনের খাবারই ছিল। সাদমান কয়েক পিস পিঠা আর একগ্লাস শরবত খেয়েই উঠে পড়লো, মেম্বার সাহেবের অনুরোধ কাজে লাগলোনা।

‘আপনেরে খাইতে ডাকে।’ পেছন থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের মত কণ্ঠ শুনে হঠাৎ চমকে উঠলো সাদমান। তাকাতেই দেখে একটা মেয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। হয়তো বাড়ির কেউ হবে। সকালের খাবারের জন্য সময় একটু বেশিই হয়ে গেছে। হয়তো তার ঘুম থেকে উঠার জন্য অপেক্ষা করছিল, তাই ডাক দেয়নি।

ঘাটের ঠিক পাশ দিয়ে পুকুরে এর মাঝে একটা হাসের পাল নেমে প্যাক প্যাক শব্দ করছে। সাদমান খেয়াল করলো, ঘাটে  সে একটা মানুষ বসে আছে এটা তারা খেয়ালই করলো না। হাসের পালে একটা গোদা থাকার কথা, সবাই তার কমান্ড মেনে চলে। পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণীই তাদের দল মেনে চলে, কমান্ড মেনে কাজ করে। মানুষের মাঝে স্বভাবতই এই গুনটি নেই। ডিফেন্স এর কিছু লোক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা বাদে দেখা যায় না বললেই। তবে সেখানেও যার যার অনুসরণ বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত। সবার ধারনা একা চললে সবাইকে তার প্রাপ্যতার ভাগ দিতে হবে না । অথচ সামান্য হাসের পালেও খাবার ভাগ করে খাওয়ার একটা দারুন বিষয় থাকে। 

সাদমান উঠে দাঁড়াতেই দেখে রিচি এসে দাঁড়িয়েছে। সে যে ড্রেসটা পড়েছে সেটা যথেষ্ট পাতলা, শরীরের কিছু অংশ অনিচ্ছায় চোখে পড়ছে। হয়তো ঘুম থেকে উঠে আর বদলায়নি। তবে তাকে ঘুম ভাঙার পর অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। সাদমান অস্বস্তি আর  মুগ্ধতা দুটি নিয়েই তাকালো, এই অনুভূতির কি নাম সে জানে না।

‘গুড মর্নিং’ সাদমান একটু মুচকি হাসলো। ‘ঘুম কেমন হল?’

‘হু, ভাল। আপনি এখানে কি করছেন? আমাকে ডাকেননি কেন?’ রিচির কন্ঠে কিছুটা অনুযোগ।

‘আমি, ডাকবো। মানে..আপনি ঘুমাচ্ছিলেন।’

‘হ্যা, তো? আমরা কি এখানে পিকনিক করতে এসেছি? কাজে এসেছি, কাজ করে চলে যাব।’ রিচি একদমে বলে যাচ্ছে। সাদমান কিছুই বুঝতে পারছে না।

‘আপনি এভাবে রেগে যাচ্ছেন কেন?’

‘আমি রেগে যাচ্ছি না।’

‘আমরা কাজে এসেছি সেটা আমি জানি, কিন্তু কাজের অগ্রগতি জানেন না।’

‘মানে?’

‘মানে, আমি রাতেই মেম্বার সাহেবকে বলে মি. সাদাতের এলাকার খোঁজ নিতে দুজন লোক লাগিয়ে দিয়েছি। তারা দুপুরের মধ্যে আমাকে জানাবে, তারপর আমরা স্যারের সাথে কথা বলে আগাবো। আপানাকে সেটা বলার আগেই আপনি ঘুমিয়ে গেছেন। সেক্ষেত্রে আমার রাগ করার কি একটু যৌক্তিকতা বেশি না?’

রিচি কথা আর কথা না বলেই চলে গেল। সাদমানের মেজাজ বিগড়ে গেল। সকাল সকাল এমন ঠান্ডা মেজাজ বিগড়ে যাবার অর্থ সারাদিন খবর আছে। সাদমান এজন্যেই মেয়ে কারো সাথে আসতে চায়নি। শর্ট টেম্পারড লোক নিয়ে এসব কাজ করা যায় না, লাগে ঠান্ডা মাথার লোক। সাদমান ঘাট থেকে নামতে গিয়ে দেখে রিচি আবার তার দিকে আসছে।

‘আপনি না জেনেশুনে কাল ছেলেগুলোকে মারলেন কেন ?’ রিচির কন্ঠে যেন আগুন।

‘ওয়েট ওয়েট, মারলাম কই! একজনকে একটা চড় দিয়েছি মাত্র।’

রিচি অবাক আর রাগ একসাথে নিয়ে তাকালো এবার সাদমানের দিকে।


(চলবে)

উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি চতুর্দশ কিস্তি পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | সপ্তদশ কিস্তি | অষ্টাদশ কিস্তি | উনবিংশ কিস্তি | বিংশ কিস্তি |একুশতম কিস্তি | বাইশতম কিস্তি  | তেইশতম কিস্তি | ২৪’শ কিস্তি

  

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top