মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | সপ্তদশ কিস্তি | অষ্টাদশ কিস্তি | উনবিংশ কিস্তি | বিংশ কিস্তি | ২১’শ কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(২১’শ কিস্তি)
সাদমান আর রিচি যখন গফরগাঁও এসে পৌছলো তখন সন্ধা হয়ে গেছে।
মাগরিবের আযান হয়েছে খানিক আগে। এতটা দেরি হয়তো হত না রিচি খালপাড়ে এতক্ষণ বসে না থাকলে। কি এক অজানা কারনে সে নির্বাক বসেছিল আর একটু পরপর পানি হাতে নিয়ে ফেলছিল। সাদমান তাকে বিরক্ত করতে চায় নি। হয়তো পুরনো কোন কথা ভেবে চুপ ছিল না হয় নিজেকে এতটা এতটা একা পেয়ে কিছু প্রশ্নোত্তর সেরে নিচ্ছিল রিচি।
সাদমান এসবের ঠিক হেতু বুঝে না। তার জীবন আলিশান কোন বাড়ির তকতকে টাইলসে মোড়ানো মেঝের মত ফ্ল্যাট, যার উপর দিয়ে হেটে যায় অনেক মানুষ তাতে কিছু যায় আসে না। সহজে কোনকিছু তেমন দাগও কাটেনা।
মানুষ দিনশেষে একা- এই কথাটি সাদমান বিশ্বাস করে না। তার কাছে মানুষ পুরোটা দিনই একা। পরিবার, সঙ্গী সাথীরাও এক একজন নিজের মত একা। একা মানুষগুলো একসাথে হলে কিছুক্ষণের জন্য তারা ভুলে থাকতে চায় তারা একা। তবে এটা স্থায়ী কিছু না। অথচ এই অস্থায়ী কিছুর জন্যই মানুষ এত আয়োজন করে দোকা হয়, বিয়ে করে ইত্যাদি।
কিন্তু রাতে পাশেরজন ঘুমিয়ে গেলে সে ভাবে, সারাদিন আসলে কতটা সে এই পাশের মানুষের মনজুড়ে ছিল বা থাকতে পারে? কারণ ঘুম ভেঙে গেলে যে একটা মানুষের আর ঘুম হয় না, সে সহস্র রাত জেগে কাটিয়ে দেয় তা কি পাশের মানুষটি ধরতে পারে নাকি সেটা শুধুমাত্র ‘ইনসমনিয়া’বলে কাটিয়ে দেয়।
মানুষের ঘুম আনার জন্য যদি ঘুমের ওষুধ লাগে তবে পাশের মানুষের কি দরকার। সাদমান ভাবে, তাহলে বছরের পর বছর এই স্বামী স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয়ের পুরস্কার কি? বুড়ো বয়সের অবলম্বন নাকি শুধু বংশবৃদ্ধি করে জাতে উঠা?
গাড়িটা এসে ব্রেক করায় সাদমানের এসব ভাবনাতে ছেদ হল। রিচি আবার ঘুমিয়ে ছিল, সেও উঠে বসেছে। গাড়িতে একটা মানুষ এত ঘুমুতে পারে তা সাদাতের জানা ছিল না ।
‘আমরা কি এসে গেছি?’ রিচি একটা হাই তুলে ড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলো।
‘ম্যাডাম, টাউনে আসছি, গেরামে ঢুকতে আরো মিনিট বিশ লাগবো, আমিও ম্যালাদিন পরে আইলাম এইদিকে। রাস্তা কিছুটা ভুইলা গেছি, জিগাইয়া যাইতে হইবো।
‘বলেন কি?’ কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে বলল সাদাত।
‘টেনশন লয়েন না। এইখানে আইজকা মনে হয় হাটবার, অনেক ভীড়। পুরা হাট পার হইতে ম্যালা সময় লাগবো। আপনেরা কিছু খাইয়া লন, কিছু লাগলে কিন্যা লন।’ ড্রাইভার আয়েশি ভঙ্গিতে বলল।
রাস্তা না চিনলে ড্রাইভারদের কয়েকজন পৈশাচিক মজা পায়, কেননা গাড়ির কেউ রাস্তা চেনেনা, কারও খবরদারি করার সুযোগ নাই। সে যেভাবে খুশি নিয়ে যাবে, তার ওপর ভরসা করে বসে থাকতে হয় দাঁতে দাঁত চেপে। সাদমান আর রিচি আপাতত এমন অবস্থায়।
‘আচ্ছা, আপনি তো বলেছিলেন কোন ব্রিজ পার হতে হবে, সেটাতো পেলাম না। আর আমরা মনে হয় এখনো অনেক দূরেই।’ সাদমান গাড়ি থেকে মাথা বের করে কিছু একটা দেখে বলল।
‘স্যার, কিছু লয়া লন। থাকার জায়গায় গেলে মুবাইলে টাকা ভরার দোকানও পাইবেন না।’ ড্রাইভার অনেকটা হুমকির মত বলল। আসল কথা হল, ড্রাইভারের নিজের ক্ষুধা লেগেছে, রাতের খাবার সে একটু আগেই খায়, তাই স্মরণ করিয়ে দেয়া আর কি।
রিচি এটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলো। তার মোবাইল ব্যালেন্স শেষ, বাসায় ফোন করতে হবে। একটু ফার্মেসীতেও যাওয়া দরকার। তাছাড়া ব্যগে খাবারও তেমন নেই। সারাদিন খাওয়া হয়নি আবার পুরোটা রাত পড়ে আছে, এখন কিছু খেতেও হবে। সাদমান ব্যপারটা হয়তো ধরতে পারলো।
‘ভাই, জায়গা দেখে পার্কিং করেন। আমরা তাহলে নামি..’ সাদমান বলে রিচির দিকে তাকালো। রিচি ব্যাগে কিছু একটা খুঁজছে। না পেয়ে আবার শুরু থেকে একই কাজ করছে বারবার বাচ্চাদের মত। সাদমান কিছুক্ষণ দেখে নেমে গেল। নেমেই সে অবাক, এখানে ভালোই শীত। ঢাকায় সে তুলনায় কিছুই নেই। এক নজরে সে হাটের দিকে তাকালো, মানুষে গমগম করছে। একটা গাড়ি এসে দাড়িয়ে তাদের কেনাবেচা থেকে দৃষ্টি সরাতে পারেনি। রিচির জন্য অপেক্ষা করবে কিনা সে বুঝতে পারছ না।
এমন সময় গাড়ি থেকে নেমে রিচি বলল, ‘আমার কাছে কোন ক্যাশ নেই। এদিকে বুথ কোথায় ..আই মিন টাকা তুলতে হবে।’
সাদমান মুচকি হাসলো, রিচি সে হাসির কারণ জানে না।
‘আসুন তাহলে বুথ খোঁজা অভিযান শুরু করি। তবে আমাদের হাতে সময় কিন্তু কম।’ সাদমান বলে হাটতে লাগলো।
‘আমার একটু ওয়াশরুম যাওয়া লাগবে।’ রিচি কিছুটা লজ্জা নিয়ে বলল। সাদমান হাটতে ইশারা দিলো তাকে।
রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে উঠেছে। ছোট পৌরসভা এলাকা, তাই রাস্তাঘাটের দিকে হয়তো কারো খেয়াল নেই। বাজারটা হয়তো আরো ভেতরে, তবে হাট বসেছে তার বাইরে রাস্তার দু’ধারে। শাকসবজি, মাছ, ঘরের জিনিসপত্র, মিষ্টি, মেয়েদের প্রসাধনী, ছেলেদের শার্ট গ্যাঞ্জি আর কিছু আলাদা জায়গায় লোকের জটলা মিলিয়ে হাট বেশ জমে ওঠেছে বোঝাই যায়। রিচির একটু পরপর হাঁচি আসতে লাগলো। সাদমানের সমস্যা শীতে।
রিচির ওয়ামরুমের বন্দোবস্ত হল বাজারের কাছে এক বাড়ীতে, হিন্দু বাড়ি বলে রিচি প্রথমে না যেতে চাইলেও প্রাকৃতিক চাহিদার কথা বুঝিয়ে তাকে পাঠানো গেল। সাদমানও পাশের মসজিদ থেকে সব সেরে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। প্রায় আধঘন্টা খুঁজে এবং আশপাশে জিজ্ঞেস করেও রিচি তার ব্যাংকের এটিএম বুথ খুঁজে পেল না।
আরো কিছুক্ষণ হয়তো খোঁজা যেত আশপাশটা, কিন্তু রাত হয়ে এলে রাস্তা চিনে যাওয়াটা ঝামেলা হবে। সাদমান তিনজনের জন্য কিছু খাবার কিনে নিল রাতের। অনেকটা বাধ্য হয়েই সাদমানের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে হল রিচির। হাট থেকে সাদমান একটা শালও কিনে নিল, রিচি নিলো চুড়ি আর একজোড়া রবারের স্যান্ডেল।
কেনাকাটা শেষ করে ফেরার সময় একটা ফার্মেসির সামনে এসে রিচি সাদমানকে বলল, ‘আপনি যান, আমি আসছি।’
রিচির কাশি ততটা গুরুতর মনে না হলেও অন্য কোন ওষুধ কেনা লাগবে কিনা সেটা আন্দাজ করতে পারলো না সাদমান।
‘আপনার কি বেশি ঠাণ্ডা লেগেছে? শালটা পড়ে নিন। আর আমার ব্যাগেও ওষুধ আছে।’ সাদমান একটানে বলে গেল।
কথা শুনে সাদমানের শালের দিকে রিচির আগ্রহের কোন ছিটেফোটা তো দেখা গেলই না, বরং তাকে বেশ বিরক্ত মনে হল।
‘ওষুধ কেনা ছাড়াও একটা মেয়ের ফার্মেসিতে কেনার অনেককিছু থাকতে পারে, আপনি যান। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’ রিচি বলে চলে গেল দোকানে।
এমন কিছুতে সাদমানের আহত হবার কথা থাকলেও সে নিজে কিছুটা বরং বোকা ভাবতে লাগলো নিজেকে। সে ভুলেই গেছে ‘মেয়েলি বিষয়’ বলেও একটা ব্যপার আছে।
গাড়ির পাশে দাড়িয়ে দু কাপ আদা চা খেয়ে ফেললো সে, বেশ ভাল হয়েছে। আদা কাশির জন্য ভাল কাজে দেয়। ড্রাইভার আবার দুধ চা ছাড়া খেতে পারে না। সে গাড়ির দরজা খুলে পা ছড়িয়ে দুধ চা আর বন রুটি খেয়ে নিলো। হাট থেকে সে আবার একটা মাফলার আর গরম জিলাপি কিনেছে। তার জোরাজুরি তে সাদমানও এক পিস জিলাপিতে কামড় দিল। বেশ মিষ্টি তবে একটু টক স্বাদ আছে। জিলাপি টক হবার রহস্য জানালো ড্রাইভার।
‘স্যার। এইটা কিন্তু ময়দার জিলাপি না। চালের গুড়ার জিলাপি। এইডা আগের রাইতে চিনির সাথে জমাইয়া রাখতে অয়। তাই একটু টক হয়া যায়। তয় খাইতে কিন্তু বেজায় স্বাদ, আমার ছোট মাইয়াডাও জিলাপি খাইতে হেভি পচন্দ করে।’
আরো আধঘন্টার কাছাকাছি পার হয়ে গেল। রিচির আসার কোন খবর নেই। সাদমান প্রথমে ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিলেও পরে তার মাথায় কিছু ভাবনা খেলে গেল। একে তো তার কাছে রিচির মোবাইল নাম্বার নেই, রিচিকে সে রেখে এসেছে বাজারের ভেতরে যেখান থেকে গলিটা তিনটা মোড় নিয়েছে তাই আসতে পথ ভুল হতে পারে।
তবে সবচেয়ে বড় চিন্তায় সাদমানের কেমন যেন গা শিউরে ওঠলো। ফার্মেসিতে রেখে আসার সময় রাস্তার উল্টোপাশে সে কয়েকটা ছেলেকে দেখেছিল যারা এককথায় বখাটে হবে। রিচির চলে যাওয়াতে তারা খুশি হয়ে হেসেছে সেটা সাদমানের চোখে পড়েছিল। তখন মাথা গরম থাকায় বিষয়টা সে ভুলে গেছে। এখন মনে পড়লো।
ড্রাইভারের কথায় নাড়া লাগলো সাদাতের।
‘স্যার, ম্যাডাম কই? এখন তো রওনা হওয়া লাগে।’
(চলবে)