মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | সপ্তদশ কিস্তি | অষ্টাদশ কিস্তি | উনবিংশ কিস্তি | ২০’শ কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(২০’শ কিস্তি)
ইয়াসমিন কে আজ রিলিজ দিয়ে দিচ্ছে।
কয়েকটা ভিটামিন আর ঘুমের ওষুধ ছাড়া আর তেমন কোন পথ্য নেই বললে চলে। তবে ডাক্তার বলেছে, মাথা গরম করে কোন কিছু না করতে। শরীরে যা একটু দূর্বলতা আছে, তা খেয়ে ফেলা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ইয়াসমিনের বেডের পাশে মোটামুটি লোকের জটলা।
ওর বাবা মায়ের সাথে মিরাজ আর তার বাবা মাও আছে। আর আগে থেকে তো জিনাত আর আনু ছিলই। জিনাতের এখানে একদম ভাল্লাগছে না। সে অন্য একটা কারনে অপেক্ষা করছে, তাই চাইলেও কেন জানি যেতে পারে নি। আনুকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে। বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকা শেষ দৃশ্যে মিলন হয়ে গেলে বাদবাকিরা খুশি হয়ে মেকি হাসি দেয়, আনুর হাসিটাও তেমন।
সে কয়েকবার হোস্টেলে গিয়ে কলেজ হয়ে আবার হাসপাতালে এসেছে। কিন্তু জিনাত যায় নি। এমনকি ইয়াসমিনের মা বাবা এলেও সে অনেকটা জোর করেই থেকেছে তাদের সাথে। তবে এখন যেতেই হবে, কারন আনু এসে জানালো জিনাতের বাবা তার জন্য হোস্টেলে অপেক্ষা করছেন। বিকেলের অগ্নিবীণা ট্রেনে আজিমুদ্দিনের গাজীপুর ফিরে যাবার কথা।
এই কদিনে আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। ইয়াসমিন আর মিরাজের বাবা মা মোটামুটি একমত হয়েছেন তাদের বিয়ে দিতে। কয়েকধাপে হাসপাতালের মাঝেই তাদের টকশো চলেছে। মিরাজের খুশি হবার কথা থাকলেও সে ইয়াসমিনের অসুস্থ অবস্থায় এসব আলাপে তেমন একটা সায় দেয় নি, তবে যথেষ্ট উৎসাহী ছিল আনু।
সে বিয়ের কেনাকাটা অব্দি ভেবে রেখেছে। তাদের এসব ভবিতব্য আলাপে আশপাশের রোগীরা যারপরনাই বিরক্ত, এটা বেশ বোঝা যায়। পাশের বেডের নতুন ভর্তি হওয়া বয়স্কা মহিলা তো বলেই ফেললেন, ‘এইসব আলাপ কি বাড়িতে করলে পারেন না, মেয়েটা তো এখনো বিছানাই ছাড়েনি।’
কথা সত্যি। রিলিজ দিয়ে দিলেও ইয়াসমিন অনেক দূর্বল। কিছু হাই এন্টিবায়োটিক আর ভিটামিন খেয়ে এখন সে সারাদিন বলতে গেলে ঘুমায়। চোখ মেলে তাকালে সে সবচেয়ে বেশি দেখে আনুর মুখটা, আর আনু রাস্তার মেয়েদের মত একটা বিশ্রী গালি সহকারে কানে কানে বলে, ‘ঘুমরাণী হইছো না? আসো হোস্টেলে, দেখাবো।’
ইয়াসমিন ঘুমের অগোচরে তার জীবনের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুটির পরিণতি সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না। জিনাত অবশ্য ব্যাপারটিতে বেশ মজাই পেয়েছে, এমনকি হাসপাতাল থেকে রিলিজের আগে দুজনের বিয়ে দিয়ে দিলেও মন্দ লাগতো না তার।
আনুকে হাসপাতালের কাগজগুলো ধরিয়ে দিয়ে জিনাত করিডোর বেয়ে পাশের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় ধীরপায়ে। দুপুরে খাওয়া শেষে একটু চোখ লেগে এসেছিল সাদাতের । দরজায় দাড়ানো একটা অর্ধচেনা মানুষের ছায়া দেখে সে বলতে গেলে চমকে গেল।
বিকেলের পড়তে শুরু করা হালকা কমলা রঙের রোদে জিনাতের সাদা সালোয়ারের রংও কেমন কমলা লাগছিল, তার সাথে একটু বাতাসে তার ওড়নাটা একটু অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উড়তে থাকায় জিনাতকে একটু লজ্জায় পড়তে দেখা গেল। সাদাত একটু উঠে বসে তার গায়ের চাঁদরটা টেনে দিলো, একটা খাকারি দিয়ে বলল,
‘ভেতরে আসুন।’
অনিন্দিতা বোতলে পানি আনতে বাইরে গেছে। এই ঘরটাতে আরেকজনের সুমধুর নাসিক্যধ্বনি শোনা যাচ্ছে সগৌরবে, সে শুয়ে আছে সাদাতের পাশের বেডে। সাদাত সেদিকে তাকিয়েই আবার জিনাতের দিকে তাকালো।
‘এখন কেমন আছেন?’ জিনাত সাদাতের বেডের পাশে খালি বেডটায় বসল।
হঠাৎ পরিচিত হওয়া মানুষকে ভুলতে যাওয়ার পথে যদি আবার দেখা হয়ে যায়, তার সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো তিনটা জিনিস কাজ করতে থাকে- লজ্জা, ভয়, সংকোচ। কেন জানি জিনাতের কোনটাই লাগছে না। তবে সাদাত এই কয়েকদিনের ঘটনায় এমনিতেই কিছুটা সংকোচে তাই জিনাতের সাথে সহজ কথা বলতেই সে চায়।
‘আপনি একবার এসেছিলেন অনিন্দিতা আমাকে বলেছে। আমার সেন্স ছিলনা। তাই তখন..আর পরে ভাবলাম আপনি বোধহয় চলে গেছেন। আর খোঁজ করিনি। আসলে..’ সাদাত একবারে বলে যাচ্ছিল।
জিনাত থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি কিছুটা কৈফিয়ত দিচ্ছেন মনে হচ্ছে। আর আমি একবার না, কয়েকবার এসেছি। আমার এক জুনিয়র ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরার অবস্থা, তাই নিয়ে আসা। ’
‘ওহ। তাই বলুন, ভাবলাম আপনার কিছু..। তা উনার এখন কি অবস্থা?’
‘এখন ঠিকঠাক। কিন্তু আপনি এখনো বলেন নি, আপনার এখন কি অবস্থা। সেদিন শুনে গেলাম প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন।’
সাদাত একটু হাসলো, ‘আমার অবস্থা আসলে কতটুকু খারাপ ছিল, আমি সেটাই জানিনা। তবে এখন তো ভালই লাগছে।’
‘তা কবে ছাড়বে আপনাকে কিছু বলেছে?’
‘না। খুব সম্ভব কিছু টেস্ট করাতে দেবে। এখানে তো ঠিক ভাল ব্যবস্থা নেই। ভাবছি, ময়মনসিংহ যাবো।’
অনিন্দিতা এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলো, সাথে সুব্রত বাবু। অনিন্দিতার হাতে একটা পলিথিনে কিছু পেয়ারা আর একটা কাগজের ঠোঙা দেখা যাচ্ছে।
‘আমি উনাদের বাসাতেই থাকি। সুব্রত বাবু আর তার মেয়ে অনিন্দিতা।’ সাদাত তাদের দেখিয়ে বলল। অনিন্দিতাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। জিনাত আদাব বলে বেড থেকে উঠে দাঁড়ালো।
‘আমি তাহলে যাই। কাল না হয় একবার আসবো।’ জিনাত অনেকটা অপরাধীর সুরে বলে আবার নিজেই কেমন করছে, হয়তো তার মন বলছে আরো কিছুক্ষণ থাকতে।
অনিন্দিতা কপাল মুছতে মুছতে বলল, ‘আপনি বসেন। সেইদিনও তো আসলেন, কথা হইলো না।’
‘উনার সাথে আমি শেষবার গাজীপুর থেকে আসার সময় ট্রেনে পরিচয়, এখানে আবার দেখা হয়ে গেল।’ সাদাত একটু হাসিমুখেই বলল।
জিনাত আশা করেছিল সাদাত তার নাম মনে রেখেছে, কিন্তু তা নয়। বিষয়টা তাকে কিছুটা আহত করলো। বেশিরভাগ ছেলেরা একবার দেখা হওয়া লোকের নাম মনে রাখতে পারে না এবং নাম না বলেই পরিচয় করিয়ে দিতে পারে সেটা জিনাত জানে।
তবে তার একটা নমুনাও সে পেল, তার কিছুটা খারাপ লাগলো হয়তো। আর না বসে সে চলে যেতে চাইলো। আর তার জন্য যৌক্তিক কারনও তার হাতে ছিল।
‘আসলে আমার বাবা এসেছেন দেখা করতে। হোস্টেলে বসে আছেন। আবার চলে যাবেন, তাই আমাকে যেতে হবে।’
সাদাত কিছু বলল না। এরমধ্যে পাশের বেডের লোকটি কখন ঘুম থেকে উঠে বসেছে সে খেয়াল করেনি।
‘আপনি হোস্টেলে থাকেন? তাইলে আমাদের বাড়িতে একদিন আসেন না, দিদি। ঘুরে যাবেন।’ অনিন্দিতা জিনাতের বয়সে ছোট হবে কি না এটা কেউ আন্দাজ করতে পারছে না, তবে এই সম্বোধনে জিনাত কিছুটা অবাকই হল। একদম গ্রামের সরল একটা হিন্দু মেয়ের মাঝে জিনাত নিজের অস্বস্তি আর ঢাকতে পারছে না। সুব্রত পাশের বেডে কিছুটা হেলান দিয়ে বসে এই তিনের পরিচিতি ক্রীড়া দেখতে লাগলেন।
‘আসবো, আজ তাহলে আসি। আমি আবার এসে দেখে যাব, কেমন?’ জিনাত বলে সাদাতের মুখের দিকে তাকাল। সে একটা শক্ত বিদায় বার্তা আশা করছে, যেটা হয়তো সত্যি তাকে আরেকবার হাসপাতালে নিয়ে আসবে। অন্তত যোগাযোগের কোন উপাদান যদি এই সুযোগে আসে তাহলে মন্দ কি।
কিন্তু সাদাত হেসে তাকে বেলুনের বাতাস ছাড়ার মত হতাশ করে বলল, ‘ঠিক আছে, তাহলে ভাল থাকবেন। ’
জিনাত অনেকটা বাতাসের বেগে বেরিয়ে গেল। সাদাত সেদিকে আর ফিরে তাকালো না, হয়তো কিছুটা অভিমানেই, জিনাত তো চাইলেই একটু বসে যেতে পারতো আরো। অনিন্দিতা সাদাতের দিকে কিছুটা ভাবলেশহীন হয়ে তাকালো। কেন জানি সে সকল পরিচিতি আর সৌজন্যতার মাঝে একটা সূক্ষ্ণ প্রতিযোগিতার গন্ধ পাচ্ছে।
পাশের সদ্য ঘুম ভাঙা লোকের হেড়ে গলার কথায় সুব্রত, অনি আর সাদাত তিনজনেরই আগের এই ঘরের অবস্থা ফিরে এল।
‘কি দাদা, সবরি কত নিলো?’ পলিথিনের দিকে চেয়ে বলল সে।
‘হালিতে চল্লিশ। অনি, দাদারে দে দেখি কয়েকটা।’ সুব্রত বেডে শুয়েই বলল।
‘তোমারে কাইটা দিমু বুড্ডা? খাবা?’ অনি লোকটিকে তিনটা পেয়ারা দিয়ে আবার সুব্রতর কাছে এল।
‘না রে, আমি এখন খাবোনা। বাবাজিরে দে কাইটা।’
সাদাত বালিশটা কাত করে আবার শুয়ে পড়লো, ‘আমিও এখন না। থাক’
অনিন্দিতা ব্যগ রেখে বসে কাপড়টা দিয়ে কপাল মুছতে লাগলো। একটা সুগন্ধ হাসপাতালের ঘরটাতে ভেসে আছে, এ কদিনে এই ক’জন মানুষ একসাথে থেকে অন্তত এতটুকু বুঝতে পারলো এই সুগন্ধ তাদের নয়, কিছুক্ষণ আগে আসা অতিথির।
সুগন্ধের সাথে যে রেখে গেছে কিছুু অভিমান আর কিছু প্রশ্ন। সাদাত কিংবা অনি কেউ হয়তো এখন সেগুলো ভাবছে না। পাশের লোকের নাকডাকার শব্দটা খুব একটা সমস্যা করছে না।
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | সপ্তদশ কিস্তি | অষ্টাদশ কিস্তি | উনবিংশ কিস্তি | ২০’শ কিস্তি