মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | ১৭’শ
যখন থামবে কোলাহল
(১৭’শ কিস্তি)
আজিমুদ্দিন ইজ্জতপুর থেকে রওনা হয়েছিলেন ভোর পাঁচটায়। ট্রেন দেরি করে আসায় পৌছতে বেশ বেলা হয়ে গেল ,গফরগাঁও পৌছতে দুপুর হয়ে এল। দেশের অবস্থা ভাল না। অনেকটা গৃহযুদ্ধের মত ভাব। বাস চলেনা বললেই চলে। উপজেলা টার্মিনালগুলোতে অবরোধের কারনে বাস ছাড়েও না বেশি।
ঢাকায় আবার বাসে পেট্রোল বোমা মারা হচ্ছে , খুব ভয়ংকর জিনিস। বোতলে পেট্রোল নিয়ে তার ছিপিতে আগুন লাগিয়ে নাকি ছুড়ে মারে, বোতল ফেটে ছড়িয়ে যায় চারপাশে, মানুষসহ বাসে আগুন ধরে যায় নিমিষেই। সেখানে পুলিশের সাথে সরকারী দলের লোকেরা হামলা ঠেকাচ্ছে আবার কাউকে ধরতে পারলে পুলিশ মামলা দিয়ে আটকে দিচ্ছে জামিন ছাড়া।
এলাকার দোকানে পাঁচ টাকার পত্রিকা রাখে, সেখানে এসব পড়েছেন তিনি। বিরোধীপক্ষ মনে করছে সরকার কে ভালই চাপে ফেলা গেছে, একা একা নির্বাচন করতে পারবে না চাইলেই।
আর সরকার বলছে তারা এই ধরনের হিংস্রতা আর গাড়ি পোড়ানোর চরম শিক্ষা দেবে, আন্দোলনে কাজ হবে না, পত্রিকাগুলো দুটো খবরই পাশাপাশি ছাপে। সব খবরে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার, জনগণ দুদলের পক্ষেই আছে।
তবে আজিমুদ্দিন সেই জনগণের দলে পড়েন না। দেশের মানুষ পুরো বিপরীত মন্তব্য শুনতে শুনতে অভ্যস্ত, তাই তারা দর্শকের মত সারাদিন খবর দেখছে আর ‘হায় হায়’, ‘ইশ’ বলেই ক্ষান্ত দিচ্ছে।
স্টেশনে নেমেই একটা সেলুনে ঢুকলেন আজিমুদ্দিন। দাড়ি গোফের কারনে একদম বুড়ো লাগছে তাকে, যদিও এতটা বুড়ো সে নয়। আজকে রাতের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে আবার, বাসায় কাজের মেয়ে ছাড়া সফুরা একা। এত বছরেও সফুরা একা থাকতে পারে না, হোস্টেলে মেয়ের কাছে আসলেও দিনে দশ পনের বার ফোন দেয় আজিমুদ্দিন কে।
মেয়ে জিনাতের জন্য কিছু খাবার আর জিনিস পাঠিয়েছে সে, ওগুলো দিয়ে যেতে বলছিলেন বেশ কদিন আগে থেকেই। তবে ক্ষেতের কাজ শেষ হবার আগ পর্যন্ত ডানে বামে তাকান না আজিমুদ্দিন, তাই কাজ কোনরকম গুছিয়ে আসতে হয়েছে।
আর আসার আরেকটা কারনও আছে। ইলিয়াস মিয়ার সাথে দেখা করতে হবে। সে একটা ইসলামিক দলের এখানকার বড় নেতা। তার দলও বলা যায় সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আজিমুদ্দিন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে খুব একটা আগ্রহী না। আগেও ইলিয়াস তাকে অনেকবার বলেছে তাদের সাথে কাজ করতে।
তার মতে, ইবাদতের বাইরে এই কাজও এই সময়ে একটা ফরয হয়ে দাড়িয়েছে। তবে আজিমুদ্দিন ইবাদতের ব্যপারে খুব একটা সচেতন না হওয়ায় হয়তো এই ফরয পালন করতেও খুব একটা আগ্রহী হন নি।
ইলিয়াস অনেকবার বলে ব্যর্থ হয়ে পরে তাকে শুভাকাঙ্খী বানিয়েছেন। তাই আজিমুদ্দিন মাসিক হিসেবে একটা অর্থ সাহায্য দিয়ে আসছেন কয়েকবছর যাবত। আর এর আগে দুবার তার বাসায়ও আসা হয়েছে, ইলিয়াস মিয়ার পরিবার তাকে যথেষ্ট খাতির করে।
মেয়ে হোস্টেলে থাকায় আজিমুদ্দিন এলাকায় একটা পরিচিত পরিবারের প্রয়োজন আছে মনে করেন। তবে জিনাত ইলিয়াস মিয়াকে কেন জানি দেখতে পারে না। তাই জিনাতকে এ ব্যাপারে কিছুই বলা যাবে না, আজিমুদ্দিন সেটা সচেতনভাবে ভেবে রেখেছেন।
সেলুনে ভিড় ছিল ভালই। কিন্তু তাড়াতাড়ি সিরিয়াল পেতে দেরি হল না। কাস্টমার সেলুনের কাজের চেয়ে টিভির খবরে আগ্রহী বেশি। চুল কেটে আবার শেভ হলেন আজিম। শেভ হবার পর পুরুষের দু ধরনের অনুভূতি হয়। বয়স কম মনে হওয়ায় অনেকের লজ্জা লাগে আবার নিজের হঠাৎ সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে ভেবে অনেকের অহংকার আসে।
আজিমুদ্দিনের কোনটাই এল না, বরং খারাপ লাগলো এই ভেবে গতবারের চেয়ে পাকা চুলের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিয়ের যোগ্য মেয়ের বাবার চুল পাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয় তবে এটা তিনি সহজে মানতে পারেন না।
ইলিয়াস মিয়ার বাড়িটি বেশ পুরনো। শহরের বাজার থেকে যে রাস্তাটা গ্রামের দিকে গেছে সে রাস্তার শুরুতেই বাড়িটি। আগে এক হিন্দু লোকের ছিল, পরে সে বিক্রি করে ইলিয়াস মিয়ার বাবার কাছে। তবে সময় পার হয়ে গেছে কথাটা বাড়ির আবরণ বারবার মনে করিয়ে দেয়। দেয়ালের ইট খসে পড়েছে, শ্যাওলা জন্মে নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিয়েছে দেয়ালের বড় অংশ।
সবুজ আর খসে পড়া লাল রঙে এক অদ্ভুত সমাপ্তির ইঙ্গিত। আজিমুদ্দিন কিছুক্ষণ খেয়াল করে অবাক হলেন, আগের বার যখন এসেছিলেন তখনও ইলিয়াস মিয়া বলেছিলেন বাড়ি মেরামতের কথা। বোধহয় সময় করে উঠতে পারেন নি। বাড়িটা ভাল করে দেখলে মনে হয় একপাশে হেলেও আছে।
মোটামুটি মানের ধাক্কায় ভেঙে পড়তেই বোধহয় অপেক্ষা করছে। কাঠের গেটে শব্দ করে ভেতরের কাউকে উপস্থিতি জানানোটা একটু কঠিন। কারন ভেতরের যে ঘরে মানুষ থাকে সে ঘরটা গেট থেকে বেশ ভেতরেই। আজিমুদ্দিন সাথে কিছু আপেল, বিস্কুট আর চিপস এনেছেন। বাসায় বাচ্চা আছে, পেলে খুশি হবে। এদিক সেদিক তাকিয়ে গেটে শব্দ করলেন।
কোন সাড়া পাওয়া গেল না, শুধু একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল। দেয়ালের সাথে যে পেরেক দিয়ে গেটটা আটকানো তার মাঝে একটু ফাক দিয়ে বাড়ির কিছু অংশ দেখা যায়। কিন্তু আজিমুদ্দিন ওভাবে দেখতে চাচ্ছেন না।
ইলিয়াস মিয়া নামাযী, বাড়িতে যথেষ্ট পর্দার ব্যবস্থা করা আছে, তার স্ত্রীও পর্দা করেন, বাইরের পুরুষের সামনে আসেন না। তাই আরেকবার শব্দ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি।
‘আমরা ইরাজের এখনো কোন ট্রেস পাইনি। তবে পেয়ে যাব। আপনি টেনশন করবেন না স্যার।’ ফোনের ওপাশ থেকে বললেন জারিফ কামাল।
কথা শুনে রেজা খান কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে রইলেন। প্রচণ্ড রাগে হয় তিনি গালাগাল করেন নয়তো চুপ থাকেন। আপাতত তার গালি দেয়ার সুযোগ নেই। কারন, প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সী ছাড়া তিনি এখন অচল, তাদের সাহায্য লাগবেই ইরাজকে খুঁজতে।
তবু নিজেকে খুব একটা দমাতে না পেরে বললেন, ‘মি. জারিফ। আপনি আমাকে খুব ভালভাবে চেনেন। আর এত মোটা টাকা দিয়ে আপনাকে কেন রাখা হয়েছে তাও জানেন। তবু টেনশন না করার কথা বললে… আপনাকে এখন মন চাইছে…’
জারিফের হাসি শোনা গেল।
‘স্যার, আপনি বোধহয় কোন গালি দিতে চান। দিয়ে ফেলুন, আমার অভ্যাস আছে।’
রেজা আর রাগ সংবরণ করতে পারলেন না। ‘আপনার পাছায় কষে একটা লাথি দিতে মন চাইছে।’
জারিফ ওপাশ থেকে আরো জোরে শব্দ করে হাসলেন। রেজা খুব অবাক হলেন। লোকটার লজ্জা বলতে কিছু নেই বোধহয়। জারিফ হাসি থামিয়ে বলল, ‘স্যার। আমরা অনেকটা বাজারে মেয়েছেলের মত। সবার কাছেই গালি খাই, আবার শেষমেষ আমাদের পাছাটাই দরকার পড়ে।’
‘আপনি ফোন রাখুন। আমি আপনার সাথে আপাতত আর কথা বলতে চাই না।’
‘স্যার। আমি আবারো বলছি, টেনশন করবেন না। ইরাজ বেঁচে থাকলে আমরা পাবই। স্লামালিকুম।’
সালামের উত্তর না দিয়ে রেজা ফোন কেটে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন। এগারোটা বাজে কিন্তু অফিসে যাওয়া হয় নি। রিচি কে একটা মেইল করা দরকার, সাদমান ছেলেটাকেও কিছু কাজ বুঝিয়ে দেয়া দরকার।
পুলিশ আর সিকিউরিটিতে সমানে টাকা যাচ্ছে। দেশের অন্যতম ধনীর ছেলে খুঁজে বের করা বলে কথা, টাকা তো পাতার মত পড়বে। তার মধ্যে গোপন রেখে কাজ করতে বললে একেক জনের ভাব হয়ে যায় ইন্টারপোল বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মত। মিডিয়া জানলে ঝামেলা, কয়েকজন কে আগেই টাকা দিয়ে মুখে গুজে রাখা আছে।
‘সব শালা সুযোগ নিচ্ছে। মেরে খাচ্ছে। সবকটাকে কুত্তা দিয়ে…’ বলতে বলতে পা দিয়ে লাথি মারলেন খাটে, কোথাও একটু লেগে খুব ব্যথা পেলেন, ‘অহ’ করে উঠে বসে দেখলেন ফুলে গেছে জায়গাটা।
‘এই আমিন, আমিন।’রেজা অনেকটা আর্তনাদ করতে লাগলেন। মিনিট দুয়েক কাউকে দেখা গেল না। রেজা শুয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলেন মিসড কল অনেকগুলো। আজিজ মির্জা কয়েকদিন ধরে আবার যন্ত্রণা দিচ্ছে। এবার একটু টাইট দেয়া দরকার, তার মিসড কল ছয়টা।
পার্শিয়া আমেরিকা থেকে মেইল করেছে, পড়া হয় নি। খুব সম্ভব ওর ডিভোর্স আটকানো যায় নি, মেয়েটার জন্য খারাপই লাগছে, অনেকদিন ভাল করে কথা হয় না। রেজা ভাবছেন তাকে দেশে চলে আসতে বলবেন।
পারভীন কে একটা ফোন করা দরকার। ইরাজ কে পাওয়া যাচ্ছে না এটা খুব স্বাভাবিকভাবেই জানার কথা পারভীনের । তবু নিজ থেকে জানানো দরকার। পারভীন এসবে খুব ভুল ধরে, পুরো সংসার জীবনে ধরেছে। ভাল করেই জানা আছে সেটা রেজার।
‘স্যার। আসবো?’ দরজার ওপাশে কারো কণ্ঠ শোনা গেল। পর্দার জন্য তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
‘কে? ভেতরে আসো।’ রেজা ধমকের সুরে বললেন।
নিউটন নামের ছেলেটা হাতে একটা টাওয়েল নিয়ে ঢুকলো, তার ভেতর কিছু একটা চাপা দেয়া। নিউটন হাসিমুখে তাকিয়ে আছে রেজার দিকে।
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ষোড়শ কিস্তি | ১৭’শ