মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(চতুর্দশ কিস্তি)
রেজা খানের অফিসে রিচির জন্য একটা আলাদা রুম দেয়া হয়েছে, রুমের ভেতরটা ফকফকে সাদা রং করা, কয়েকটা ক্যাকটাস আর চেয়ার টেবিল, লাগোয়া একটা টয়লেটও আছে। দেয়ালে দুটো ছবি আর একটা ক্যালেন্ডার। ছবি দুটো তেমন আহামরি কিছু না, একটা মরা নদী দেখা যাচ্ছে, তার পানি আবার ধূসর। রিচি নদী দেখেনি তেমন একটা, তবে পানি এমন ধূসর হবার কারণটা সে ধরতে পারছে না, হয়তোবা ছবিটায় একটা রংকে গুরুত্ব দিয়ে করা। আরেকটা ছবি একটা মহিলার, মধ্যবয়েসী। সে এক কাখে কলস আর অন্যটাতে একটা বাচ্চাকে নিয়ে হাটছে। আশপাশটা একটা গভীর বন। এই ঘরটায় সকালের রোদটা ভালোই আসে, তবে বিকেল গড়াতে থাকলে কেমন বিষন্নতা মেশানো অন্ধকার চলে আসে যেন। রোদের সাথে মন ভাল লাগার কোন সূত্র থাকার কথা না।
গত কয়েকদিনের অস্বস্তির পরে আজ রিচির মন অজানা কারনে ভাল। রেজা খান অবশ্য খুব একটা শান্তিতে নেই। সাদাত যে মার্ডার কেসের ঝামেলায় পড়েছে তা থেকে তিনি চাইলেই খুব সহজে তাকে ছাড়িয়ে আনতে পারেন। মাত্র দুইটা ফোন কলের ব্যাপার, তাহলে স্ট্যাটমেন্ট নিয়েই তাকে পুরোপুরি গোণার খাতা থেকে বাদ দেয়া হবে। সমস্যা করেছে সাদাত নিজেই, সে কেসটার ফল দেখতে চাইছে। তাই রেজা খানের দেয়া সাহায্য সে নিতে চাইছে না।
রিচি সাদাতের সাথে রেজা খানের সম্পর্কটা ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে সে এটুকু নিশ্চিত, সাদাত রেজা খানের বাড়িছাড়া ছেলে ইরাজ নয়। তবে ইরাজের সাথে তার কোন জানাশোনা থাকতে পারে।
রিচি মুখে একটা কলম নিয়ে আনমনে কিছু একটা ভাবছে, সে ল্যাপটপ অন করে রেখেছে। একটা মেইল আসার কথা, সাদাতের কাছ থেকে। মামলার কিছু কাগজপত্র স্ক্যান করে পাঠানোর কথা। আপাতত সে রেজা খানকে নিয়েই ভাবছে। লোকটা আসলে ঠিক কেমন? ভাল, মন্দ নাকি দুটোই? পৃথিবীর সব মানুষের তো দুটোই থাকে, কম আর বেশি। রেজা খানের কোন দিকটা বেশি? রেজা খান ঠিক কেন রিচির সাথে এমন বাজে কাজটা করেছিল, সেটাও ঠিক বুঝতে পারছে না সে।
অফিসটা আটতলার উপরে, এখান থেকে একটা ফ্লাইওভার দেখা যায় গাছের লতির মত ছড়ানো। আবার তার মধ্যে ছুটে চলা গাড়িগুলোকে মনে হয় পিঁপড়ার দল যাচ্ছে। কাচের মধ্য দিয়ে বাইরের রোদ দেখা গেলেও তার আঁচ পাওয়া যায় না, কারন ভেতরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
রিচির কাছে তার নিজের জীবনটাও এখন অনেকটা এই কাচবদ্ধ ঘরের ঠিক বিপরীত। বাইরেটা খুব ঠান্ডা আর ভেতরটা অনেকগুলো প্রশ্নের তাপে শুধু অস্বস্তি দিয়ে যাচ্ছে, যা কেউ বুঝতে পারছে না। একসময় একজন হয়তো বুঝতো, আবিদ। রিচির আবার আবিদের কথা মনে পড়ে গেল। তার অস্বস্তি লাগছে। এসি রুমেও তার মনে হয় ঘাম ঝরবে।
আবিদকে মনে করার এখন কোন কারণ ছিল না। একটি মানুষের জন্য রিচির জীবনটা শুরুতেই শেষ হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। মানুষ যাকে ভুলতে চায় তাকে ভোলার জন্য কাউকে মনে রাখার থেকেও বেশি খাটুনি করে, রিচিও করে। আর এভাবেই হয়তো আরো বেশি মনে পড়ে তাকে। আবিদকে মনে পড়ার ব্যাপারটাও এমন।
দরজায় কেউ একজন বাইরে থেকে ঢুকতে চাইছে, পারছে না। দরজায় Push আর Pull লেখা আছে। ঢোকার জন্য এত পরিশ্রম করার কথা না। তার মানে এমন কেউ চেষ্টা করছে যে হয়তো পড়তে জানেনা। রিচি দেখতে পেয়ে নিজেই গিয়ে দরজাটা টান দিল। বাইরে একটা ষোল সতের বছরের ছেলে দাড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা ট্রেতে কফির মগ আর এক পিস কেক।
ছেলেটার নাম শামীম। সে শুদ্ধভাবে কথা বলে বেশিরভাগ, তবে শুনতে বিদেশিদের মত লাগে। তবে এর একটা ভয় পাওয়া রোগ আছে, সে অফিসে মোটামুটি দুতিনজন মানুষকে অকারনে ভয় পায়। তার মধ্যে রিচিও একজন। রিচি আসার পর থেকে তিনদিন পেরিয়েছে, সে শামীমকে একটা কাজ করতেও বলেনি, ধমক দেয়া তো দূরের কথা। তবু শামীম তার দিকে এমনভাবে তাকায় মনে হয় যেকোন সময় ভয়ে প্রস্রাব করে দেবে।
‘ম্যাডাম, আপনাকে স্যার ডাকে।’ বলতে গিয়ে ছেলেটার মুখে কেমন একটা ভয় এসে ভীড় করেছে। যেন সে রিচিকে গলায় ফাঁসি নেবার সময় জানাতে এসেছে।
‘ঠিক আছে, কিন্তু তুমি এমন ভয় পাচ্ছো কেন?’ রিচি ট্রেটা টেবিলে রাখলো।
‘না তো, কে বললো?’ বলেই শামীম চলে যেতে চাইলো। রিচি বলল, ‘শামীম। ভয় পাবার কথা কেউ কাউকে বলে দেয় না। আমাকে দেখে তুমি সবসময় ভীতুর মত থাকো।’
‘কই নাতো ম্যাডাম, আমি তো এমনই।’ বলেই শামীম চুপ করে হাতের তালু দিয়ে প্যান্টে ঘষতে লাগলো।
‘আমি দেখেছি তুমি বাইরে খুব নরমাল থাকো, এমনকি স্যারের সামনেও। আবার শুনলাম গানও গাও গুনগুন করে।’
শামীম মুচকি হাসে তবে কথা বলে না। তার মুখে ঘামের বিন্দুগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, অথচ সে রিচির সামনে তা মুছতেও সাহস পাচ্ছে না।
রিচি বলল, ‘যাও তুমি। দরজা বাইরে থেকে ঢোকার সময় না ঠেলে টানতে হয়।’
শামীম না তাকিয়ে ওভাবেই চলে গেল। এবার দরজা খুলতে তার ভুল হল না।
রেজা খানের রুমে ঢোকার আগেই রিচি অনেকটা চমকে গেল। কাচের বাইরে থেকে টেবিলটা দেখা যায়। সেখানে রেজা খানের সামনা সামনি যে সুদর্শন যুবক বসে আছে তাকে রিচি চেনে। কিন্তু নামটা মনে নেই, মনে রাখা উচিৎ ছিল। রিচির এক মুহূর্তেই মনে হল এর কাছেই তো যাওয়া দরকার ছিল কিছু প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যে। রেজা একটা গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন আর হাতে নিয়ে হাত নাড়িয়ে কিছু বলছেন। খুব সম্ভবত গ্লাসে পানি না, অন্য কিছু। কারন পানীয়টা অনেকটা বাদামের খোসার রংয়ের মত। রুমে ঢুকেই রিচি রেজার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন সামনে বসে থাকা ছেলেটিকে সে দেখেইনি। মেয়েরা এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ছেলেদের চেয়ে ভাল পারে। তাদের অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়া শিখতে হয় অনেক ছোট থেকেই।
‘সিট ডাউন। তোমাকে আরো আগেই ডাকতাম, ভাবলাম দুজনকে একসাথে নিয়েই বসি।’ রিচি এবার পাশের ছেলেটির দিকে তাকালো এবং সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো, একে বোধহয় ইংরেজীতে বলে ‘শর্ট সাইট’।
তবে রেজা খানের কণ্ঠ ঠিক স্বাভাবিক না, আশপাশ থেকে একটা উটকো গন্ধ আসছে। রিচি ভাবতে ভাবতেই তার সামনে থাকা রেজার গ্লাসের দিকে তাকালো। রেজা সেটা বুঝতে পেরে বললেন, ‘সরি। একটু হুইস্কি নিয়েছি। আমি এইসময় খাইনা নরমালি।’
‘আমি জানি।’ বলল রিচি
‘হ্যা। লেটস কাম টু দ্য পয়েন্ট।’ রেজা গ্লাসটা রেখে দুজনের দিকে তাকালেন। তার চোখে ঘুম ঘুম ভাব। রিচির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সাদমানকে তুমি দেখেছো আগেই। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে। সে আমার হয়ে অনেক আগে থেকেই কাজ করে। ইভেন ওকে আমার স্টাফদের থেকেও স্যালারী ভাল দেই, ট্রাস্টও করি। এর কারণ আছে, সেটা বলতে চাচ্ছি না।’
সাদমান মাথা নিচু করে আছে। রিচি একবার তার দিকে তাকাতেই কেমন নতুন বরের মত সে মুচকি হেসে আবার মাথা তুললো, হয়তো খুব দরকার না পড়লে এই ছেলে কথা বলে না।
রেজা খান জিজ্ঞেস করেন, ‘সাদাত নামের ছেলেটা কি পেপারসগুলো পাঠিয়েছে?’
‘না, এখনো না।’
‘সাদাত ইরাজের পরিচিত। কিভাবে পরিচিত সেটা আমিও জানতে পারিনি। খুব সম্ভব কোথাও দেখা হবার পর ঘনিষ্ঠ হয়েছে। সাদাত একটা এনজিওতে কাজ করে জেনেছি। ওকে নিয়ে আমার হেডেক নেই। তবে আমি ইরাজের কোন ট্রেস পাচ্ছি না গত কয়েকদিন ধরে। তাই সাদাতকে আমার লাগবে।’
‘আপনি কি ওর কাছে জিজ্ঞেস করেননি?’ সাদমান এই প্রথম মুখ খুললো।
‘আমি ফোন করেছি, ও ধরেনি। আমি অন্য কোনভাবে ফোনে কথা বলতে চাইনা আপাতত। ওর সাথে সামনা সামনি কথা বলব।’
‘ইরাজ হুট করে কনটাক্ট অফ করলো কেন?’ রিচি জিজ্ঞেস করলো।
রেজা খান গাটা চেয়ারে এলিয়ে দিলেন, তারপর চুপ করে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। সাধারনত কোন সাংঘাতিক কথা বলার আগে তিনি একটু সময় নেন, এটা রিচি জানে। এবারও তাই হল।
‘ইরাজ খুব সম্ভব একটা বিপদে পড়েছে, আমি সেটাই বের করতে চাচ্ছি।’
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি