মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(ত্রয়োদশ কিস্তি)
সকাল সকাল হোস্টেলে কি যেন একটা হই হুল্লোড়ের শব্দ। জিনাত জানালা দিয়ে ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। গেটের কাছে জটলার মত, হোস্টেলের অনেকগুলো মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে আনুকেও দেখা গেল। সে অতোটা লম্বা নয় তাই বারবার গলা উচিয়ে গেটের বাইরে তাকিয়েও বোধহয় কিছু দেখতে পাচ্ছে না। জিনাত গায়ে চাঁদরটা জড়িয়ে বারান্দায় এল। গেটের দারোয়ান কি নিয়ে যেন বাইরের একটা লোকের সাথে তর্ক করছে। এমন আগে তো দেখা যায়নি, ব্যাপারটা জানা দরকার।
জিনাত আনুকে ডাকলো অনেকটা চোরের মত, ‘এই আনু, এই!’
আনু শুনলো না অথবা শুনেও সাড়া দিলো না। জিনাত আবার ডাকলো, এবার আনু একটু পেছন ফিরে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসি দিয়ে ‘পরে বলব’ ধরনের ইশারা দিয়ে আবার সে দিকে মনোনিবেশ করলো। জিনাতের এবার কিছুটা বিরক্ত লাগছে। কি এমন আহামরি যে এখন বলা যাবে না। সে চুলটা একটু আচড়িয়ে নিচে নেমে গেল।
গেটের কাছে শুধু হোস্টেলের মেয়েরাই না, বাইরের কিছু ছেলেমেয়েও ভীড় করে আছে। জিনাত একটু ঠেলে গেটের কাছে যেতেই আনু কাছে এসে তাকে টান দিয়ে একটু পাশে সরিয়ে নিয়ে গেল। তাকে দেখে কোন একটা ব্যাপারে খুব মজা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
‘আপা, ওইদিকে যায়েন না।’ আনু ফিসফিসিয়ে বলল।
‘কেন, কি সমস্যা?’ জিনাতের আরো বিরক্ত লাগছে আনুর বাড়াবাড়ি।
‘আর বইলেন না। তিনতলার এক মেয়ে, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে মাত্র, এক ছেলের সাথে রিলেশন ছিল, এখন মনে হয় আর নেই। যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে, তাই ছেলে তার দলবল নিয়ে হোস্টেলে চলে এসেছে মেয়ের সাথে দেখা করতে।’
‘মেয়ে কই?’ জিনাত এবার বেশ কৌতুহলী।
‘মেয়ে তো রুমে বসে আছে, কয়েকজন বড় আপু গিয়ে বলছে ছেলের সাথে দেখা করে ঝামেলা মিটাতে, কিন্তু মেয়ে তো বলে সে এই ছেলেকে চেনেই না।’
‘চেনে না মানে কি? একটা ছেলে এমনি এমনি এসব করছে?’
‘তা বলতে পারি না। তবে মজা হয়েছে অন্যখানে।’
‘কি মজা?’
‘ছেলেকে গেটের দারোয়ান প্রথমে খুব কড়াভাবে বলছে চলে যেতে, নইলে পুলিশ ডাকবে। এখন তো দারোয়ানকেই পাওয়া যাচ্ছে না কিছুক্ষণ ধরে।’
‘পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি? আশেপাশে গেছে হয়তো, পুলিশও ডাকতে যেতে পারে।’
আনু ফিক করে হেসে দিল, পাছে কেউ না দেখে তাই আবার মুখ ঢেকে ফেললো। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই হোস্টেলে একটা ভালো ঝামেলা চলছে। সে অনেকটা নিরোর মত আচরণ করছে, রোম পুড়লেও নিরো তখন বাশি বাজাচ্ছিল। আনু আরো কাছে এসে বলল, ‘সবাই বলাবলি করছে, দারোয়ানকে ছেলেটা হাত করে ফেলেছে টাকা পয়সা দিয়ে।’
জিনাত অবাক হয়ে গেল। ‘আশ্চর্য। কেউ সুপারকে কেন জানায়নি?’
‘জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ছেলেটা আরেক চমক দেখালো।’ আনু হেসেই যাচ্ছে, একটা কথা শেষ করতে সে কয়েকবার বিরতি নিচ্ছে হাসির জন্যে।
‘আবার কি চমক?’
‘আরে ছেলে তো ছবি বের করে দেখাইছে আমাদের। মেয়ের সাথে তোলা, খুবই ক্লোজ। কয়েকটাতে কাপড় চোপড়েরও ঠিক নাই।’
‘ছিঃ ছিঃ, এত বাজে কিছু হয়ে যাচ্ছে, আর তোমরা চুপচুপ দেখছো।’ বলেই জিনাত এগিয়ে গেল।
লোহার গেটের ছোট দরজাটা দিয়ে মাথা নুইড়ে ঢুকতে হয়। জিনাত বেরিয়ে দেখলো আনুর কথাই ঠিক। বাইরে অনেকগুলো মটরসাইকেলে কয়েকটা ছেলে বসে আছে আর বিড়ি টানছে। তাদের হাবভাব অনেকটা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের বংশধরের মত।
গেটে দারোয়ান নেই। দারোয়ানের রুমেও কয়েকটা ছেলে বসে আছে, তারা কার্ড খেলছে। বোঝাই যায় এরা ভাল সংঘবদ্ধ এবং আগে থেকে ভাল প্ল্যান করেই এসেছে। জিনাতের কি কারনে হঠাৎ সাহস বেড়ে গেল।
সে ছেলেগুলোকে বলল, ‘এই, তোমরা কারা? এখানে মেয়েদের হোস্টেলের সামনে কি?’
ছেলেগুলো প্রথমে নজর না দিলেও এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। তাদের একজন কার্ড রেখে উঠে দাঁড়িয়েও গেলো।
‘কি বলেন আফা, সকাল থেইকা এত ক্যাচাল হইতেছে, আপনি জানেন না?’ ছেলেটি বলল।
পাশের ছেলেগুলো দাড়িয়ে গেছে।
‘আপনাদের কোন ঝামেলা থাকলে বাইরে মেটাবেন, এখানে কি? মেয়েদের হোস্টেলের সামনে এসব কি?’ জিনাতের স্বর হুট করে চড়ে গেল।
ছেলেগুলো রাস্তার দিকে তাকাতেই সেখানে থাকা একটা বাইক থেকে আরেকটা ছেলে উঠে এল। তার গলায় শিকলের মত চেন, অনেকে বিদেশি কুকুরের গলায় এমনটা বেঁধে রাখে। তবে ছেলেটা যথেষ্ট সুদর্শন, ফর্সা আর লম্বা। জিনাতের সামনে এসে দাঁড়ালে ছেলেটির তুলনায় নিজেকে অনেক খাটো মনে হল তার।
ছেলেটি এসে জিনাতের দিকে না তাকিয়ে ছেলেগুলোকে বলল, ‘আফা কি কয় রে?’
আগের ছেলেটা ময়লা হলুদ দাঁত কেলাতে কেলাতে বলল, ‘আফা কয় বাইরে ঝামেলা মেটাতে। কওছে মিরাজ বাই, আমরা কি ভিতরে গেছি? বাইরেই তো আছি। আমগো ভাবীর সাথে একটু দেহা করাই দিলেই তো আমরা যামুগা।’
মিরাজ নামের ছেলেটা এবার একটু মুচকি হেসে জিনাতের দিকে তাকালো। জিনাত অবাক হয়ে খেয়াল করলো ছেলেটার হাসিও অদ্ভুত সুন্দর।
‘আফা আপনেরে আমি চিনি। আপনে আমাগোর গেরামে কম্বল দিতে গেছিলেন। আপনে আমার কষ্টটা বুঝবেন।’ মিরাজ আরো কাছে এসে বলল।
এর মধ্যে আনু আর হোস্টেলের মেয়েগুলো পেছনে এসে গেছে। রাস্তাতেও কিছু মানুষ জমে গেছে। আমাদের দেশে অন্যের বিবাদ নিষ্ক্রিয় দর্শকের মত উপভোগ করার মত মানুষের অভাব নেই। সকাল সকাল এমন বিনোদন সবসময় বিনা খরচায় পাওয়া যায় না।
‘দেখুন, আমি আপনাকে চিনি না। আমি আপনার কষ্টও বুঝতে আসিনি। ঘটনা যাই হয়েছে অন্যভাবে সমাধান করেন। মেয়েটা যদি আপনার সাথে অন্যায় করেও থাকে, আপনি সবাইকে ওসব ছবি দেখিয়ে মহৎ কাজ করেননি।’ জিনাত এত নিমিষে বলে গেল।
মিরাজ কি যেন ভাবলো। তারপর জিনাতকে বলল, ‘আপনে আমার বড় বোনের মত। আমার সাথে তার বছর খানেকের রিলেশন। এখন সে আমারে না চেনার ভান করে। দেখেন আফা, আমি ছেলে খারাপ না। কোনদিন কেউ বলতে পারবে না, কোন মেয়ের দিকে অন্য নজরে তাকাইছি। ইচ্ছা করলে তারে আমি তুইলা নিয়া যাইতে পারি, কিন্তু তা করমু কেন। আমি তারে সত্যই অনেক চাই। একবার ডাইকা জিগান তারে।’
জিনাতের এসব কথা সিনেমার ডায়লগের মত লাগছে। মিরাজ বলেই যাচ্ছে, ‘আপনে এহন যেটা কইবেন, সেইটাই সই।’
‘আপনারা হোস্টেলের সামনে থেকে যান। এটা দেখতে খারাপ লাগছে। যদি সে সত্যি অস্বীকার করে তবে পারিবারিকভাবে দেখতে পারেন। কিন্তু আমরা হোস্টেল থেকে একটা মেয়েকে এভাবে ছাড়তে পারি না। আর গেটের দারোয়ান কই? তাকেও সরিয়ে দিয়েছেন। ’
মিরাজের পাশে কার্ড খেলোয়াড়েরা এসে দাঁড়ালো, তারা বুঝতে পেরেছে তাদের আপাতত যাবার সময় হয়েছে। মিরাজ বলল, ‘আফা, তাইলে আমি যাই। আপনি নিজে আমার হয়া তারে একটু বুজান, আমারো এইহানে পোলাপান নিয়া আসতে ভাল্লাগে না।’
মিরাজ রাস্তার অন্যপাশে যাচ্ছে। তার ছেলেরা লোকজন সরিয়ে দিচ্ছে, এমন ভাব যেন এখানে কিছুই হয়নি। বরং দাঁড়িয়ে থেকে লোকেরা অন্যায় করে ফেলেছে। হোস্টেলের মেয়েগুলোও ভেতরে চলে যাচ্ছে। আনু আগের মতই জিনাতের গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে। বাইক নিয়ে মিরাজ আবার জিনাতের কাছে এল।
‘আফা, দারোয়ান রে আমার ছেলেরা একটু ধমক দিছে, আসলে সবার মাথা গরম তো। আমারা গেলে আইসা পড়বে।’ বলে সবাইকে কি যেন ইশারা দিল। সবগুলো ছেলে মাছের ঝাকের মত একেকজন অন্যের বাইকের পেছনে চড়ে চলে গেল।
জিনাতের কেমন একটা সাহস বেড়ে কয়েকগুন হয়ে যাবার মত অবস্থা। তার আশপাশের মেয়েগুলোকে তার কাছে এখন খুব ছোট লাগছে। গেটে পা রাখতেই আবার একটা চিৎকার। সবাই তিনতলার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে।
জিনাতের কেন যেন বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। আনুও সেদিকে ছুটে গেল। মেয়েটা খারাপ কিছু করে বসেনি তো আবার? জিনাতের পা চলছেনা। বোধহয় সে এগোলেই খারাপ কিছু তার দিকে ছুটে আসবে। তিনতলার দিকে তাকিয়ে নিরব হয়ে আছে জিনাত। তার হাতের তালু ঘামছে।
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি