ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল | একাদশ কিস্তি

যখন থামবে কোলাহল ১১

মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:


আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি


যখন থামবে কোলাহল

(একাদশ কিস্তি)


সাদাত এখন থানায় বসে আছে। তার শরীর থেকে ঘামের বাজে গন্ধ বের হচ্ছে। মোটামুটি ঘন্টা তিনেক হয়ে গেছে অথচ ওসি সাহেবের কেস নেয়ার তেমন অগ্রগতি নেই, তিনি খুব মন দিয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছেন। ম্যাগাজিনের কভারে আবার অর্ধনগ্ন এক বলিউড নায়িকার ছবি। প্রচণ্ড রাগ হলেও আপাতত তার কিছুই করার নেই। ওসির নাম আপেল মৃধা, নেমপ্লেটে লেখা। হিন্দু না মুসলিম ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মৃধা টাইটেল হিন্দু মুসলিম উভয়ই ব্যবহার করে, তবে আপেল সম্পর্কে আইডিয়া করা যাচ্ছে না।

আপেল সাহেব বসতে বলা বাদে এখন পর্যন্ত তার সাথে কথাই বলেনি। পুরো এলাকা জেনে গেছে, কেরোসিন বিক্রেতা আজগরের হাতে টিপু নামের এক চটের ব্যবসায়ী মজিদ দিনেদুপুরে খুন হয়েছে। তাও আবার কুপিয়ে নৃশংসভাবে তাকে মারা হয়েছে, সাদাত এই খুনের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। আপাতত আশপাশে অবস্থা একবারে থমথমে। কারো মুখে কথা নেই। ভরা বাজারের খুব কাছে এমন ঘটনা এই এলাকায় আগে হয়নি। পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিককেও দেখা গেছে, এমন লোমহর্ষক খবরের ভাল কাটতি আছে বাজারে, তাই তারাও এসে ভিড় করেছে। আর উপজেলা পর্যায়ে এমন কয়েকটা খবর ডিটেইলস দিতে পারলে দ্রুত স্থানীয় সংবাদদাতা থেকে জেলার দিকে যাওয়া যায়।

সাদাত ছাড়া এই ঘরটায় কেউ নেই। কেমন যেন একটা পানপাতার মত গন্ধ ঘরটায়, ময়লা আর পুরনো দলিলের মত কাগজে ঠাসা একদিকটা, আলো আসে না বললেই চলে। থানার বাইরে আজগরের বাবা, স্ত্রী আর সুব্রত লাহিড়ী আছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কৌতুহলী। কাউকে ভেতরের ঘরে ঢুকতে দেয়া হয়নি।

‘চা খাবেন?’ ওসি আপেল ম্যাগাজিনটা রেখে সাদাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমি খালি পেটে চা খাই না।’ সাদাতের গলা দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছে না ক্ষুধায়।

‘হুম’ বলে আপেল ‘করিম, করিম’ বলে ডাক দিলেন।

তিনবার ডাক দেবার আগেই করিম হাজির হল, কিন্তু তার নেমপ্লেটে ‘আব্বাস উদ্দিন’ লেখা।

‘করিম কই?’ আপেল সাহেব কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন।

আব্বাস উদ্দিন মনে হয় প্রশ্নটা আগে থেকেই জানতেন, মুখস্থের মত বলল, ‘স্যার, করিম বাজারে গেছে। ওই যে সকালের ঝামেলাটা নিয়া।’

আপেল একটা শ্বাস ফেলে সাদাতের দিকে তাকালেন, তারপর করিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হোটেল থেকে চার পাঁচটা পরোটা নিয়ে আসো, সাথে ডিমভাজি আর দুই কাপ চা।’

আব্বাস অনেকটা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল আবার ঢুকলো। আপেল তার দিকে একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিলে সে একটা হাসি দিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। তবে আপেল সাহেবের মুখে কোনধরনের হাসি দেখা যাচ্ছে না।

সাদাত বলল, ‘আমার বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। আমার এখানে কাজগুলো যদি সেরে ফেলতেন তবে ভাল হত।’

আপেল একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘কাজ সারা হলে আমরা কাউকে থানায় বসিয়ে রাখিনা সাদাত সাহেব। তবে মার্ডার কেস তো, একটু ঝামেলা পোহাতেই হবে। আর মাল পানিরও খরচা আছে।’

‘আমি তো নিজ থেকেই সাক্ষী দিচ্ছি, এখানে আমার টাকা লাগবে কেন?’ সাদাতের কথায় হতাশা।

‘আপনি এর আগে থানায় এসেছেন কখনো?’ আপেল তার হাতে একটা কলম নিয়ে টেবিলে টক টক শব্দ করতে লাগলো।

‘এসেছি। বার দুয়েকের মত।’ সাদাত মাথা নিচু করে বলল।

‘কি কারনে, মানে কেস কি?’

‘একবার আমার আইডি হারিয়ে গিয়েছিলো আরেকবার…’ সাদাত এটুকু বলে থেমে যেতেই আপেল তার দিকে তাকালো। ‘আমার এক বন্ধুর একটা মেয়েলি ইস্যু ছিল, মানে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। ওর সাথে আমাকেও আসতে হয়েছিল।’

‘হুম। এসব কোন কেসই না। দেখুন সাদাত সাহেব, আমি আপনার সম্পর্কে প্রায় লিগাল সব খবর নিয়েছি, আপনার অফিসেও কথা হয়েছে। আপনি বলছেন, খুনটা আপনার চোখে সামনে হয়েছে, তাই তো?’

‘হ্যা’

‘সেক্ষেত্রে আপনি বাচাঁতে পারতেন তো?’

‘আমি দৌড়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু আজগর আমাকে দা দেখিয়ে বলল সেখান থেকে সরে যেতে। আমি তারপর দৌড়ে গিয়ে বাজারের লোক ডেকে আনি।’

‘আর তারপর, বাদবাকি কাজ বাজারের লোকেরাই করে। যে দা দিয়ে মজিদ আই মিন ভিক্টিমকে মারা হয়েছে তাতে আজগরের হাতের ছাপ মেলার কথা। তাতে কেসটা সহজ হয়ে যেত। তবে ঝামেলাটা অন্যখানে।’

সাদাত ভ্রু কুচঁকে বলে, ‘এখানে ঝামেলার কি?’

আপেল চেয়ার ছেড়ে সাদাতের কাছে এসে বলে, ‘আমি আজগরের সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা বলেছি। সে বলেছে, আপনি তাকে খুনের জন্য টাকা দিয়েছেন। আমি তার বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলাম। লাখ পাচেঁক টাকা পাওয়া গেছে। এটা অবশ্য আপনার জানার কথা একটা কেরোসিন বিক্রেতা বাসায় এত টাকা কীভাবে রাখবে?’

সাদাত অনেকটা রেগে বলল, ‘হোয়াট? আমি? আমিতো আজগরকে চিনিই না। আর টাকা দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।’

আপেল সাদাতের কাধে হাত রেখে বলল, ‘শুধু তাই না। একটা লোক মার্ডার করে আবার ধরা দেবার জন্যে সেখানে দাড়িয়ে থাকবে? এটা সম্ভব? আপনার মনেও তো এই প্রশ্নটা আসা উচিৎ, তাই না?’

সাদাত মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো। এমন সময় আব্বাস নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলো।


গফরগাঁও স্টেশনে আজ তেমন ভীড় নেই, কয়েকজন লোক হাটাহাটি করছে আর চানাচুর বা পিঠাওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে, যাত্রী নেই বললেই চলে। তবু জিনাত কিছুটা চিন্তিত। সে তার মা সফুরাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিল ঘন্টা দুয়েক আগে, ঠিক সময়ে ট্রেন আসলে তা মিস করার কথা। এখন হয়েছে উল্টোটা, ট্রেনের কোন খবর নেই, কে একজন বলে গেল ফাতেমানগরের দিকে অবরোধের জন্য লাইন তুলে ফেলেছে কারা যেন, তাই ময়মনসিংহ থেকে এখনো কোন ট্রেন ছেড়ে আসেনি। তারমধ্যে আবার টিকিট কাটাও হয়নি। জিনাত কিছুক্ষণ কাউন্টারের সামনে দাড়িয়ে থেকে, ডাকাডাকি করে চলে এসেছে। কারো কোন হদিস নেই। সফুরার শরীর কিছুটা ভাল হলেও শরীরে জোর নেই তেমন একটা, সে একটা কাগজের দোকানের সামনে বসে আছে হেলান দিয়ে।

জিনাত সফুরার কাছে এসে বসলো, গায়ে চাদরটা আরেকটু টেনে দিয়ে বলল, ‘কিছু খেয়ে নাও। ট্রেন দেরি হবে।’

সফুরা চাদর সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঢং করবি না। আমার শীতও নাই, ক্ষুধাও লাগে নাই।’

জিনাত দূর্বল সফুরার রাগ দেখে হাসলো, সফুরা দেখেও না দেখার ভান করলো।

একটা লোক সামনে বসে অনেকক্ষণ ধরেই পেপার পড়ছে। বয়স্ক মানুষ, তার চোখের চশমা নাকের ডগায় চলে এসেছে, হাতও থেমে থেমে কাপছে। জিনাত এসে বসার পর থেকে লোকটা তার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। বিষয়টা খেয়াল করছে সফুরা।

‘কাপড় ঠিক করে বস। লোকজন তাকাই আছে।’ সফুরা জিনাতের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। জিনাত লোকটার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে চাদরটা টেনে নিলো।

সফুরা রাগে যেন জ্বলে যাচ্ছে, ‘খারাপ মেয়েছেলের মত বারবার হাসছিস কেন? পুরুষ কাছে টানার জন্য মেয়েছেলে এভাবে হাসে।’

জিনাত সফুরার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘মা লোকটা আমার দিকে খারাপ নজরে তাকায় নাই। সে মনে হয় আমারে কোথাও দেখছে।’

‘ফালতু পেচাল পারবি না।’

‘ফালতু না মা, আমি তাকানো দেখলে বুঝতে পারি কোনটা বদনজর। তুমিও বুঝতা একসময়। এখন মা হয়ে পড়ছো বিপদে। মেয়ের দিকে সব নজরই তোমার চোখে বদ।’

সামনের লোকটি এবার পেপার রেখে এগিয়ে এলেন। জিনাতের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘তুমি জিনাত না? ‘

এবার জিনাত কিছুটা হতচকিয়ে গেল, কেননা সে লোকটিকে চিনতে পারছে না। এমনকি মনেও করতে পারছে না। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয়, না চিনলেও জিনাত মাথা নাড়ায়। কিন্তু আজ তার সাথে তার মা আছে, এই লোককে নিয়ে পরে সে একশোটা প্রশ্ন করবে। তাই জিনাত বলল, ‘আমি জিনাত, কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না।’

ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘আমাকে তো তুমি চিনবেনা। আমি তোমাকে দেখেছি আনুর সাথে ছবিতে। আমি আনোয়ারার বাবা।’

‘ও, আপনি আনুর বাবা? আসলে আংকেল আগে দেখা হয়নি তো।’

ভদ্রলোক সে কথায় কান না দিয়ে সফুরার দিকে তাকাতেই জিনাত বলল, ‘আমার আম্মা।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, ভাল আছেন?’ সফুরার দিকে তাকিয়ে বললেন।

সফুরা বলল, ‘আমার শরীর ভাল নেই। আপনি কেমন আছেন?’

‘আছি একরকম। এসেছিলাম একটা কাজে, আমাদের বাড়ি ভালুকাতেই। চলে যাব, ভাবলাম একটা পেপার কিনে নেই, দেশের খবর তো ভাল না, কোথায় কি হচ্ছে আজকাল।’

আনুর বাবা কথা বলতেই লাগলেন। বাবার সাথে নাকি চেহারায় মেয়েদের বেশি মিল পাওয়া যায়, কিন্তু আনুর বাবার চেহারা বা এত কথা বলার ব্যাপারটা আনুর মধ্যে একেবারেই নেই।

আনুর বাবা আর সফুরা কথা বলছিলেন, তাতে জিনাতের তেমন আগ্রহ নেই। তার চোখ আটকে গেল আনুর বাবার হাতের পত্রিকার পেছনের পাতার কোনার দিকের একটা ছবিতে। সেখানে পুলিশের সাথে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, সামনের টেবিলে একটা রামদা সাজানো।

ছবিতে একজন লোক আছে যাকে জিনাত ঠিক চিনতে পেরেছে, ট্রেনে সেদিন একসাথে আসা লোকটা।


(চলবে)

উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top