মেহেদী হাসান মিরাজ
যে তারা হয়ে উঠে ধ্রুবতারা
বাংলাদেশে এর আগে অনেক অফ স্পিনার এসেছে কিন্তু এই ছেলের মতো প্রভাববিস্তার করতে পারেনি কেউই। মাত্র কৈশোর পার হওয়া এক ছেলে যখন ইংল্যান্ডের মতো দলের সাথে ২০ উইকেটের মধ্যে ১২ উইকেট নিলো, অবাক হলো সবাই! কিন্তু তখন অনেকেই বলেছিলেন, এই ছেলে অন্য আর দশটা অফ স্পিনারের মতোই। বাংলাদেশে অফ স্পিনারদেরর শুরুটা সুন্দর হয়, কিন্তু কিছুদিন পর হারিয়ে যান। অনেকটা ফুটবলের “one season wonder” ফ্র্যাজটার মতো। সোহাগ গাজীর চেয়ে বড় উদাহরণ কি হতে পারে আর?
কিন্তু এই ছেলে অন্য রকম ধাতুতে গড়া। অন্য আর দশটা তরুণ ক্রিকেটারের মতো না! সৌম্য, সাব্বির কিংবা মোসাদ্দেক, আশা তো দেখিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু দলে জায়গা পাকা করেছেন মাত্র ২১ বছরে পড়া এই তরুণ।
আরব আমিরাতে এশিয়া কাপে পারফর্ম করলেন, বাংলাদেশের টেস্ট সিরিজ হলেই তাতে পারফর্ম করবেনই। জিম্বাবুয়েকে ভোগালেন, বেশি ভোগালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ক্যারিয়ার সেরা পারফর্ম করলেন এই সিরিজে। দ্বিতীয় টেস্টে নিজের পুরোনো রেকর্ড ভেঙ্গে সেরার নতুন রেকর্ড করলেন। আশা করি বুঝতে পারছেন ছেলেটা কে? মেহেদী হাসান মিরাজের কথাই বলছি।
কিন্তু কে এই মেহেদী হাসান মিরাজ?
আন্ডার নাইন্টিনে ছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। ওয়ান-ডাউনে ব্যাট করতেন। একবার তো বিশ্বকাপে ৩০০ এর উপর রান করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। জাতীয় দলে শুধু অফ স্পিনার হিসেবে খেলা এই ব্যাটসম্যানের হাত যে মন্দ নয় প্রমাণ দিয়েছিলেন এশিয়া কাপ ফাইনালে। ১২১ রানের পার্টনারশিপ করেছিলেন লিটন দাসের সাথে ওপেনিং নেমে। সামলেছিলেন বুমরাহ-ভুবনেশ্বরদের সুইং বোলিং। মোদ্দা কথায় এই ছেলেটিকে দায়িত্ব দিন, এই ছেলে তা করে দেখাবে।
মেহেদী হাসান মিরাজ কেনো অন্য দশ জনের থেকে আলাদা?
মিরাজকে কখনো সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলোতে একটিভ দেখেছেন? কখনো কোনো রটনা শুনেছেন এই ছেলের নামে? কোনো শৃঙ্খলাজনিত ভুল করতে দেখেছেন? আমি বলছি না সোশ্যাল মিডিয়া খারাপ। তরুণ বয়স, এখনই তো ব্যবহার করবে। কিন্তু এই ছেলেকে তাঁর ধারে কাছেও দেখি না। হয়তো যারা মিরাজকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা বলতে পারবেন। এই ছেলে মনে হয় ক্রিকেটকেই তাঁর সর্বস্ব মানে।
শচীন টেন্ডুলকার তাঁর অটোবায়োগ্রাফিতে একটা কথা বলেছিলেন। কথাটি ছিল এরকম যে, ক্রিকেটারদের কখনো ভোলা উচিত না যে তাঁরা কেনো ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিল। একজন ক্রিকেটার যদি ক্রিকেটকে ভালবাসতে না পারেন এবং যখন সেই ক্রিকেটার বুঝতে পারবে যে ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কমে গিয়েছে তখনই ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়া উচিত।
একটা বাচ্চা কেনো ক্রিকেট খেলা শুরু করে? কারণ সে ক্রিকেটটাকে ভালোবাসে। ক্রিকেটই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু এখনকার ক্রিকেটে যে পরিমাণ ব্যবসা-অর্থ ঢুকে গিয়েছে, ক্যারিয়ারের এক পর্যায়ে গিয়ে ক্রিকেটারদের কি আদৌ মনে থাকে তাঁরা কেনো ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিল? নাকি এটাকে পেশা হিসেবে দেখা শুরু করে?
মিরাজ হয়তো ক্রিকেটকে তাঁর প্রথম ভালোবাসা মনে করেন। এত ডেডিকেশন কোনো বাংলাদেশের কোনো তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সদা হাসতে থাকা এই ছেলে নিজের সেরা দিয়ে দেন প্রতিটা ম্যাচে। এশিয়া কাপে পাকিস্তানের সাথে পয়েন্টে অন্তত ১৫-২০ রান বাচিয়েছিলেন শুধুমাত্র ফিল্ডিং দিয়ে। শুধু তাই নয়, এশিয়া কাপের প্রতিটি ম্যাচে টাইট লাইন-লেংথে ভুগিয়েছেন ব্যাটসম্যানদের। পাকিস্তানের সাথে শুরুতেই ফখর জামানের উইকেট, ফাইনালে শিখরের। অবদান রেখেছেন প্রতিটি ম্যাচে। বিশ্ব-ক্রিকেটে নতুন রুপে আবির্ভাব হওয়া বাংলাদেশের প্রতীক এই মেহেদী হাসান মিরাজ।
ক্রিকেটার মেহেদী হাসান মিরাজের ক্রিকেটীয় সেন্স তাঁর বয়সের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
মিরাজের হাতে কিন্তু এমন কোনো “রহস্য” অস্ত্র নেই। গতানুগতিক অফ স্পিন, মাঝে মধ্যে স্লাইডার কিংবা পিচে পড়ে সোজা আসা বল ছাড়া তাঁর অন্য কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু লাইন লেংথের কারণে মিরাজকে খেলা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়। বিশেষ করে যদি পিচ ঢাকার হয় তাহলে আপনার ছাড় নেই। সহজে ভড়কে যান না। হেটমায়ারের কাছে ছয় খাওয়ার পরের বলেই আবার ফুল লেংথে বল দিয়েছিলেন কিন্তু এবার একটু ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। ফলাফল? মিথুনের হাতে ক্যাচ। হাত ঘুরিয়ে সেলিব্রেশন করা ছেলে ঘুরিয়ে দিয়েছেন উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের মাথা পুরো সিরিজে। এই মুহূর্তে ছেলেটির টেস্ট রেকর্ড কতটা সমৃদ্ধ জানেন? ১৮ ম্যাচে ৮৪ উইকেট। বোলিং এভারেজ ২৯। ১০০ উইকেটের ক্লাবে ঢুকতে খুব বেশি দেরি হবে না মিরাজের।
“আহ! খিদা লাগছে, একটু খাই”
মিরাজের আনমনে বলা এই কথাটি ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ার সব জায়গায়। তাও ক্ষুধার ঠেলায় তিনি একটি লেমন ফ্লেভারের একটা কোল্ড ড্রিংক খুললেন। খিদা লাগলে কেউ কোল্ড ড্রিংক্স খায়? চঞ্চল স্বভাবের এই ক্রিকেটার তো অনেকের মন জয় করেছে তাঁর সহজ-সরল অভিব্যক্তিগুলোর মাধ্যমে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের তারুণ্যের প্রতীক এই ছেলে।
আমেরিকায় টি-টুয়েন্টি সিরিজ জেতার পর মিরাজের নাচটা দেখে মনটা আপনাতেই ভালো হয়ে গিয়েছিল। কৈশোরের ছিটেফোঁটা খুঁজে পাওয়া যায় এই ছেলের আচার-আচরণে। বকা দেন, মাইর দেন সমস্যা নাই, তাইলেই ঠিক থাকব আমি, বকা না দিলে আমার পারফরম্যান্স ভালো হয় না- এইটা আর কেউ নয়, মেহেদী হাসান মিরাজই বলেছিলেন।
উইকেটের বেশি বাইরের খেলে ফেলে মিস করলে নন-স্ট্রাইক ব্যাটসম্যানের কাছে ভুল স্বীকার করেন। বলেন, “ভাই ভুল হয়ে গেসে, বাইরের বল খেইলা ফেলসি।” মাহমুদউল্লাহ সেঞ্চুরি করার পর যখন সিজদা দিলেন তখন সিজদা দিলেন মিরাজও।
এশিয়া কাপে সারাক্ষণ মাশরাফির পেছনে ঘুরেছেন। যখন যা করতে বলেছেন ক্যাপ্টেন, তাই করেছেন মিরাজ।
ড্রেসিংরুমের সবার আদরের “ছোট ভাই” মিরাজ কিন্তু “ছোট ভাই” কোটায় খেলেন না। কথাটি কেনো বলছি? কথাটি বলছি কারণ আমরা তো ভুলে যাই একটা খেলোয়াড়ের অবদান একটা খারাপ ম্যাচের পরেই। কোনোদিন এই ছেলে এক ওভারে ২০-৩০ খাইলে বইলেন না যে “ছোট ভাই” কোটায় খেলে। কারণ এখন পর্যন্ত তো ভায়রা-ভাই কোটা, ধর্ম কোটা পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছি আমরাই।
মেহেদী হাসান মিরাজ বাংলাদেশের ক্রিকেটে হতে পারেন সবচেয়ে বড় সম্পদ। এখন তো আপাতত বোলিং অল-রাউন্ডার হিসেবে খেলছেন। কিন্তু পরবর্তীতে হতে পারেন বাংলাদেশ দলের গুরুত্বপূর্ণ মেম্বারের একজন। হয়তো সাকিব-মুশফিক উত্তর-যুগে ক্যাপ্টেন হওয়ার মতো গুণাবলি এই মুহূর্তে এই ছেলের মধ্যেই দেখছি। মাত্র জ্বলতে শুরু করা এই তারা রুপ নেক ধ্রুবতারাতে, এটাই রইল আশা।
মেহেদী হাসান মিরাজেকে নিয়ে আপনার মতামত জানান!
আরও পড়ুন:
ভারতীয় ক্রিকেটের উত্থানে দাদা সৌরভ গাঙ্গুলি
অ্যালিস্টার কুকঃ টেস্ট ক্রিকেটের এক ঋষির গল্প
শচীন টেন্ডুলকার: গড অফ ক্রিকেট | শচীন টেন্ডুলকারের জীবনী