নাহার তৃণার ছোটগল্প:
ফাঁকা ফ্রেম আর অকেজো হাতঘড়ি
নাহার তৃণা
১.
আমি কখনো খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি করিনি। কখনোই না। পারলে স্যান্ডেল পরেই ঘুমাতে যাই এমন কঠিন অবস্থা। কাজেই ভোরের শিশির পায়ে মাখবার সৌভাগ্য থেকে আমি নিদারুণ ভাবে বঞ্চিত। শুধু কি ভোরের শিশির? মাটি নাকি মায়ের মতো, আমি সেই মায়ের স্পর্শও সারা গায়ে অকপট হয়ে মাখতে পারিনি কখনো। ঠাণ্ডার ভয়ে শিশির থেকে, এলার্জির ভয়ে ধুলোবালির স্পর্শ বাঁচাতে মাটি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে রাখতে কখন ঠিক জানিনা, প্রকৃতির সাথে আমার বাঁধনটা আলগা হয়ে গেছে।
আমি যেন এই প্রকৃতির কেউ নই। আমাকে নিয়ে তাই প্রকৃতির কোন মাথা ব্যথা নেই। দাদীজানের মুখে প্রকৃতি বিষয়ে নানা সময়ে শুনতে শুনতে আমার মনে চিরস্থায়ী ভাবেই গেঁথে গেছে, প্রকৃতি মানুষের মনের নানান অনুভূতির সাথে মিশে নিজেকে প্রকাশ করে। বিষয়টার যৌক্তিক-অযৌক্তিক দিক যাচাইয়ে না গিয়ে আমি তাতে আস্থা জমা রেখেছি।
আমার যখন মুখ ভার, বাইরের প্রকৃতি তখন ছেলেবেলার অতি দুষ্টু বন্ধু’র মতো দেখিয়ে দেখিয়ে একান-ওকান হাসছে!
যখন কারো মন খারাপ তখন নাকি প্রকৃতিও মুখভার করে থাকে। যখন কেউ খুশিতে ঝলমল করে তখন প্রকৃতিতেও ঝেপে আসে সে আনন্দের উচ্ছ্বাস। প্রকৃতি নাকি সযত্নে তার প্রিয়জনকে রক্ষা করে। কেবল আমি বাদে। আমার যখন মুখ ভার, বাইরের প্রকৃতি তখন ছেলেবেলার অতি দুষ্টু বন্ধু’র মতো দেখিয়ে দেখিয়ে একান-ওকান হাসছে! আবার ঠিক যখন আমার মন আনন্দে ফুটছে, অতি হিংসুটের মতো প্রকৃতি তখন পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে যাবে। যাবেই!
এ আমি বহুবার দেখেছি। বাবা বলতেন, ‘চট করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেও না।’ যদিও তাঁর এ শিক্ষা প্রায়শই ভুলে খেয়ে ফেলি। কিন্তু এই ব্যাপারে আমি অনেক দেখে-শিখে এবং ঠেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। প্রকৃতির সাথে আমার একটুও বনে না, মোটেও না! যার সাথে আমার বনেই না, আমি যে তার প্রিয়পাত্র নই সে বলাই বাহুল্য। তাই আমাকে বা আমার সুখ-দুঃখ রক্ষার দায়ও নেই তার। সেটা সে করেনা, করেনি। তবুও প্রকৃতির খেয়ালেই যেন আমি ঘরে থেকেও গৃহী হতে পারিনি। তাতে ওর কিছু যায় আসে না। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কি সত্যিই প্রকৃতির কেউ নই? তার অংশে আমার কোনই ভূমিকা নেই! অভিমান আর আশা এ দুই বিপরীতমুখী অনুভূতি মুঠোয় পুরে অপেক্ষায় থাকি, একদিন ঠিক আমার দিকে চোখ পড়বে প্রকৃতির। আমার সুখ কিংবা দুঃখে সেও সঙ্গী হবে। আমি সেদিনটির অপেক্ষায় আছি।
২.
ছেলেবেলা থেকেই আমার বায়নার স্বভাব নেই। এটা চাই, ওটা চাই করে কখনও বাবা কিংবা মাকে অতিষ্ঠ করার কোন ইতিহাস নেই আমার। হয়ত অভাবের সংসার বলেই বুঝে গিয়েছিলাম, চাইলেই পাওয়া যাবে না। তাই খামোখাই কষ্টে যাইনি। কিন্তু আমার মেজো বোন, সে বড় অবুঝ ছিল। তার প্রায় প্রায় ভাতের সাথে গোশত খেতে মন চাইত। রোজ রোজ কুচো চিংড়ি আর লাউয়ের ঘন্ট খেতে নাকি তার বমি আসতো। মা তাই প্রায় তার ভাতে আচার মেখে স্বাদ পাল্টানোর চেষ্টা করতো। খানিকটা আচার মাখা ভাত মুখে তুলেই আপা তার বিখ্যাত হা-মুখো কান্না শুরু করতো। মুখে খাবার নিয়ে এহেন বিচ্ছিরি কান্নার কায়দা সে কোত্থেকে যে রপ্ত করেছিল খোদা জানেন। এমন না যে সে ভাত না খেয়ে হাপুস হয়ে কাঁদতো। কান্না এবং খাওয়া দুটোই সমানে চলতো।
কোনো কোনো ঈদে নতুন জামা না হলে আপার কান্না বাড়িতেই সীমাবন্ধ থাকতো না। জানলা খুলে কান্নায় পাড়া শুদ্ধ সবাইকে জানান দিতে ভুলতো না। এবার ঈদে আমাদের নতুন জামা হচ্ছে না, আমরা বড় দুঃখী, তাই কাঁদছি। এমন মজার খোরাক হাত ছাড়া করার মানুষের অভাব হতো না আমাদের পলেস্তরা খসা বাড়ির জানলায়। কেউ কেউ উপযাজক হয়ে বলতো, ‘ও পারুলির মা, আনন্দের একটা দিনে মেয়েটা মন খারাপ করে থাকবে এটা ঠিক কথা?’ কোনটা ঠিক আর কোনটা নয়, সেটা কী মা জানতো না? খুব জানতো। চাইলে মা ভাইয়াকে চিঠি লিখে টাকার ব্যবস্হা করতে পারে। কিন্তু মা সেটা কখনোই করবে না। মধ্যবিত্তের কিছু থাকে না বলেই হয়ত আত্মসম্মানটুকু আঁকড়ে ধরে প্রাণপণ।
ঠিক নাটক সিনেমা কিংবা উপন্যাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার মত আমাদের সংসারের কিছু ইতিহাস আছে। আমার বড় ভাইয়া দারুণ মেধাবী ছাত্র। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে পড়তে গিয়ে আর ফিরে আসেনি আমাদের কাছে। কানাডিয়ান মেম বিয়ে করে ওখানেই স্থায়ী হয়ে গেছে। মা এটা মেনে নিতে পারেনি কিছুতেই। তাঁর আশা ছিল, ছেলে বড় মানুষ হয়ে ফিরে এসে সংসারের হাল ধরবে। তাছাড়া ভাইয়া মা’কে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল সময়মতো ঠিক ফিরে আসবে।
বাবলুদা বুঝেনি এ বাড়ির কোন মেয়েটির চোখে তার জন্য জমা রয়েছে গভীর তৃষ্ণা?
আমার কেন জানি মনে হয়, ভাইয়ার হুট করে বিয়ের ব্যাপারে মা যতটা আঘাত পেয়েছে, তারচে’ শতগুণ বেশি পেয়েছে হেরে যাবার ব্যর্থতায়। বড় ছেলেকে নিয়ে তাঁর আকাশ ছোঁয়া গর্ব ছিল। আমার দাদী প্রায় বলতেন, ‘পলাশের মা এত্ত পাওভারী হওন ভালা না। নজর লাগবো মাইনষ্যের।’ মা সেকথা অগ্রাহ্য করে দাদীকে স্মরণ করিয়ে দিতো, সবাই তাঁর মেজো ছেলের মতো নয়।
আমার মেজো কাকা আলিগড়ে পড়তে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ওখানে এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে থেকে গেছেন। দাদী পুরানো ঘায়ে আঘাত পেয়ে কেমন মিইয়ে যেতেন, আর বিড়বিড় করে কিসব বলতেন। আমার বাবার জগৎটা ছিল বই, ছাত্র এসব নিয়ে। মায়ের হাতে সংসারের ভারটুকু দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত মনে ওসবে ডুবে থাকতেন। বাবার সরকারি কলেজের সামান্য বেতনেই মা কোন রকমে সংসার চালিয়ে নিতেন। দাদাজানের করে যাওয়া বাড়িটা ছিল বলে রক্ষা। বাবা ছাত্র পড়াতেন ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ে পয়সা নিতেন না। বাবার এসবে মায়ের কোন অভিযোগ ছিল না। মা আর বাবার মধ্যে সমঝোতা ছিল অসাধারণ।
একজনের প্রতি অন্যজনের সম্মান আর ভালোবাসার তুলনা করার মতো তেমনটা এ জীবনে আর পাইনি। বাবা যখন ‘মম একটু এদিকে এসো তো’ বলে মাকে ডাকতেন, সে ডাকে যে কতটা দরদ মেশানো থাকতো সেটা ঠিক শব্দে বর্ণনা করা যায় না। মা ও সে ডাকে সমস্ত কাজ ফেলে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। মমতা মায়ের ডাক নাম।। বাবা মম নামে ডাকতেন। সিনেমা উপন্যাস থেকে বাবা-মায়ের এ জায়গাটি তাই খুব আলাদা। আমার এত ভালো লাগতো ওঁদের এই যুগলবন্দী সমঝোতা। মনে মনে ঠিক এমন একটা সম্ভাব্য ভবিষ্যত সম্পর্কের বায়না করতাম অদৃশ্য নিয়তির কাছে। সংসারের অভাব অনটনের সাথে সাথে যদি সম্পর্কগুলোও হতদরিদ্র হয়ে পড়ে, তবে তা খুব যন্ত্রণাময়। বাবা মাকে সে রকম কিছু পোহাতে হয়নি। তাঁরা খুব স্বাস্হ্যকর একটা সম্পর্ক কাটিয়ে গেছেন আমৃত্যু।
৩.
এইচ এস সি’তে মেজো আপু আমাদের অবাক করে দিয়ে বোর্ড স্ট্যান্ড করে ফেললো! সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা ইত্যাদিতে সরগরম তখন আমাদের শান্ত নিরিবিলি মমতাভবন। আপু খুব গুছিয়ে ইন্টারভিউ দিলো। একে দেখে কে বলবে বিগতদিনে এই মেয়ে কতটা অবুঝ আর বোকাটে ধরনের আচরণ করতো!
আমার ভাই বোনেরা খুব মেধাবী। আমিই কেবল মাথা মোটা গবেট ধরনের। রূপ কিংবা বিদ্যা দুটোই আমার বেলাতে এসে থমকে গেছে। আগেই বলেছি তো, আমার বেলাতেই প্রকৃতি কিংবা সৃষ্টিকর্তা মুঠো খুলতে কৃপণতার চূড়ান্ত করেছেন। পাশের বাড়ির বাবলুদা বাবার কান বাঁচিয়ে আমাকে ‘মাকালি’ বলে ক্ষ্যাপান। বাবা এধরনের কথায় ভীষণ রেগে যান। আমার শান্ত সুবোধ বাবাকে কেউ ছেলে মেয়ের তুলনা করে কিংবা গায়ের রঙ সংক্রান্ত কথা বললে বাবার রাগ দেখবার মতো হতো। বাবলুদার ভাগ্য ভালো যে, বাবার কানে সেটা যায়নি। মেজো আপু বার দুয়েক রাগ দেখিয়ে বাবুলদা কে সাবধান করেছে, তাতে বাবলুদার বয়েই গেছে। সে তার খেয়াল খুশিতে চলে। ওর এই বেপরোয়া ভাবটার জন্যই বাবলুদাকে বেশি পছন্দ করতাম।
আমাদের বাড়িতে বাবলুদার ছিল অবাধ যাতায়ত। আমার মেজো ভাইয়া আর বাবলুদা সমবয়সী ছিল, এক সাথেই পড়তো। স্কুলের পিকনিকে পুকুরে গোলস করতে গিয়ে মেজো ভাইয়া ডুবে মারা যায়। অথচ ভাইয়া খুব ভালো সাঁতার জানতো! বাবলুদার ম্যালেরিয়া হওয়ায় সে পিকনিকে যায়নি। বাবলুদার ‘মাকালি’ ডাকে আমি রাগ করিনা। অন্যেরা এমনটা ডাকলে আমি হয়ত ভীষণ কষ্ট পেতাম। আশ্চর্য কারণে বাবলুদার ডাকটা কেমন আদুরে শোনাতো। ক্লাস সেভেনের একটা মেয়ের এমন মনে হওয়াটা ইঁচড়ে পাকামি ছাড়া আর কী হতে পারে! খোদা আর কিছু না দিলেও বয়সের আগেই বয়স্ক একটা মন খুব যত্ন করে গুঁজে দিয়েছিলেন আমার ভেতরে।
বাবলুদা মাত্রই ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছে। ওর চশমার ওপাশে থাকা জ্বলজ্বলে চোখ দুটো আমার দিকে পড়া মাত্রই আমি যেন কেমন জমে যেতাম। তারপরও খুব চাইতাম বাবলুদা ঘনঘন আসুক আমাদের বাড়ি। আমাকে প্রিয় নামটা ধরে ডাকুক। ঘন ঘন আসতো ঠিকই। কিন্তু যত কথা সব বড় আর মেজো আপার সাথে, আমাকে পাত্তাই দিতো না। যাবার সময় সমনে পড়ে গেলে ‘কি রে মাকালি!’ বলে বেণীতে একটা হ্যাচকা টান দিয়েই হনহন করে বেড়িয়ে যেত।
খুব যত্ন নিয়ে দু’বেণী করে আমি পরের দিনও অপেক্ষায় থাকতাম। বাবলুদার জন্য অপেক্ষা করায় আমার যেন কোন ক্লান্তি ছিল না। যে আমি অংক কষতে গিয়ে যথেষ্ট মনোযোগের অভাবে ভুল করে বসতাম। সেই আমি অসীম ধৈর্য্যে বাবলুদার অপেক্ষায় থাকতাম। প্রকৃতির সাথে যেন এই অপেক্ষা নিয়ে একটা অদৃশ্য বাজি ধরা হয়ে গেলো সবার অলক্ষ্যেই। আজও তাই আমার অপেক্ষা ফুরালো না।
৪.
আমি এখন একটা বেসরকারি কলেজে পড়াই। বাবা মা এখন কেবলি পটে আঁকা ছবি হয়ে দেয়ালে রয়ে গেছেন। মমতাভবনের বাসিন্দা বলতে এখন কেবল আমি আর মোমেনার মা। আমাদের আশেপাশে সব ঝা চকচকে দালান উঠে গেছে। বেমানান ভাবে আমাদের বাড়িটা কেবল সেই আগের অবস্হাতেই থেকে গেছে। ডিভোলপারেরা এ জায়গাতে বহুতল বাড়ি ওঠানোর নানান রকমের টোপ দিয়েই রেখেছে। ভাবছি সুবিধা মতো কোন একটাতে রাজি হয়ে যাবো। ভাইয়া বলে দিয়েছে এ বাড়ির অংশে তার কোন অধিকার নেই। বড় আপা পারুল জানতে চেয়েছিল, ‘বাবা মায়ের স্মৃতি ভেঙে ফেলা ঠিক হবে শাপলা?’ স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে চায় বোকারা। বড় আপাটা ভীষণ রকমের বোকা। শুধু বড় আপাই বোকা, আমি নই? নিজের বোকামীটা খুব সর্ন্তপণে আড়াল করে এতটা দূর এসেছি। বাকী গন্তব্যের ব্যাপারে ভাবতে আলস্য লাগে। এখন আর কিছুই ভাবিনা।
মেজো আপা, দুলাভাই দু’জনই ডাক্তারী পাশ করে এখন অস্ট্রেলিয়ায় । মা তখন বেঁচে। বাবা থাকতেই মেজো আপার বিয়ে মোটামুটি পাকা হয়ে গিয়েছিল। বাবা চলে যাবার এক মাসের মাথায় মাও চলে গেলেন। বাবা হয়ত ওপাড় থেকেই ডাক পাঠিয়েছিলেন, ‘মম এদিকে এসো’ বলে। নইলে এত তড়িঘড়ি করে কেন চলে যেতে হবে তাঁর? মেজো আপার বিয়ের পরদিন থেকেই বাবলুদা উধাও। ওর আর ডাক্তারী পাস করা হয়নি।
বাবলুদাটাও ভীষণ রকমের বোকা আসলে। বোকাই যদি না হবে তবে শিমুল অর্থাৎ মেজো আপার যে বাবুলদা কে নিয়ে কোনো ভাবনাই ছিল না, এটা বুঝতে এতটা সময় নিল কেন! রাগ অভিমানের মতো ভালোবাসাও তো বুঝতে পারার কথা! বাবলুদা বুঝেনি এ বাড়ির কোন মেয়েটির চোখে তার জন্য জমা রয়েছে গভীর তৃষ্ণা?
মেজো আপার গায়ে হলুদের দিন বাবলুদা এলো না। মাসিমায়ের কাছ থেকে জানলাম বাবলুদার জ্বর। হলুদের হুল্লোড় ফেলে আমি দেখতে গেলাম। বাবলুদা ওর ঘরেই শুয়ে ছিল। আমি যেতেই বিছানা থেকে উঠে বসবার চেষ্টা করলো। কপালে হাতটা রাখতেই চমকে গেলাম। ‘এত জ্বর তোমার!’ আমার হাতটা কপালে চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললো ,’তোকে মাকালি ডাকাটাই কাল হলো বুঝি! দশহাতে জড়াতে চাস তাই, না? আমাকে ধরে রাখা এত সোজা!’
আমি বোকার মত কেঁদে ফেলে বলেছিলাম, ‘কিছু চাইনা আমার, শুধু তুমি ভালো হয়ে ওঠো।’ পরদিনই বাবলুদা বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেলো। মাসিমা আমাকে মুখ বন্ধ একটা সাদাখাম তুলে দিয়ে স্বগোক্তির মতো বলেছিলেন, ‘ভগবান আর বাঁচতে মন চায় না….’
অপরাধীর মতো ধীর পায়ে বাড়ি ফিরে ছাদে ওঠে চিঠিটা পড়তে বসেছিলাম। কতক্ষণ কেটেছিল ছাদে খেয়াল নেই। বড় আপা আমাকে ঘরে নিয়ে আসে। জ্বরে পুড়ছে তখন আমার শরীর! সিম্প্যাথিটিক রিয়াকশন কী একেই বলে? মেজো আপার বিয়ের দিন আকাশ পাতাল জ্বর নিয়ে আমি বাড়িতে থেকে গেলাম। আমি জ্বর নিয়েও যেতে চেয়েছিলাম। মা কিছুতেই রাজি হলো না। কেন, কে জানে!
৫.
জীর্ণ, প্রায় দুবোর্ধ্য একটা চিঠি আমি এতটা যত্নে কেন আগলে আগলে রাখি? যে চিঠির কোথাও স্পষ্ট অক্ষরে ভালোবাসার উচ্চারণ কিংবা ফেরার প্রতিশ্রুতি নেই। সে চিঠি কেন বাঁচবার তৃষ্ণায় রাখে আমাকে! কেন অপেক্ষায় রাখে!! এসব যৌক্তিক প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই। জানতেও চাই না। শুধু জানি…নিরন্তর অপেক্ষার প্রহর গুনে গুনে আমাকে জেগে থাকতে হবে। যদি কোনো দিন বাবলুদার ঘরে ফেরার ইচ্ছে জাগে!
মুখস্থ হয়ে আসা চিঠিটায় আবার চোখ রাখি।
“আমি আজ প্রেমের জন্য
ফেলে যাচ্ছি আরাম।
জেগে থাকার জন্য
ফেলে যাচ্ছি ভাত ঘুম,
যন্ত্রণার জন্য ফেলে যাচ্ছি সুখ
জ্ঞানের জন্য ফেলে যাচ্ছি অন্ধকার,
আনন্দের জন্য ফেলে যাচ্ছি সাফল্য
অমৃতের জন্য ঐশ্বর্য।”
***
সমস্ত অতীত কোলে নিয়ে অপেক্ষা নামের ধূসর প্রান্তরে আমি বসে থাকি, বসে থাকি, বসেই থাকি…….
- গল্পে ব্যবহৃত শিরোনামটি অনুপম রায়ের একটি গান থেকে নেয়া।
নাহার তৃণার ছোটগল্প ফাঁকা ফ্রেম আর অকেজো হাতঘড়ি
পড়ে কেমন লেগেছে কমেন্টে লিখুন।
আরও গল্প পড়ুন: