ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল | পঞ্চম কিস্তি

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

অভিযাত্রী ডট কমে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে তরুণ লেখক মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল। আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি


যখন থামবে কোলাহল

(৫র্থ কিস্তি)


দুপুর একটা বেজে গেছে। শীতের দুপুরের গায়ে লাগা রোদটা নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ‘রেডিয়েন্ট হাউস’এর চার তলাতেও। সেখানে রেজা সাহেব তার বেডরুমের রকিং চেয়ারে বসে আছেন মিনিট দশেক হবে। এই সময়টাতে সাধারনত তিনি ক্লাসিকাল গান শোনেন, নয়তো অফিসের কারো সাথে কথা বলেন। এর কোনটা মিস হলে তিনি তার মেয়ে পার্শিয়াকে ফোন দিয়ে কথা বলেন। পার্শিয়া যুক্তরাষ্ট্র থাকে, সেখানে এখন রাত দুপুর, পার্শিয়া এ সময়টাতে ঘুমুতে যায়। এই সময় তাকে ফোনে অনেকক্ষণ পাওয়া যায়। কিন্তু আজ তিনি এর কোনটাই করেননি। তার মন কিছুটা অস্থির, দুদিন ধরে ছেলে ইরাজের সাথে কথা হচ্ছেনা। সেটাও তেমন কিছু হত না, যদি সকাল থেকে ফোনটা অফ না থাকতো।

রেজা খান শহরের হাতে গোনা কয়েকজন ধনী ব্যবসায়ীদের একজন। গাজীপুর আর ভালুকায় তার কয়েকটা নিট গার্মেন্টস কম্পোজিট আছে। সেসব থেকে বাইরে ব্র্যান্ড পোশাক এক্সপোর্ট করে তার কয়েক কোটি টাকার একটা আয় আসে সব খরচ বাদেও। বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ প্রায় সব টপ লেভেলের এসোসিয়েশনের রানিং কমিটিতে তার নাম আছে। তবু তার অর্থসম্পদ সম্পর্কে লোকমুখে বিভিন্ন রকম কথা প্রচলিত আছে। কেউ ভাবে তার দেশের বাইরে অস্ত্রের ব্যবসা আছে, কেউ মনে করে সরকারের মদদে আশুলিয়াতে তার কয়েক বিঘা জমির দখল আছে আবার অনেকের ধারনা অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসাও আছে।

রেজা এসব নিয়ে চিন্তা করেন না, ডাক্তারের মানা আছে। প্রেসার তার কন্ট্রোলের বাইরে থাকে এমনিতেই, ফ্যাক্টরির শিপমেন্ট নিয়ে প্রতিমাসে চেয়ারম্যান হিসেবে এখনো তদারকি করতে হয়। তার মধ্যে লোকের কথা কানে নিয়ে তিনি এতো চাপ নিতে পারবেন না। যদিও প্রতিদিন তার চাপ নেয়ার মত ঘটনা ঘটে চলেছে অহরহ।

রেজা একটু কেশে ডাক দিলেন, ’রিচি, রিচি!’

পাশের ঘর থেকে একটা বয়স্ক লোক এসে বলল, ’স্যার, আপা তো বাইরে গেছে।’

রেজা লোকটির দিকে তাকালেন। চেহারা ভেঙে গেছে, ক্লান্তির ছাপ আছে। গায়ে রেস্টুরেন্টের ওয়েটারদের মত নীল সাদা ড্রেস। এই দুপুরেও ফর্মাল সাজ দেখে তার ভালই লাগলো, তবে তিনি তাকে ঠিক চিনতে পারছেন না।

‘তুমি কে? কে তোমাকে ডেকেছে?’ রেজা কিছুটা ভরাট কন্ঠে বললেন।

‘স্যার, আমি আমিন। আপনার দেখাশুনার জন্য আছি।’ লোকটি মুখস্থের মত বলল যেন প্রতিদিন তার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।

‘আমার দেখাশুনার জন্য তো আরেকটা ছেলে ছিল, কি যেন নাম, কোন সায়েন্টিস্টের নামে, ভুলে গেছি।’

‘স্যার, ওর নাম নিউটন। সে নিচে আছে, রোস্টার ডিউটিতে। আমি এই সপ্তাহ পরে নিচের তলায় গেলে সে আবার এখানে আসবে।’

‘এই রোস্টার সিস্টেম কে চালু করলো?’

‘এটা আমাদের এজেন্সীই বলেছে।’

‘ভাল। তা তোমার নাম কি বললে? জামান?’

‘না স্যার, আমিন। উদ্দিন আমিন।’

‘কিহ? আমিনের আগে উদ্দিন কেন?’

‘স্যার, এজেন্সিতে আমাদের লাস্ট নেম আগে।’

‘ভেরি ইমপ্রেসিভ।’ রেজা আমিনের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বললেন।

‘তোমাদের সিকিউরিটির মহসিন সাহেব কি নাম্বার চেন্জ করেছে?’

‘মহসিন স্যার? কই না তো’ আমিন ভাবুকের মত ভাব নিল।

‘একটু জেনে আমাকে জানাও, পারলে ওনাকে আসতে বল।’

আমিন কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল, ’কোন ঝামেলা হয়েছে স্যার?’

‘না না, আমি অন্য ব্যাপারে কথা বলব।’

‘আচ্ছা, আপনার কিছু লাগবে?’

‘না, তুমি রিচি আসলে ওপরে পাঠিয়ে দিও।’

আমিন মাথা নেড়ে চলে গেল। রেজা এজেন্সির সার্ভিসে খুব অবাক হলেন। আজকাল এরা এক বাসাতেও বাড়িওয়ালার টেস্ট বুঝে ভেরিয়েশন আনতে চেষ্টা করছেন। তবে রিচি ভরদুপুরে কোথায় গেল বুঝতে পারছেন না। মেয়েটা মাস ছয়েক হল আছে। ডিসেন্ট, কাজের ভাল আগে পিছে বুঝে, ভাল শিডিউলিং করে, সুন্দরী আবার এমবিএ করা। সমস্যা হল মেয়েটার মনে, বাইরে থেকে সেটা চট করে ধরতে পারা যায় না সহজে, রেজা পেরেছেন। সময় সুযোগ বুঝে তিনি এটা নিয়ে একদিন কথাও বলবেন বলে ঠিক করেছেন।

ইরাজ এ বাসায় থাকে না। বিদেশ থেকে এসে তার কথা ছিল রেজার ব্যবসা দেখবে, কয়েকবার তাকে সেখানে নিয়েও যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তার মন বসেনি। দু’মাস ধরে সে বাসায় থাকে না। ফোনে কয়েকদিন পরপর কথা হয়। তাকে ফোন দিলে সে রিসিভ করেনা, তবে কিছুদিন পরপর সে নিজেই ফোন দেয়। কিন্তু গত কয়েকদিনে সে একবারও ফোন দেয়নি, কাল রাত থেকে ওর ফোন অফ পাওয়া যাচ্ছে। রেজা অবশ্য ইরাজের অবস্থান জানেন, পুলিশের একটা ডিপার্টমেন্ট তাকে এক মাস ধরে চেক করে রেখেছে। এক্সাক্ট না জানলেও সে গাজীপুরের ভাওয়াল গড়ের একটা এলাকায় আছে এটা জানা গেছে। রেজা চান না জোর করে তাকে নিয়ে আসতে, কারণ ইরাজ খুব জেদী ছেলে। যখন যা করতে চেয়েছে, শেষমেষ তার কথাই শুনতে হয়েছে রেজার। তবে ফোন অফ পাওয়া চিন্তার বিষয়ই বটে। ইরাজের ব্যাপারে রিচিকে একটা কাজ দেয়া দরকার।

রকিং চেয়ারে বসে রেজা তিনটি বিষয়ে ভাবছেন।

এক. ইরাজকে বাসায় নিয়ে আসতে হবে। দুই. পার্শিয়ার সাথে তার আমেরিকান স্বামী রিচার্ডের সাংসারিক অবস্থা ভাল যাচ্ছে না, সেটা সলভ করতে হবে। আর তিন. গেল মাসের শিপমেন্ট দেরি হয়ে যাচ্ছিল প্রায়, সেটা নিয়ে সবার সাথে বসতে হবে। তার আগে শিডিউল জানতে হবে।

ফোনটা বেজে উঠে, স্ক্রিনে দেখা গেল আজিজ মির্জার ফোন। রেজা কিছুটা বিরক্ত হলেন। দুপুরবেলা ফোনে কিছু লোকের সাথে তার কথা বলতে চরম অসহ্য লাগে। আজিজ মির্জা তেমন। তার পাশের মহল্লারই লোক, এমপি নির্বাচন করতে চাচ্ছে। রেজা নিজেও নির্বাচন করতে পারেন। তাই আজিজ তাকে বারবার ফোন দিয়ে কদিন থেকে খুব জ্বালাচ্ছে।

‘হ্যালো, রেজা সাহেব বলছেন?’ রিসিভ করতেই আজিজের ভাঙা গলা শোনা গেল।

‘আমার নাম্বারে যেহেতু ফোন দিয়েছেন, তাহলে আমিই বলছি।’ রেজা বললেন

‘ভাই সাহেব দেখা যায় ভালই মস্করা করেন। গুড মরনিং।’

‘গুড মরনিং। কেন ফোন দিয়েছেন যদি বলতেন, আসলে আমি একটু বিজি।’

‘ওহো, ডিস্টার্ব করে ফেললাম। শর্টে কথাটা বলেই ফেলি।’

আজিজ শর্টে বলতে পারলেন না, ইতিহাস বলতে লাগলেন।

‘দেখেন রেজা ভাই, সেই ল্যাংটা কাল থেকে পার্টি করি। আন্দোলন সংগ্রামে আমরাই সবসময় আছি। পার্টির বিপদে আপদে রাস্তায় নেমে পড়ি। আমার পেছনে অনেকগুলা পোলাপান আর তাদের ফ্যামিলি আছে। এখন ইলেকশন নমিনেশনে আপনারা টাকার কুমীর যদি এসে ভাগ বসান, তাহলে আমরা তো বেকায়দায় পড়ে যাই। আমাদের তো আর পার্টি ফান্ডে এত টাকা দেয়ার অবস্থা নাই। আমরা হলাম শ্রম দেওনাআলা লোক।’

রেজার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। সেটা না বুঝতে দিয়ে বললেন, ’দেখুন, আমি কিন্তু নমিনেশন চাইনি। বরং আমাকে পার্টি থেকেই ফরম নিতে বলা হচ্ছে। আর পার্টির জন্য এত কিছু করলে তাদের সিদ্ধান্তের জন্যই ওয়েট করেন। আমাকে বারবার ফোন দিলে তো লাভ নাই। ভাল থাকবেন, বাই।’

আজিজ আরো কিছু বলার আগেই রেজা ফোন কেটে দিলেন।

চেয়ারে বসে থাকতে ভাল লাগছে না আর। উঠে ঘরে দুই পাক হেটে হঠাৎ এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালেন। পারভীনের ছবিটা দেয়ালে বড় করে টাঙানো। ছবিতে হাত রেখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। সংসারে গৃহিনী না থাকলে যে ঝামেলাগুলো হয় তার সবকটি পেরিয়েই ব্যবসা সামলে রেজা আজকের অবস্থানে। কিন্তু ছেলেমেয়েকে নিজের কাছে নিজের মত করে রাখতে পারলেন না।

‘স্যার, আসবো?’

দরজা থেকে একটা মেয়েলি গলা শোনা গেল। সেখানে রিচি দাঁড়িয়ে। রেজা কিছুটা চমকে গেলেন। একবার রিচির দিকে তাকিয়ে আবার পারভীনের ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। দুজনের চোখের দারুন মিল। বিষয়টা আগে খেয়াল করেননি।

রেজা এভাবে তাকিয়ে থাকাটা ঠিক মনে করলেন না। কথা বললে পরিবেশটা হালকা হবার কথা।

‘রিচি, ফরেন মিনিস্ট্রির সেমিনারটা বাদ করার দরকার নেই। আমি যাবো।’ রেজা বললেন।

রিচি কিছুটা চমকে তাকালো। সে বলল, ’স্যার, ডিসিশান চেন্জ করলেন যে?’

‘আসলে শিডিউল নিতে যে ছেলেগুলো এসেছিল তারা আমাকে পেলে অনেক খুশি হবার কথা। আমি না গেলে ওদের দু-একটা স্পন্সর আসতে চাইবে না, এরেন্জমেন্টে ঘাটতি হবে।’

রিচি অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি এসব কখন ভাবলেন, স্যার?’

রেজা মুচকি হেসে তার কালো জুসে চুমুক দিলেন।

‘রকিং চেয়ারে দোল খেয়ে ভেবেছি।’

রিচি হেসে ফেললো। এমন সময় একটা কল বেজে উঠলো। মোবাইল হাতে নিয়ে রেজা দ্রুত কি যেন ভাবতে লাগলেন, একটু আড়ালে সরে গেলেন। রিচি বুঝতে পারল না তার থেকে আড়ালে গিয়ে কথা বলার কি আছে।

রেজা ফোন রিসিভ করলেন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে, এখান থেকে বাসার বাগান আর গেটটা সামনে পড়ে। রিসিভ করতেই একটা দরাজ গলার মহিলা কন্ঠ।

‘ফোন ধরতে এত দেরি কর কেন?’

রেজা বললেন, ‘ফোনের কাছে ছিলাম না।’

‘একদম মিথ্যা বলবা না। আমার কথা বাদই দিলাম। বাসায় কি ওই মাগি মেয়েটাকে পেয়ে ছেলেটার কথাও ভুলে গেছ? কথা বলিস না কেন? ’

রেজা কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি জানেন এখন যা ই বলবেন প্রতুত্তরে সব ‘তুই’ সম্বোধনে আসবে।

‘পারভীন, ভদ্রভাবে কথা বল’ রেজা খুব শান্তস্বরে বললেন।


(চলবে)

উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top