ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল | সপ্তম কিস্তি

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

অভিযাত্রী ডট কমে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে তরুণ লেখক মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল। আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি


যখন থামবে কোলাহল

(সপ্তম কিস্তি)


দরজার সামনে কোন পুরুষ কিংবা মহিলার শেপ আঁকা থাকলে তা সাধারনত তাদের টয়লেট বুঝায়। কিন্তু রিচি যে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে তাতে পুরুষ মহিলা দুটোরই শেপ একসাথে। এটা ঠিক কিসের রুম বুঝতে পারছে না সে। ভেতর থেকে কিছু চাপা আওয়াজও আসছে, মনে হয় কয়েকজন পুরুষ মহিলা এখানে কথা বলছে। কোন বেলও নেই যে বাইরে থেকে কেউ জানান দিতে পারে, আবার সব অফিসে দরজায় নক করা ভালো চোখেও দেখা হয় না। ইন্টারভিউ দিতে এসে রিচি কোন ঝামেলা করতে চাচ্ছে না। আরেকটু অপেক্ষা করা যায়। সে করিডোর দিয়ে হেটে বড় কাচটার সামনে এলো, এখান থেকে রাস্তায় ব্যস্ত হয়ে চলা গাড়িগুলো খুব ছোট দেখা যায়। উপর থেকে দেখলে রিচির মাথা ঘুরায়, তার ছোটবেলা থেকে এক্রোফোবিয়া আছে। বেশি উপরে উঠলে তার মনে হয় যেন সে নিচে পড়ে যাবে। বাবার সাথে সে একবার বান্দরবান গিয়েছিল। সেখানে চিম্বুক পাহাড়ে উঠে খুব দৌড়াদৌড়ি করছিল, পরে যখন সে নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে অনেক উপরে আছে সে তখন জ্ঞান হারায়। এরপর সে আর কখনো পাহাড়ে যায়নি।

‘আপনি কি মিস ইশরাত সুলতানা?’ কেউ একজন পেছন থেকে বলল। রিচি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো একজন সুট টাই পড়া যুবক। বয়স খুব বেশি হলে তিরিশ হবে। নীল রংটা রিচির একদম ভালো লাগে না, কিন্তু এই ভদ্রলোককে নীল রংয়ের সুটে দারুন লাগছে, মনে হচ্ছে এটা তার চেয়ে কাউকে বেশি মানাতো না। রিচি অনেকদিন পরে তার ফরমাল নাম শুনে চমকে গেল, তারপর কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, ‘জ্বি, আমি।’

‘প্লিজ ভেতরে আসুন।’ রিচিকে লোকটি সেই রুম দেখিয়ে দিল। রিচি ফাইলটা বুকে চেপে লোকটিকে ফলো করতে করতে রুমের সামনে যেতেই আরেকটা মেয়ে বেরিয়ে গেল। সেও তার মতই ইন্টারভিউ দিতে এসেছে আগের সিরিয়াল নাম্বারে। রিচি ভেতরে ঢুকে কয়েকটি রুমের পাশ দিয়ে একদম সামনের রুমে পৌছে গেল। সেখানে তিনজন লোক আর একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা বসে আছেন।

রিচি ‘মে আই সিট?’ বলে দাড়িয়ে রইল, মহিলাটি তাকে বসতে ইশারা করলেন। এ ধরনের অফিসে রিচির ইন্টারভিউ অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর না। কেননা, এখানে মেধার চেয়ে স্মার্টনেস কে বেশি দাম দেয়া হয়। আবার ওভার স্মার্ট হলেও তারা বুঝে ফেলে। তাই সে নিজেকে যতটা পারে নরমাল রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না এদের মধ্যে সবার বস কে, যে মূল কলকাঠি নাড়ে। দেখা যায়, অনেক সময় রিচি সব ভাল করার পরেও সোজাসুজি বসের দিকে না তাকানোটা তার একটা দোষ ছিল আর পরে তাকে হয়তো এজন্যে আর ডাকা হয়নি।

‘আপনার এক্সপেরিয়েন্স হিসেবে আপনি একজনের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন, তার বিজনেস এসিসটেন্ট। রাইট?’ মহিলা রিচির দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

‘জ্বি, গ্রিন ড্রিম গ্রুপের চেয়ারম্যান মিস্টার রেজা খানের এসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করছি।’ রিচির কন্ঠ কেমন যেন বসে গেল কথাটা বলতে গিয়ে।

‘কত দিন ধরে আছেন?’

‘ছয় মাস।’

‘তা ছাড়তে চাচ্ছেন কেন?’

রিচি এই প্রশ্নটির জন্য তৈরি ছিল, কারন নতুন চাকরিদাতারা এটা জিজ্ঞেস করবেই।

‘আমি আসলে আমার একাডেমিক রিলেটেড জব করতে চাচ্ছি। যেমন, এখানে বিজনেস স্ট্যাটেজিক প্ল্যানার হিসেবে।’

‘আচ্ছা। তা ওখানে কত পেতেন স্যালারী? ইফ ইউ ওয়ান্ট টু সে। আমি ফোর্স করছি না।’ মহিলাটি প্রশ্ন করে পাশের আরেকজনের দিকে তাকালেন। রিচির খুব বিরক্ত লাগছে, মহিলা একাই প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। একটা প্রশ্নও এখন পর্যন্ত তার একাডেমিক না, তার যোগ্যতার যাচাইয়েরও না। বেতনের ব্যাপারেও সে ভেবে এসেছে একটু কমই বলবে। কারন, রেজা খানের ওখানে তার বেতন ভালই, কিন্তু এই পোস্টের জন্য বেতন কমিয়ে বলতে হবে।

‘আমি টুয়েন্টি ফাইভ থাউজ্যান্ড পেতাম।’ রিচি বলে একটু পানি খেলো সামনে রাখা গ্লাস থেকে।

মহিলা তার আশেপাশে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘আই থিঙ্ক ইট্স ডান। আমরা আপনাকে জানাবো।’

রিচি সে হাসির জবাব দিল নিজেও মেকি হেসে। তারপর উঠে চলে যেতে চাইলে মহিলা বললেন, ‘তবে মিস. ইশরাত, আপনি প্রিপারেশন নিতে পারেন। আমরা ফরমালি জানাবো ভেরি সুন।’

রিচি বেরিয়ে এল। মহিলার শেষ ইঙ্গিতের মানে, তার চাকরিটা এক প্রকার কনফার্ম। তবে রেজা খানের চাকরিটা কেন সে ছাড়তে চাচ্ছে আসলে সে তা নিজেও জানে না।

রেডিয়েন্ট হাউসে যখন পৌছলো তখন বিকেল হয়ে গেছে। বাড়িটা সুনসান লাগছে। বেল বাজাতেই নিউটন এসে দরজা খুলে দিল। তার মুখে হাসি। সাধারনত এই ছেলেকে রিচি কখনো হাসতে দেখেনা। কোন কারন আছে কি? তাছাড়া বাসায় লোক মাত্র পাঁচ ছয়জন। কেউ রান্নাঘরে তো কেউ রেজা সাহেবের বাগানে না হয় তার ফরমায়েশি কাজ করে। এরা সারাদিনে দশ মিনিটও পরস্পর কথা বলতে পারে না। নিউটন দরজা খুলেই বলল, ’স্যার আপনাকে খুজঁছিল। আসলেই তার ঘরে যেতে বলেছে।’

রিচি একটা মৃদু হাসি দিল। হাউস কিপিং এজেন্সিগুলো তাদের লোকদের ভালই ট্রেনিং দিচ্ছে। কি সুন্দর শুদ্ধ ভাবে কথা বলল। হয়তো এই ছেলেটাই অন্য কোন চাকরি করলে ভাষার ব্যাপারে এতটা মনোযোগী হত না।

উপরের রেজা খানের রুমের পর্দা সরানোই ছিল। হাউস কিপিং এজেন্সির মহসীন সাহেব এসেছেন। রিচিকে দেখেই দুজন ফিরে তাকালো। তাকে বসতে ইশারা করলেন রেজা, রিচি জানালার কাছে রাখা টুলটায় বসে বাইরে তাকিয়ে থাকলো। বাইরে খুব ঘোলাটে আবহাওয়া, মনে হচ্ছে এই বুঝি বৃষ্টি নেমে যাবে, কিন্তু নামবে না। শীতের বৃষ্টি খুবই সাংঘাতিক। রিচির মনে পড়ে একবার ক্লাস সেভেনে থাকতে ভিজে জ্বরে তার তিনদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল, একটা এনুয়াল পরীক্ষাও সে মিস করেছিল। কি ঠান্ডা পানি। মনে হয় বরফ কুচি কুচি হয়ে গায়ে বিধে যাচ্ছে। এরপর আর শীতে বৃষ্টিভেজা হয়নি।

মহসীন কিছু কাগজপত্র এগিয়ে দিতেই রেজা সাইন করলেন। ভদ্রলোকের মুখে হাসি, হাসলে তার চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটা কেমন লোকাল বাসগুলোর মত কাঁপে। তিনি লাল রংয়ের একটা স্যুট পরে এসেছেন। তাকে দেখতে সঙের মত লাগছে, রিচির খুব হাসি পাচ্ছে। মহসীন সাহেব উঠতে গিয়ে বললেন, ‘ডোনেশনের রিসিট আমি কার কাছে পাঠাবো যদি বলে দিতেন।’

রেজা রিচিকে দেখিয়ে মহসীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ’রিচি আমার কার্ডটা দিয়ে দাও, আর তোমার মেইল এড্রেসটাও দিয়ে দিও। আপনি দুটোতেই দেবেন। তবে আমার কথাটা মাথায় রাখবেন, ডোন্ট ব্লাশ ইট।’

রিচি কার্ড দিল আর মেইল এড্রেসটা একটা প্যাডের পেজে লিখে দিল। মহসীন নিতে গিয়ে রিচির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। লোকটার হাসি খুব বিদঘুটে, যেন রিচিকে দেখে তার পুরনো কোন জোক্স মনে পড়ে গেছে।

মহসীন চলে যেতেই রেজা রিচিকে বললেন, ’তোমার সাথে কিছু কথা বলব।’

রিচি সোফায় বসতে গিয়ে বলল, ’শিউর স্যার।’

‘কথাটা তোমাকে আগেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি জব নিয়ে সাটিসফাইড কিনা। তুমি বলেছো ঠিক আছে। তাইতো?’

রিচির কিছুটা অস্বস্তি লাগছে। তার হুট করে কেমন গরম লাগছে।

সে মাথা নিচু করে আস্তে বলল, ’জ্বি স্যার।’

রেজা খান চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, ‘তোমার আজকের ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে?’

রিচি এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। রেজা কীভাবে জানলেন ইন্টারভিউয়ের কথা তা কিছুতেই মাথায় আসছে না, সেটা ভাবার সময়ও না। আর তিনি যদি কোনভাবে জানেনও তাতে কি? এভাবে ব্যক্তিগত ব্যাপারে তিনি কেন জিজ্ঞেস করবেন।

‘ইন্টারভিউ। মানে। আপনি জানেন?’ রিচি আমতা আমতা কেন করছে তা সে বুঝতে পারছে না। সেতো কোন অপরাধ করে বসেনি। সে বসা থেকে দাড়িয়ে গেল।

রেজা তার কাছে আসতে লাগলেন। বললেন, ‘দেখো রিচি। এত বড় বিজনেস সামলাতে গেলে আমাকে ভাল মন্দ অনেক কাজ করতে হয়। প্রতিপক্ষ হিসেবে যারা মার্কেটে আছে তাদের ব্যাপারে আরো ভালোভাবে জানতে হয়। যতটা না তাদের শক্তিকে তার চেয়ে বেশি জানতে হয় তাদের উইকনেসগুলো।’

রেজা সামনে এগুতে লাগলেন আর রিচি একটু পিছিয়ে গেল। তিনি বলতেই থাকলেন, ‘তুমি যে অফিসে গিয়েছিলে সেটা আমার প্রতিপক্ষদের একটা। তাই সেখানে আমার লোকও আছে। তোমাকে একটা হ্যান্ডসাম ছেলে ভেতরের রুমে নিয়ে গিয়েছে, তাইনা?’

‘হুম।’ বলতে গিয়ে রিচির গলা ধরে এলো। রেজা রিচির আরো কাছে চলে এসেছেন, তাকে মদ্যপ ট্রাকচালকের মত লাগছে। রিচির মনে হচ্ছে আজ তাকে এই ট্রাকের নিচে পিষে ফেলা হবে। তার নিজেকে এত অসহায় লাগেনি কখনো।

‘ওই ছেলেটার নাম সাদমান। ও আমার লোক। সে ইন্টারভিউ লিস্টে তোমার নাম, সিভি দেখেই শিউর হয়েছে তুমি আমার এসিসট্যান্ট। আমি আগেই জানতাম তুমি আমার চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাচ্ছো, তাই সেদিন কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম।’

রেজা রিচির খুব কাছে চলে এলেন, রিচির পেছনে এখন শুধু দেয়ালটা। এখান থেকে কেউ তার চিৎকারও শুনলেও আসবে না। সে তার শরীর ছেড়ে দিলো। রেজা তার কোমড়ে হাত রাখলেন আর মুখটা নামিয়ে রিচির মুখের এক ইঞ্চি সামনে নিয়ে এলেন।

রিচি অনেক কষ্টে বলল, ‘স্যার, কি করছেন। আমার বাসায় যাওয়া লাগবে।’

রেজা বললেন, ’তোমার চাকরিটা ওখানে হবে সেটা তুমি নিশ্চই বুঝতে পেরেছো। শুধু বুঝতে পারোনি কোন যোগ্যতায় হবে। সবাই সেখানে ধরেই নিয়েছে, আমি তোমাকে সেক্সুয়াল এসাল্ট করেছি এই ছয় মাসে। এই মিথ্যেটা নিয়ে যাবার দরকার কি, আজ সত্যিটা নিয়ে যাও।’

রিচি খেয়াল করলো তার শরীর পুরো ঘেমে গেছে। একবার তাকিয়ে সে পড়ে গেল রেজা খানের গায়ে।


(চলবে)

উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top