মৃত্যুর পরও দাফন করা হয়নি যে সকল নেতাদের 

দাফন করা হয়নি যেসব নেতাদের

প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে দাফন করা হয়েছে যাদের 



জ্ঞান আহরণের জন্য সুদূর চীন ভ্রমণ করি ২০০৯ সালে। বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আয়োজিত উচ্চতর প্রশাসন ও উন্নয়ন (ACAD- Advanced Course on Administration and Development) কোর্সের ৪৫ জন প্রশিক্ষণার্থী আর কোর্স ম্যানেজমেন্টের আমরা ৪ জন দশ দিনের শিক্ষা সফরে যাই।

আমরা জানতে চেষ্টা করি, কি করে এই নাক বোঁচা জাতি সারা পৃথিবীর প্রায় সব মার্কেট দখল করে নিয়েছে। সে রহস্য আমরা যদিও ভেদ করতে পারিনি, তবুও  ১০ দিনে চীনের বেইজিং শহরের প্রায় সব দর্শনীয় স্থান দেখে ফেললাম।

এদের মধ্য ফরবিডেন প্যালেস, সামার প্যালেস, গ্রেট ওয়াল, অলিম্পিক স্টেডিয়াম (২০০৮), মাও সে তুং মোসেলিয়াম (Mao Zedong’s Mausoleum), চীনের অ্যান্টি করাপশন অফিস, একটি  বৃদ্ধাশ্রম এবং বাংলাদেশ দূতাবাস উল্লেখযোগ্য।

আমি সাধারণত কোথাও যাওয়ার আগে কি দেখবো সে সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্য ইন্টারনেটে একটু সার্চ করে দেখে নেই। সারাক্ষণ দৌড়ের উপরে থাকার কারণে আর ইন্টারনেটে দেখা হয়নি মাও সে তুং মোসেলিয়ামে গিয়ে কি দেখব।


চীনের বেইজিং শহর  


দাফন করা হয়নি যেসব নেতাদের
মাও সে তুং মোসেলিয়ামের সামনে লেখিকা

সকালে আমরা হালকা বৃষ্টির মধ্যে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে প্রায় ৩ কিলোমিটার লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম।  লাইনে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হচ্ছি আর ভাবছি ঘরের ভিতরে কবর এ আবার দেখার কি আছে? এ তো লালবাগের কেল্লায় পরি বিবির মাজার বা তাজমহলের ভিতরে মমতাজের সমাধির মতই।

যাইহোক, এক সময় ঘরে ঢুকলাম।  ঘরের ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। মাঝারি সাইজের একটা ঘরে ক্রিস্টাল কফিনে মাও শুয়ে আছেন। আমরা এক দরজা দিয়ে ঢুকে কফিনের পাশ দিয়ে হেঁটে অন্য একটা দরজা দিয়ে বের হলে গেলাম। ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল উনি ঘুমিয়ে আছেন।  

আমি মনে মনে ভাবলাম, চৈনিক জাতি এত নকলবাজ যে মাওয়ের ডামি বানিয়ে রেখেছে দিয়েছে। আবার এতটা বাস্তবসম্মত করেছে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি। বের হয়ে আমার এক সহকর্মীকে আমার ভাবনার কথাটা বললাম। ও বলল, “না ম্যাডাম, এটা মাওয়ের মৃতদেহ। দাফন করেনি, জনগণের দেখার জন্য রেখে দিয়েছে।”

মনে হল আমি ফিরে গিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি সত্যিকারের আপনি, না ডামী? একটা লিফলেট নিয়ে পড়লাম। তাতে লেখা আছে ভিয়েতনামী নেতা হো চি মিনের দেহও রাখা আছে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে একইভাবে। চীন ভিয়েনাম থেকে টেকনোলজি এনেছে।

এবার আমার মনে পড়লো অনেকদিন আগে পেপারে পড়েছিলাম যে লেনিনের দেহ মস্কোতে রাখা আছে এবং প্রতিদিন তাঁর সু্যট বদল করা হয়।  প্রতিদিন সু্যট বদলের ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে, কি জানি হতেও পারে, রাজা সম্রাটদের ব্যাপারই আলাদা।

সারা পৃথিবীজুড়ে এরকম অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি আছেন যাদেরকে মৃত্যুর পর কবর দেওয়া হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মমি বানিয়ে শুধু রেখেই দেওয়া হয়নি বরং জনসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে। এমন কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে আমার আজকের আলোচনা। 


মাও সে তুং


মাও সে তুং এর জন্ম ১৮৯৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর। তিনি গণচীনের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত। তিনি চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন ১৯৩৫ সাল থেকে আমৃত্যু। তিনি পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৮২ বছর বয়সে মারা যান।

মারা যাওয়ার আগে তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি মারা গেলে তাঁকে যেন দাহ করা হয়। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পরে পার্টির লোকজন ও তাঁর স্ত্রী তাঁর মরদেহ জনগণের প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।  

দাফন করা হয়নি যেসব নেতাদের
ক্রিস্টাল কফিনে মাও সে তুং এর মরদেহ। ছবিঃ লেখিকা 

এর পরে আরো পড়ালেখা করে যা জানলাম তা হল ১৯৫৩ সালে মারা যাওয়ার পরে স্ট্যালিনের দেহ ও এভাবে রাখা হয়েছিল । আট বছর পরে রাশিয়াকে স্টালিনমুক্ত করার উদ্দেশ্যে তাকে দাফন করা হয়।


ভ্লাদিমির লেনিন


মস্কোর রেড স্কোয়ারে লেনিনের দেহ রক্ষিত আছে একইভাবে । লেলিনকে ২০২৪ সালে তার মৃত্যুর ১০০  বছর পূর্তিতে দাফন করা হবে। তার শরীরে ব্যাক্টেরিয়া পচন ধরাতে চেষ্টা করছে। এই পচন থামানোর জন্য মস্কোতে কিছু বিজ্ঞানী আর একটা গবেষণাগার সদা ব্যস্ত। মৃতদেহ বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার করে সংরক্ষণ করা হয়। অত্যন্ত বায়বহুল এ প্রক্রিয়া।

দাফন করা হয়নি যেসব নেতাদের
মস্কোর রেড স্কোয়ারে লেনিনের দেহ। ছবিঃ লেখিকা 

হো চি মিন


হো চি মিন ছিলেন ভিয়েতনামের সবচেয়ে সম্মানিত নেতা, তিনি দেশটির স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন এবং রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । জনগণ তাদের প্রিয় নেতাকে হ্যানয় শহরে বিশাল এক মোসেলিয়ামে রেখে দিয়েছে। তাঁর সম্মানে রাজধানী হ্যানয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে  হো চি মিন সিটি।

দাফন করা হয়নি যেসব নেতাদের
হো চি মিন এর মরদেহ। ছবিঃ লেখিকা  

কিম ২ সাং (kim II-sung) উত্তর কোরিয়া


উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ২ সাং দেশটির জন্মলগ্ন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কুমশুসান  প্যালেসে তাঁর মরদেহ রক্ষিত আছে।

দাফন করা হয়নি যেসব নেতাদের
কিম ২ সাং এর মরদেহ। ছবিঃ লেখিকা 

কিম জং ২ (Kim Jong Il)  উত্তর কোরিয়া


১৯৯৪ সালে তাঁর পিতা কিম ২ সাং এর মৃত্যুর পর থেকে নিজের মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় দুই দশক উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মারা যান। তাঁর দেহ ও তাঁর পিতার সাথে একই স্থানে রক্ষিত আছে।

দাফন করা হয়নি যেসব নেতাদের
কিম জং ২ এর মরদেহ। ছবিঃ লেখিকা 

ফারনান্দো মার্কোস


মার্কোস ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি বহিষ্কৃত অবস্থায় ১৯৮৯ সালে  হাওয়াইয়ে মারা যান। সেই সময়ে তাঁর মৃতদেহ ফিলিপাইনে আনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারনে তাঁর স্ত্রী ইমেলদা (দুর্নীতি এবং ৩০০০ জোড়া জুতার মালিকানার জন্য খ্যাত) তাঁর দেহ ফ্রিজে রাখার বাবস্থা করেন।

পরে ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট ফিদেল রামোসের শাসনামলে তাঁর দেহ ফিলিপাইনে আনা হয়। কিন্তু তাঁকে সমাহিত করা নিয়ে জনগণ আপত্তি তোলে। ইমেলদা ও পূর্ণ সামরিক মর্যাদা না দিলে তাঁর স্বামীকে দাফন করতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর দেহ বাটাক গ্রামে মার্কোসের পারিবারিক মোসেলিয়ামে ক্রিস্টাল কফিনে রাখা আছে।

দাফন করা হয়নি যেসব নেতাদের
ফারনান্দ মার্কোসের মরদেহ। ছবিঃ লেখিকা 


লেখিকাঃ

জেসমিন আরা বেগম 

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top