দাদা সৌরভ গাঙ্গুলি ও ভারত ক্রিকেট
ভারত ক্রিকেটে তরুণদের দুঃসময়ের ঢাল | সৌরভ গাঙ্গুলি
একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। ২০০১ সালের ঘটনা। স্টিভ ওয়াহের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া তখন বিশ্বে একটি অপরাজিত দল। ঠিক সেই সময় ভারত সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া। তিন টেস্টের পাঁচ ম্যাচ সিরিজে ঠিক চারবার টসের সময় ভারতীয় ক্যাপ্টেনের জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য হোন স্টিভ ওয়াহ।
চিন্তা করতে পারেন? সেই সময়কার অস্ট্রেলিয়ার সাথে এরকম মাইন্ড গেমস খেলবে কেউ তা চিন্তা করা যায়? কিন্তু সদ্য ক্যাপ্টেনসিপ্রাপ্ত এক ভারতীয় তরুণ সেই দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।
আচ্ছা বলেন তো? এই তরুণদের নাম কি?
বুঝে গেছেন আশা করি। তরুণটির নাম ছিল সৌরভ গাঙ্গুলী।
১৯৭২ সালের ৮ জুলাইয়ে কলকাতার বেহালায় এক উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সৌরভ চন্ডীদাস গাঙ্গুলী। পিতা চন্ডীদাস গাঙ্গুলীর প্রিন্টিং ব্যবসা ছিল। বাল্যকাল বেশ আরাম আয়েশেই কাটিয়েছিলেন সৌরভ।
ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাপারে একটি দুর্নাম শোনা যায়। তাঁরা বাঙ্গালিদের কখনো সহজে জাতীয় দলে সুযোগ দিতে চান না। সৌরভের অসাধারণ রঞ্জি পারফরম্যান্সের পর ১৯৯২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে অভিষেকে করেছিলেন মাত্র তিন রান। সাথে সাথেই সৌরভ বাদ পড়ে যান দল থেকে। বাদ পড়ার কারণ জানতে চাইলে নির্বাচকরা বলেন, সৌরভ অহংকারী এবং ক্রিকেটের প্রতি তাঁর মনোভাব ঠিক নেই। সৌরভ বাদ পড়েন এবং ১৯৯৬ সালে প্রত্যাবর্তন করেন একজন “মহারাজা”র মতো। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে সেঞ্চুরি করে অনার্স বোর্ডে নাম তোলেন। পরের টেস্টেও ট্রেন্টব্রিজের মেঘলা আবহাওয়ার নিচে খেলেন ১৩৬ রানের একটি ইনিংস যার ফলে অভিষেকেই পরপর দুই ইনিংসে সেঞ্চুরির দুর্লভ রেকর্ড করেন সৌরভ।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার সাথে ১৮৩ রান করে সৌরভ এখনো বিশ্বকাপে একক সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডের হয়ে আছেন। ২০০০ সালে সৌরভ ক্যাপ্টেন্সি পান ভারতীয় দলের। ভারতীয় দলের নৌকা তখন টাল-মাটাল।
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের মতো একজন জনপ্রিয় ক্রিকেটারের উপর ফিক্সিং এর অভিযোগ উঠে। সেসময় এক তরুণ ক্যাপ্টেন দলের ভার নেন। ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ভারতীয় জনগণদের আশ্বাস দেন, ‘আমরা পরিষ্কার ক্রিকেট খেলবো। আমাদের উপর ভরসা রাখুন।’
ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল ক্যাপ্টেন কে? ট্রফির হিসাব করলে অবশ্যই মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কিন্তু ধোনির জন্য সেই ভিতটি কে গড়ে দিয়েছিলেন? অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকই বলেন, ভারতকে জিততে শিখিয়েছিলেন সৌরভ। যে আক্রমাণত্মক খেলার জন্য ভারত এখন বিখ্যাত, সে আক্রমণাত্মক খেলার সাথে ভারতকে পরিচয় করিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী।
২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে মাইন্ড গেমস, ২০০২ সালে ন্যাস্টওয়েস্ট সিরিজের ফাইনালে লর্ডসের বারান্দায় জার্সি খুলে উদযাপন কিংবা ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের মাটিতেই সিরিজ জয়- আর কোন ক্যাপ্টেনের কীর্তি আছে এরকম?
সৌরভ তাঁর স্পষ্ট বাচনভঙ্গির জন্য সবসময়ই সমালোচিত হয়েছিলেন। ২০০৫ সালে যখন গ্রেগ চ্যাপেল ভারতের কোচ হিসেবে আসেন তখন গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে তাঁর বাকবিতণ্ডা তো ক্রিকেটপ্রেমীরা সবাই জানেন।
ভারতের কোচ হিসেবে গ্রেগ চ্যাপেলের আসার পেছনে সৌরভের মত ছিল কিন্তু সৌরভের পড়তি ফর্ম এবং আলাদা ক্রিকেট দর্শনের কারণে গ্রেগ চ্যাপেলের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় তখন। সেই বছরই দল থেকে বাদ পড়েন সৌরভ।
কিন্তু ২০০৬ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এবং সাউথ আফ্রিকার কাছে ওয়ানডেতে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর টেস্ট সিরিজে আবার ডাক পান। সেবার টেস্ট সিরিজে ভারত হারলেও ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হোন সৌরভ গাঙ্গুলী। ২০০৭ সালে বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর আবার ক্যাপ্টেন্সি পান সৌরভ এবং ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ জিতেন। সেবার পাকিস্তানের সাথে ২৩৯ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে সৌরভ ক্যাপ্টেন্সি হস্তান্তর করেন ধোনির কাছে। জীবনের শেষ টেস্ট খেলেন সেই বছরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ৪ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে করেছিলেন ৫৪ গড়ে ৩২৪ রান।
সৌরভকে রাহুল দ্রাবিড় বলেছিলেন, সৌরভ অফ-সাইডের “ঈশ্বর”। সৌরভ যতটা স্বচ্ছন্দে ফ্রন্ট-ফুট এবং ব্যাক-ফুটে অফসাইডে শট খেলতে পারতেন ততটা আর কেউই কখনো পারেনি বলে জানিয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। পাঁচজন ফিল্ডার এর মাঝখান দিয়ে কভার ড্রাইভ মেরে বল সীমানা ছাড়া তাঁর চেয়ে সুন্দরভাবে কেউ করেছেন কিনা দেখিনি।
সৌরভ একজন “পারফেক্ট” দলনেতা ছিলেন। যুবরাজ, মোহাম্মদ কাইফ, ইরফান পাঠানদের সুযোগ দিয়েছেন বারবার নিজেদের প্রমাণ করার জন্য। জহির খানকে দলে নিয়েছিলেন নির্বাচকদের অসম্মতির পরও। পরবর্তীতে জহির খান এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, গাঙ্গুলী দলে না নিলে হয়তো তাঁর ক্যারিয়ার শুরুর আগেই শেষ হয়ে যেত। তরুণ হরভজনকে ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তরুণদের উপর তাঁর প্রচণ্ড আস্থা।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কখনোই কপিবুক ব্যাটসম্যান কিংবা উইকেট-কিপার ছিলেন না। তারপরও তাঁকে দলে সুযোগ দিয়েছিলেন সৌরভ। শুরুর ব্যর্থতার পরো ধোনিকে সুযোগ দিয়েছেন বারবার। এরপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। চিন্তা করেন, যদি যুবরাজ, জহির খান, ধোনিদের এই সুযোগ না দেওয়া হোতো তাহলে ২০১১ বিশ্বকাপ কি ভারতের হাতে উঠত?
তরুণদের কাধে এক বিশ্বস্ত হাত ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। পাঁচে নেমে রানখরায় ভুগতে থাকা এক ব্যাটসম্যানকে নামিয়ে দিয়েছিলেন ওপেনিংয়ে। সেই ছেলেকে লাইসেন্স দিয়েছিলেন “ন্যাচারাল” খেলা খেলার। পরবর্তীতে সেই ছেলে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনারদের রেকর্ডবুকে নিজের নাম তুলেন।
বলেন তো এই ছেলের নাম কি? উত্তর দেবার জন্য সময় ৫ সেকেন্ড।
এবার উত্তরটি মিলিয়ে দেখুন।
ছেলেটি বীরেন্দর শেবাগ। সৌরভ নিজের ওপেনিং স্পটটা দিয়ে দিয়েছিলেন শেবাগের কাছে।
অন দ্যা ফিল্ড দুর্দান্ত আক্রমণাত্মক এই ক্যাপ্টেন ভারতের শারীরিক ভাষাই পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন। দেশের বাইরে আগে যেখানে বারবার হারের শিকার হত ভারত, সেই দেশের বাইরেই জিতেছেন সাউথ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ড সিরিজ।
জীবনে উত্থান-পতনের শিকার হয়েছেন বারবার। তাকে দল থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল বারবার, কিন্তু লড়াই করে ফিরে এসেছেন বীরের মতো। তিনি যে জাত লড়াকু!
জানতেন,তরুণদের এক-দুই ম্যাচ এ বিচার করা যায় না, সেজন্য তিনি তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য দাদা নামের ঢাক হয়ে উঠলেন।
রেকর্ড বুকে হয়তো মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কিংবা বিরাট কোহলির পাশে সৌরভকে ম্লান করে দেবে কিন্তু ইতিহাসই সব নয়। ভারতকে যে জয়ের মন্ত্রটা “দাদা” সৌরভই শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
আমার চোখে তো ভারতের সর্বকালের সেরা ক্যাপ্টেন সৌরভ গাঙ্গুলী, আপনাদের কি মনে হয়?
ক্রিকেটে দাদা সৌরভ গাঙ্গুলিকে নিয়ে আপনার কথা জানান কমেন্টে।
ক্রিকেট নিয়ে আরও পড়ুন-
লিটন দাস, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আগামীর তারকা
গ্রামের দুরন্ত এক কিশোরের মাশরাফি বিন মর্তুজা হয়ে উঠার গল্প
অ্যালিস্টার কুকঃ টেস্ট ক্রিকেটের এক ঋষির গল্প