জেমস অ্যান্ডারসন:
এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা সুইং বোলার
পেস বোলাররা সাধারণত দুই ধরনের হয়। এক, পেস এবং বাউন্স দিয়ে আপনাকে নাজেহাল করবে এবং দুই, সুইং এবং লাইন-লেংথ দিয়ে আপনাকে নাকাল করে দিবে। দুই ধরনের বল দেখতেই আনন্দ আছে তবে সুইং এর যে জাদু আছে তা আপনাকে টিভির সামনে বসিয়ে রাখবে। এই সুইং স্পেশালিস্ট বোলাররা খুব একটা গতিসম্পন্ন হয় না তবে অফস্টাম্প থেকে আউটসুইং কিংবা ইনসুইং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের বারোটা বাজিয়ে দিবে।
২০০৮ সালের ইংলিশ সামারের তৃ্তীয় টেস্ট। ১-০ তে এমনিতেই পিছিয়ে পড়েছে নিউজিল্যান্ড। ট্রেন্টব্রিজে টস জিতে ফিল্ডিং নিলো নিউজিল্যান্ড। প্রথম ইনিংসে ৩৬৪ রানের লিড নেয় ইংল্যান্ড। পিচ কন্ডিশন অনুযায়ী খুব একটা সুইং ছিল না পিচে। কিন্তু রসিক ইংলিশ আবহাওয়া! নিউজিল্যান্ড এর ইনিংস শুরুর আগে আগে হালকা মেঘ আকাশে। দ্বিতীয় ওভারে বোলিংয়ে আসলেন এক নতুন বোলার। অভিষেক আগেই হয়েছে কিন্তু এই সিরিজ থেকে তাঁর ইংল্যান্ড দলে থিতু হওয়া। স্পেলের দ্বিতীয় বল, বল মিডল স্টাম্পে পড়ে খানিকটা লেট সুইং খেয়ে অফ স্টাম্প উড়ে গেলো। আহ! কি সুন্দর সেই দৃশ্য! আপনি অ্যারন রেডমন্ড হলে অবশ্য তা ভালো লাগার কথা না! ওয়ান-ডাউনে নামলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। কয়েকটি বল খেলার পর তাঁরও পরিণতি এক। কিন্তু এবারেরটা আরো বেশি সুন্দর। একই রকম বাঁক বলের কিন্তু পেসের পরিমাণটা হালকা বেশি! এবারো অফ-স্টাম্প নাই।
২০১২ সালে ইংল্যান্ডের ভারত সফর। শচীন সেবার বারবার এক ইংলিশ পেসারের কাছে আউট হচ্ছিলেন। সেবার শচীন ৫ টেস্টে ৫ বার আউট হয়েছিলেন একই বোলারের কাছে। যে শচীন অফ-স্টাম্পের বল সবচেয়ে ভালো খেলেন, সেই অফ-স্টাম্পেই বারবার কুপোকাত। একটা উইকেট যদি হয় খোঁচা লেগে প্রায়রের কাছে ক্যাচে তাহলে পরের উইকেট অফ স্পিনের মতো ইন-সুইং!
সেই তরুণ পেস বোলার এখন বর্তমানে সর্বোচ্চ উইকেট-শিকারি পেস বোলারদের মধ্যে শীর্ষে। নিজের ৩৬তম বসন্তে এসে ৫৬৪ উইকেটের মালিক আর কেউ নন! ইংলিশ গ্রেট জেমস অ্যান্ডারসন!
জেমস অ্যান্ডারসন
এই ইংলিশ ক্রিকেটার ১৯৮২ এর ৩০শে জুলাই ইংল্যান্ডের বার্নলি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট থেকেই তিনি পেস বোলিং এর প্রতি ঝুঁকে গিয়েছিলেন। নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি ১৭ বছর বয়সে বুঝতে পারেন তাঁর পেস বোলিংয়ে কিছু একটা হওয়া সম্ভব।
২০০৩ সালে অভিষেকের পর চুল, ব্যক্তিত্ব এবং লাইফ-স্টাইলে অনেক আপডেটেড থাকার কারণে খুব তাড়াতাড়ি লাইম-লাইটে এসে পড়েন। এমনকি তখন তাঁকে ডেভিড বেকহামের সাথে তুলনা করা শুরু হয়।
শুরুটা ছিলো স্বপ্নের মতো। প্রথম টেস্টেই পাঁচ উইকেট জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ২০০৩ সালে ৮ ম্যাচে পান ২৬ উইকেট, যা নবাগত খেলোয়াড়দের জন্য ভালো পরিসংখ্যান হিসেবে ধরা যায়। ২০০৪ সালে বিভিন্ন কারণে যেমন ইনজুরি, দলে প্রতিযোগিতার কারণে খুব বেশি টেস্টে সুযোগ পাননি। তাঁর ফর্মটাও তখন পড়তির দিকে ছিল। ২০০৫-০৬-০৭ সালগুলো অ্যান্ডারসনের ক্যারিয়ারে খুব একটা পরিবর্তন নিয়ে আসেনি। দলে বারবার আসছিলেন, যাচ্ছিলেন। যদিও ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বেশ বিরক্ত করেছিলেন।
এই ব্যর্থতার পিছনে একটি কারণ ছিল তাঁর বোলিং অ্যাকশন চেঞ্জ। তাঁর অ্যাকশন বল করার সময় মাথা নিচ দিকে চলে যায় যার ফলে তিনি বল করে সামনে তাকাতে পারতেন না যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক সময় বল করার পর যদি বলের উপর চোখ না থাকে তাহলে ব্যাটে লেগে বল বোলারের শরীরে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু এই অ্যাকশন চেঞ্জ অ্যান্ডারসনের ক্যারিয়ারে ভালো কিছু বয়ে আনেনি। যার কারণে ২০০৮-এ তিনি তাঁর সেই পুরোনো অ্যাকশনে ফিরে যান।
পুরোনো অ্যাকশনে ফিরে যাওয়া অ্যান্ডারসন সেবছর ছিলেন ব্যাটসম্যানদের জন্য ত্রাস। ১১ ম্যাচে নেন ৪৬ উইকেট। তাও ২৯.৮৪ গড়ে। সেবার নিউজিল্যান্ডকে একাই ভুগিয়েছিলেন।
অ্যান্ডারসন হচ্ছেন ওয়াইনের মতো। যত পুরোনো হচ্ছেন তত ক্ষুরধার হচ্ছেন। শুরুর দিকের অ্যান্ডারসন এবং এখনকার অ্যান্ডারসনে আকাশ-পাতাল তফাৎ। ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত তাঁর ভালো মৌসুম বলতে গেলে ছিল এক ২০০৮ এর মৌসুম। কিন্তু আস্তে আস্তে চিত্র পরিবর্তন হতে শুরু করে। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল! ৮ বছরে ১০১ টেস্ট খেলে ২৪.১৮ গড়ে নিয়েছেন ৪১৭ উইকেট, অথচ শুরুর সাত বছরে ৪৪ ম্যাচে ১৪৮ উইকেট তাও ৩৪.৮৫ গড়ে। কামব্যাক তো এভাবেই করতে হয়।
একটি মিডিওকোর বোলার হিসাবে শুরু করা এক ছেলে এখন বিশ্বসেরা পেস বোলার। উইকেটের দিক দিয়ে ইতিহাস সেরা! এশিয়াতে তাঁর রেকর্ড ভালো না বলা হয় কিন্তু সেখানে তাঁর বোলিং গড় ৩১.২৫ যা কপিল দেবের বোলিং গড় থেকে ভালো যাকে কিনা এখন পর্যন্ত ভারতের সর্বকালের সেরা পেস বোলার মানা হয়। শচীনের উইকেট নিয়েছেন ৯ বার, জ্যাক ক্যালিসকে ৮ বার, ডেভিড ওয়ারনারকে ৯ বার, মাইকেল ক্লার্ককে ৯ বার। এমনকি হালের গ্রেট ভিরাটকেও আউট করেছেন সাতবার।
অবশ্য ভিরাট গত সিরিজে অ্যান্ডারসনকে উইকেট দেননি। তবে অ্যান্ডারসন এবং ভিরাটের দ্বৈরথ ছিল দেখার মতো। পিচে পড়ে অফ-স্টাম্পের বাইরে বিট হয়েছেন অনেকবার কিন্তু উইকেট দেননি ভিরাট। অ্যান্ডারসনও তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন কোহলিকে আউট করার কিন্তু ভিরাট হার মানেননি একবারও।
তর্ক হতে পারে তবে এই মুহূর্তে যে অ্যান্ডারসন বিশ্বের সেরা সুইং বোলার সেটা মানবে যে কেউ! সাপের মতো বেকে যাওয়া বল খেলতে হিমশিম খান সব ব্যাটসম্যান। একবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কাইরন পাওয়েলকে ব্যানানা সুইংয়ে আউট করেছিলেন। ব্যানানা সুইং বলতে বোঝায় যে বল বাতাসেই কলার মতো বেঁকিয়ে সুইং খায়। ইউটিউবে সার্চ দিলেই পাবেন। আহ! কি বাঁকানো সুইং! এই মুহূর্তে জিমি অ্যান্ডারসন থেকে গ্রেট বোলার টেস্ট ক্রিকেটে নেই।
পাবলো পিকাসোর তুলির আঁচড় কিংবা জন মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ কিংবা ওয়াসিম আকরামের পুরোনো বলে রিভার্স সুইং অথবা নতুন বলে জিমির হাতের বলে সাপের নাচন! আমার কাছে সব এক! টেস্ট বোলিং যে এর থেকে সুন্দর হতে পারে না!
ইংলিশ মিডিয়া লাল ডিউক বলকে প্রায় সময় বলে থাকেন ‘রেড চেরী’। ওয়াসিম আকরাম যদি সেই চেরীর সম্রাট হয়ে থাকেন, তাহলে জিমি অ্যান্ডারসন নিঃসন্দেহে সেই চেরীর যোগ্য রাজকুমার।
আশা করি আরো কিছু বছর খেলবেন অ্যান্ডারসন! হবেন আরো বেশি ক্ষুরধার! নতুন বলে অ্যান্ডারসনের সুইং দেখার চেয়ে আত্মিক শান্তি যে আর দুনিয়া আর একটি নেই।
জেমস অ্যান্ডারসনকে নিয়ে
আপনার মতামত জানান কমেন্টে।
আরও পড়ুন:
ভারতীয় ক্রিকেটের উত্থানে দাদা সৌরভ গাঙ্গুলি
অ্যালিস্টার কুকঃ টেস্ট ক্রিকেটের এক ঋষির গল্প
শচীন টেন্ডুলকার: গড অফ ক্রিকেট | শচীন টেন্ডুলকারের জীবনী