জাপানের অদ্ভুত সব নিয়ম: জাপান ভ্রমণ
“যস্মিন দেশে যদাচার” এই প্রবাদটি হয়তো আপনাদের সবার জানা। যদি না জেনে থাকেন, প্রবাদটির সার অর্থ এরকম যে, আপনি যখন যে দেশে যাবেন, আপনাকে তখন সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী চলতে হবে।
অনেক দেশের ভাষা, সংস্কৃতি আমাদের থেকে বহুদিক দিয়ে আলাদা। যেমন রাশিয়ান যেকোনো ধরনের উৎসবে আপনি শুভেচ্ছা হিসেবে ফুল নিয়ে গেলে ফুলের সংখ্যা অবশ্যই বেজোড় হতে হবে।
তাই অন্যসব দেশের মত জাপানও তার ব্যতিক্রম নয়। জাপান ভ্রমণ করার আগে কিছু নিয়ম কানুন আপনার জানা প্রয়োজন। যেমন, জাপানে আপনি কাউকে খুশি হয়ে বকশিশ দিতে পারবেন না।
বকশিশ দেওয়া-নেওয়াটাকে তাঁরা অপমান মনে করে। তবে আপনি যদি প্রথমবার জাপানে যান তাহলে কিছু কিছু বিষয় দেখে আপনি অবাক হয়ে যেতে পারেন।
একটা ছোট-খাট উদাহরণ দেই। এই দেশে ২৪ ঘন্টা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দোকান খোলা থাকে। কিন্তু এই একই দেশে আপনার শরীরে ট্যাটু থাকলে আপনি স্পাতে ঢুকতে পারবেন না।
অন্য আর দশটা দেশের মতো এই দেশেও কিছু নিয়ম আছে। তবে এখানকার প্রধান নিয়ম হচ্ছে, আপনি কাউকে বিরক্ত করতে পারবেন না।
এসব ছোট-খাট ব্যাপার হয়তো আমাদের সবারই জানা। চলুন, জাপানের ব্যাপারে এমন কিছু তথ্য জানি যা হয়তো আপনাকে অবাক করে দিতে পারে।
১। ক্যাপস্যুল হোটেল
সাধারণত আপনি যদি জাপানে ঘুরতে যান তবে দেখবেন তাদের দেশের হোটেল রুম খুব বেশি ব্যয়বহুল। এমনকি সেদেশে হোস্টেল রুম শেয়ার করতেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়।
তাই সেদেশে ক্যাপস্যুল এর মতো আকারের হোটেল দেখতে পাবেন যা সেদেশের অন্যান্য হোটেলের তুলনায় অনেকটা সস্তা। ক্লাস্টোফোবিয়ার মতো বিরল রোগ না থাকলে আপনাকে ক্যাপস্যুল হোটেল একবার ট্রাই করার পরামর্শ দেব আমি।
২। দোকান ২৪ ঘন্টা খোলা থাকা
বাংলাদেশে আমরা যে দোকানগুলোকে মুদি দোকান বলি, সেদেশের এই দোকানগুলোকেও সেরকম বলা যেতে পারে। সেখানকার এসব দোকানগুলোকে বলা হয়ে থাকে “কোনবিনি”।
এই স্টোরগুলো ৭ দিনের ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে এবং বলতে গেলে, এই স্টোরগুলো আপনাকে সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এমনকি কনসার্টের টিকিট থেকে শুরু করে ফটোকপি পর্যন্ত সব পাবেন আপনি এখানে।
এখানকার অতিথি আপ্যায়ন এর ব্যবস্থা দেখে আপনি অবাক হয়ে যেতে পারেন। “কোনবিনি”গুলো থেকে যখনই আপনি কোনো খাবার কিনবেন, খাবারগুলো তাঁরা গরম করে দিবে।
শুধু তাই নয়, আপনি রাস্তায় হাটছেন হঠাৎ আপনার বাথরুম চাপল, এই ‘কোনবিনি’ গুলো আপনার জন্য খোলা আছে।
৩। ১০০ ইয়েনের দোকান
আমাদের দেশে মাঝে হঠাৎ করে ‘1 to 99’ দোকানগুলো অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। এ দোকানগুলোতে সব ধরনের সামগ্রী পাওয়া যেত। আইডিয়াটি যে জাপান থেকে নেওয়া হয়েছে, তা হয়তো না বললেও চলে।
কিন্তু একটা জায়গায় ব্যাপারটা আলাদা। বাংলাদেশে যেখানে সামগ্রীর মান দিন দিন কমেছে, সেখানে জাপানের সামগ্রীর মান কখনোই কমে না। কসমেটিকস, পোশাক, খেলনা, জুতার মত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস মাত্র ১০০ ইয়েনের মধ্যেই কিনতে পারবেন।
যে কারণে টুরিস্ট অথবা জাপানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে এই দোকানগুলো অনেক জনপ্রিয়।
৪। যাই কিনবেন, ট্যাক্স দিতে ভুলবেন না
কোনো কিছু সাধারণত কিনতে গেলে মনে রাখা উচিত, জাপানে কেনা প্রত্যেকটি সামগ্রীর উপর ট্যাক্স দিতে হয়। এই মুহূর্তে সামগ্রী প্রতি ট্যাক্স ৮% হলেও ২০১৯ সালের মধ্যে ১০% এ রূপান্তরিত হবে।
তাই কোনো রেস্টুরেন্টে বিল দেওয়ার সময় ব্যাপারটা খেয়াল রাখা দরকার। তবে ৫০০০ ইয়েনের উপর কেনা-বেচা করলে তখন আর ট্যাক্স দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
তবে এমন অনেক দোকান আছে, যেখানে ট্যাক্স দিতে হবে না আপনাকে। ট্যাক্স দিতে হবে না এমন দোকান সম্পর্কে জানার জন্য আপনি নিম্নের ওয়েব-সাইটে ঘুরে আসতে পারেন।
লিংকঃ জাপানের ট্যাক্স ফ্রি দোকানসমূহ
৫। জুতো খুলে প্রবেশ করেন
এই অভ্যাসটি আপনার কাছে অবাক করা নাও লাগতে পারে কারণ আমাদের দেশেও এ ব্যাপারটিকে অনেক মেনে চলা হয়। জাপানি ব্যক্তিরা মনে করেন, কারো গৃহে ঢোকার আগে জুতো খুলে প্রবেশ করতে হয়।
হোটেল, উপাসনালয়,স্কুল এবং এমনকি অনেক রেস্টুরেন্টেও খালি পায়ে প্রবেশের নিয়ম আছে। তাই কখনো কোথাও ঘুরতে গেলে, পায়ের জুতো নিয়ে সাবধান।
৬। দীর্ঘ সময় থাকার প্ল্যান এবং প্রস্তুতি
কখনো এই দেশে দীর্ঘ সময় থাকার প্ল্যান থাকলে আগে থেকে ইমারজেন্সি কিট কিনে ফেলুন। কারণ এই দেশে হারিকেন এবং ভূমিকম্পের প্রকোপ বেশি।
এই কিটগুলোতে সাধারণত বিপদ সামলানোর বিভিন্ন উপকরণ থেকে থাকে। যেমন, ফাস্ট এইড বক্স থেকে শুরু করে হাত গ্লাভস পর্যন্ত সব থাকে এই কিটগুলোতে।
৭। বিপদে পড়লে “কোবান” এর সাহায্য নিন
এখন থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে টোকিও এবং জাপানের অন্য রাজ্যগুলোতে “কোবান” নামে পুলিশের এই ইউনিট খোলা হয়। তাঁরা শুধু অপরাধ দমন করেন না, টুরিস্টদের যথা সম্ভব সাহায্য করে থাকেন।
তাঁরা মূল্যবান জিনিস এবং প্রয়োজনীয় পেপারস হারিয়ে গেলেও তা খুঁজে দেন। এর পিছনে জাপানি নাগরিকদের একটা বিশেষ অবদান আছে। তাঁরা কখনো মানুষের জিনিসে সহজে হাত দেন না। কোনও কিছু পেলেও তা “কোবান”-এ দিয়ে আসেন।
৮। কাউকে অযথা বিরক্ত করবেন না
জাপানি নাগরিকরা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ভদ্র জাতিগুলোর একটি। তাঁরা কখনোই কাউকে বিরক্ত করেন না। এমনকি মোবাইলে জোরে কথা বলাটাও এখানে অশালীন মনে করা হয়। বিশেষ করে, পাবলিক প্লেসে। তাই পাবলিক প্লেসে সমঝদার আচরণ করাই সমীচীন।
জাপান এমন একটি দেশ যেখানে আপনি শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করবেন না, আশের পাশের মানুষকে নিয়েও চিন্তা করতে হবে। স্বার্থপর ভাবনা এখানে কাম্য নয়।
এদেশের মানুষেরা সবাই সবাইকে তাদের সামর্থ্যমত সাহায্য করে। ঝগড়া-বিবাদ এদের রক্তের মধ্যে নাই বললেই চলে। তাঁদের থেকে আদব-কায়দার ধরণ এবং ঝগড়া-বিমুখ স্বভাব আমাদেরও আয়ত্তে আনা উচিত।
জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর একটি। তাঁদের আদব-কেতা, সংস্কৃতিকে পুরো বিশ্বে সম্মান করা হয়।
হিরোশিমা, নাগাসাকি ট্রাজেডির পর যেভাবে এই দেশ ঘুরে দাড়িয়েছে, তা অবশ্যই অবাক করার মত। তাই কেউ যদি কখনো ঘুরতে যাওয়ার জন্য কোনো দেশের নাম জানতে চান, আমি বলব জাপান ঘুরে আসুন।