ছোটগল্প: জোয়ার-ভাটা | পিন্টু রহমান

ছোটগল্প: জোয়ার ভাটা

অভিযাত্রী সাহিত্য পাতায় পিন্টু রহমানের ছোটগল্প: জোয়ার-ভাটা 


রাত গভীর হলে আমার দুয়ারে প্রতিদিন মৃত্যু আসে; ধীর পায়ে সিঁড়ি ভেঙে দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়! শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না, বিছানার উপর উঠে বসি। প্রসস্থ প্রশস্ত রুমটায় কবরের নিস্তব্ধতা! যেদিন নুপূরের ধ্বনী উত্থিত হয়, বুঝতে পারি- হৈমন্তি আসছে! অভিমান হয়- এতদিনে তার সময় হলো!

সময়ের দায় তার না, আমার; আমার কারণেই অস্তগামী সূর্যের রেখায় রেখায় মায়াবী ছবি হাতড়াতে হয়; কল্পনার দরজায় কড়া নাড়তে হয়! অপয়া আমি, তা না হলে দরজার ওপার থেকে আওয়াজ আসবে না কেনো, কেনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইবো!

উফ, ক্লান্তি আমায় ছুঁয়ে যায়। পৃথিবী বিষাদময়!

হৈমন্তির আনাগোনা বহুদিন পরে বেড়ে গেছে। সময়-অসময়ে জানালায় উঁকি মারে, চোখ রাঙায়, পায়ে পায়ে জোছনা মাড়ায়। অন্ধকারের দিনগুলোয় ভিন্ন মাত্রা- করুণ কন্ঠের হাহাকার আমাকে এলোমেলো করে দেয়। মেয়েটির জন্য খারাপ লাগে। বিছানায় ভালো লাগে না, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। আশেপাশে গাঢ় অন্ধকার। লিচুর পাতা চুয়ে ফোঁটায়-ফোঁটায় শিশির পড়ে। দূরে একটা ল্যাম্পপোষ্ট।

ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় চোখ জ্বালা-পোড়া করে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। ক্লান্ত দেহ সোফায় এলিয়ে দিই। ইতিহাসের পাতা থেকে বাইজীরা তখন জীবন্ত হয়ে ওঠে। সুসজ্জিত অবয়বে সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথা নুয়ে কপাল পর্যন্ত হাত উঁচিয়ে কূর্ণিশ করে। রাজা-বাদশা যেনো-বা!

হায়, আমার বাড়িটা নবাবদের রঙমহল!

নাচে-গানে মাতিয়ে রাখে! কেউ কেউ মোহর ছুঁড়ে মারে। মারহাবা, মারহাবা আওয়াজ তোলে। নিঃস্ব, দ্বীনহীণ আমি, মোহর পাবো কোথায়! মহাজনরা মদমত্ত। নেশাগ্রস্ত। কোলের উপর বালিশ তুলে নেয়। ঘুমজড়ানো চোখে অস্পস্ট স্বরে কী সব বলে আর হাত নাড়ে। বাইজীদের নড়াচড়া বিশেষ মাত্রা পায়। আলোয়-আলোয় চর্তুদিক আলোকিত। বিস্ফোরিত চোখে হৈমন্তির পানে তাকাই- আহা, ঠিক সেই মুখ, সেই চোখ, নেই চুল! নুপূরটাও আগের মতো!

হৈমন্তির জন্মদিনে একজোড়া নুপূর বানিয়েছিলাম, হিরাঝিলের নির্জনতায় আলতারাঙা পায়ে নিজ হাতে পরিয়ে দিয়েছিলাম! দারুণ মানিয়েছে! বিকেলের সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে হেলান দিয়েছে, আবির ছড়াতে শুরু করেছে। পায়ে পায়ে ভগিরথীর তীরে এগিয়ে যাই। লোকচক্ষুর আড়ালে নির্জনতা খুঁজি। পাশাপাশি বসে গল্প করি। একটা বিষয় লক্ষ্য করতাম, আমার ভাবনা যত মাটিবর্তী হৈমবতী ততই আকাশমুখী। মাথার উপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে টিয়া পাখি উড়ে যায়। আকাশের অরণ্যে একসময় হারিয়ে যায়! পাখিরা কোথায় যায়! কোথায় তাদের ঠিকানা! তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকি, বুঝি না কোথায় তাদের ঘরবসতি!

ইস, আমরা যদি পাখি হতাম!

কী হতো তাহলে?

পাখা মেলে সারা আকাশ উড়ে বেড়াতাম!

ওড়ার পক্ষ্যে অসংখ্য বাঁধা, মেয়েটি ধর্মভীরু; ধর্মের বিধিবিধান মেলে চলে। সনাতন ধর্মাবলম্বী। প্রথম দেখায় ভুল করেছিল, ভেবেছিল স্বগোত্রীয় কেউ। সে-সময় পোশাক দেখে হিন্দু-মুসলমান আলাদা করার উপায় ছিল না।  ইউরোপে শিল্প-বিপ্লবের আগ পর্যন্ত আমার পূর্বপুরুষরা ধূতি পরিধান করতো। এখনো কেউ কেউ ওই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি! কলকাতা এবং আশেপাশে এলাকার মুসলমান মেয়েরা এখনো শাঁখা পরে, শঙ্খ বাজায়, সিঁথি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে সিঁদুরনদী!

ছোটগল্প | প্রেমগুলো নদী হয়ে যায় পড়ুন

বন্ধুদের অধিকাংশ হিন্দু ছিল। ধুতি পরে যখন মন্ডপে-মন্ডপে আড্ডা দিতাম, নাচ-গানে মেতে উঠতাম, অচেনা মানুষ ভুল করতো; কপালে চন্দনের তীলক এঁকে দিত!

বিশেষ উৎসবে হৈমন্তি নিজেও একদিন তীলক এঁকে দিয়েছিল। তখনো জানতো না আমি মুসলমান। যখন জানলো তখন আর ফিরে আসার পথ ছিল না! ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে মেয়েটি চুপচাপ বসে ছিল। মনের কোণে কালো মেঘ। বুঝতে পারি, ঝড় বইছে, তার মধ্যে ভাঙাগড়ার খেলা। আমিও জানতাম না, প্রেমের ভেলায় ভেসে ভেসে অতটা পথ পাড়ি দিব!

হৈমন্তিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি, উপগ্রহের মতো চক্কর দিয়েছি। দেরিতে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙলেও উঠি না, বালিশ বুকের মধ্যে জড়িয়ে পুনরায় ঘুমের আবহ সৃষ্টি করি। কলেজ পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রথম দু’পিরিয়ড শেষ হয়ে যেত। কিন্তু  হৈমন্তির ছোঁয়ায় আমুল বদলে গেলাম। ভোরের সূর্য চোখ মেলে তাকানোর আগেই প্রস্তুতি শেষ, বারবার হাতঘড়ির পানে তাকাই। বন্ধুরা খাওয়ার কথা বলে- কীরে খাবি না?

রাখ তোর খাওয়া, টাইম নাই!

চোখ কপালে তোলার ভান করে নিখিল বলে, ও চাকরিতে যাচ্ছিস বুঝি? যা যা নতুন চাকরী বলে কথা, দেখিস প্রমোশন যেনো আটকায় না!

প্রমোশনের চিন্তায় বন্ধুরা মুখরিত; দেরি করাতে নিত্য-নতুন কথা বলে- বুঝলি পথিক, না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বি, পরিশ্রম তো কম হয় না! পায়ে হেঁটে গলির এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হাঁটাহাটি করা কষ্টের কাজ।

হ হ, ঠিক বলেছিস।

তাছাড়া পথিক তো আর এক পাকে থামে না, পাকের পর পাক, কেউ দেখলে ভাববে, বেচারা হয়তো পয়সা হারিয়েছে! দেখিস ভাই, সাতপাকের দিকে না যেতে হয়!

গোপন আর গোপন থাকে না, কলেজ যাওয়ার পথে আমি যে হৈমন্তির সাথে দেখা করি, বন্ধুদের কাছে জানাজানি হয়ে যায়। জানলে জানুক, আমি কী ওদের কেয়ার করি? হৈমন্তি নিজেও আপত্তি করে- কেউ দেখে ফেলে যদি!

দেখলে দেখুক।

দেখুক মানে! দেখলে কী হবে বুঝেছো! কলেজে আসা বন্ধ করে দিবে!

গলির মধ্যে আমরা একত্রিত হই না, নির্দিষ্ট দুরত্ব রেখে এগিয়ে চলি; এমন ভাব যে, কেউ কাউকে চিনি না; জানি না! বস্তুত হৈমন্তি সম্পর্কে খুব বেশি জানতাম না। বড় রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটিকে আশ্বস্ত করতাম- ভয় নেই বালিকা, কেউ দেখবে না!

তবুও! রোজ রোজ এসো না!

না এলে যে ভালো লাগে না, কোন কিছুতে মন বসে না! তাছাড়া কে দেখবে, বলো?

বাবা। বাবার চোখ কদ্দিন ফাঁকি দেবে, ওই পথ ধরেই তো উনি অফিসে যায়।

হৈমন্তির বাবাকেও চোখে চোখে রাখি; কখনো সম্মুখে পড়লে নিজেকে আড়াল করি। ভদ্রলোক ব্যাংক-কর্মকর্তা। সহজ-সরল জীবনাচারে অভ্যস্থ। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সাজানো সুখের সংসার! হঠাৎই সুখের অসুখ হলো; মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো- হৈমন্তির বাবা আর নেই, ভদ্রলোক মারা গেছে!

একটা মৃত্যুতে অসংখ্য স্বপ্নের পরিসমাপ্তি হলো। বাবার লাশ জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে হৈমন্তি কাঁদে- কেনো এমন হলো বাবা? কেনো তুমি আমাদের ছেড়ে গেলে! কী অপরাধ করেছিলাম! তোমাকে ছাড়া কেমন করে বাঁচবো! কাকে বাবা বলে ডাকবো!

কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞাণ হারায়। ধূলোয় নেতিয়ে পড়ে! বাবা ছিল তার অন্তপ্রাণ; বন্ধুর মতো। স্বপ্ন দেখেছিল, বড় হয়ে বাবার চাইতে বড় ব্যাংকার হবে! সমাজের মুখ উজ্জ্বল করবে!

নিকষ কালো অন্ধকারে হৈমন্তির স্বপ্ন হারিয়ে গেছে।  পাথর সময়। পাথর চোখে একটি মেয়ের ক্ষয়ে যাওয়া লক্ষ্য করি। দহণে দগ্ধ হই। চোখের জল আড়াল করে দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

এ কেমন নিয়তী!

আগে ভয় করতাম, যদি কেউ দেখে ফেলে!

বাবা নেই, কে দেখবে! লোকচক্ষুর পরোয়া করি না, হৈমন্তিদের বাসায় যাতায়াত করি। খুব বেশি কথা হয় না, বাগানের কিনারে চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে থাকি! ওকে কী শান্তনা দেব, আমি নিজেই অশান্ত! বাবাকে হারিয়ে অন্ধকারের নিমজ্জিত তরীর মতো অবস্থা! অস্বাভাবিক আচরণ। সারাক্ষণ চুপচাপ। টেবিলে মুখ গুজে ঝুঁপ ধরে বসে থাকে। খাবার স্পর্শ করে না। গভীর রাতে চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তোলে। সকালে বেমালুম অস্বিকার করে, কই, না তো, এমন কিছু মনে পড়ছে না তো!

হৈমন্তি স্মৃতি বিভ্রাটে আক্রান্ত। চেনাজানা মানুষকে ভুলে যায়। কাউকে না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। একদিন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিখোঁজ। সকাল গড়িয়ে দুপুর, তারপর সন্ধ্যা- নাহ, কোন খোঁজ নেই।

কোথায় গেল মেয়েটি!

দূর্ঘটনায় পড়েনি তো!

বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ি। হাসপাতাল, পার্ক, পুলিশ ষ্টেশন, রেলষ্টেশন- সম্ভাব্য স্থানগুলোতে হণ্যে হয়ে খুঁজি। আজ মনে হয়, মেয়েটি সেদিন মারা গেলে ভালো হতো! জ্বালা-যন্ত্রণা কমতো।

খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে অনুভব করতে হৈমন্তি সেদিন শ্মশাণের পথ ধরেছিল। জলের সান্নিধ্যে বসে ছিল। তার চোখেও জল; হাত ধরে টান দিতেই ফুঁপিয়ে ওঠে। বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে চোখের জল ঝরায়। বাঁধা দিই না, কাঁদুক সে, কান্নার সাথে দুঃখ-কষ্ট বেরিয়ে গেলে হয়তো ভালো লাগবে, খানিকটা হালকা বোধ হবে!

কান্নার ভাগ্য নিয়ে যে জন্মায় তাকে হাসানোর সাধ্য কার! আমার পরিচয় জেনে তার চোখের আলো দপ করে জ্বলে পুনরায় নিভে গিয়েছিল; শক্ত হাতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল; হাসির ভান করেছিল! আমার কন্ঠ তখন খাদের কিনারে- হৈমন্তি! ময়েটি কথা বলে না, দাঁত দিয়ে নখ কাটে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।

কী ভাবছো, তুমি?

কী আর ভাববো? ভাবছি আমার নিয়তি!

কয়েক মুহূর্ত থেমে পুনরায় বলে, পোড়া কপাল আমার! যতবার স্বপ্ন দেখি ততবারই স্বপ্ন ভেঙে যায়। ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন কতবার জোড়া লাগাবো!

আবেগী হয়ে হাত জড়িয়ে ধরে, পথিক, জীবন কেনো এমন হয়!

নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমার অপরাধে ফুলের মতো একটি মেয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে! ইচ্ছে করলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো।

আমার ইচ্ছের কথা সে বিশ্বাস করে না; নিয়তীর উপর নাকি কারো হাত নেই! হৈমন্তির দস্যিপনায় ভাটির টান; বয়সী বটের মতো শিকড় গজায়, সম্ভাবনার কথা শোনায়- মুসলমান তো কী হয়েছে, আমি কেবল একজন মানুষকে ভালোবেসেছি। তাকে দেবতার আসনে বসিয়েছি। এ-ভাবনা একান্তই আমার! আমার সুখ, আমার প্রেম আমার মতো করে যাপন করতে দাও। ভবিষ্যত নিয়ে বিচলিত নই। দেখি নিয়তী আমাদের কোথায় নিয়ে যায়!

ছোটগল্প: জোয়ার ভাটা
ছোটগল্প: জোয়ার ভাটা

প্রাসঙ্গিক হয়ে চন্ডিদাসের কথা উঠে আসে- তোমার মনে নেই পথিক?

কী?

চন্ডিদাসের সেই অমর বানী- সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই!

অদ্ভুত মেয়ে, ভাঙবে তবু মচকাবে না। নিজেই নিজেকে শান্তনা দেয়। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার পরামর্শ দেয়। প্রেমের পথে ধর্ম যে একমাত্র বাঁধা নয়, তার স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে, টেকসই উদাহরণ দাঁড় করায়। অবিশ্বাসী চোখে তাকে দেখি! মেয়েটি কৌশলী। নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না; ক্রমশ নিঃসঙ্গ হওয়ার প্রচেষ্টা। ঘরে-বাইরে অভিন্ন দৃশ্য! কৌশলে ধর্মীয় বিষয় এড়িয়ে যায়। মন্দিরে প্রার্থণায় ঢুকলে আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে। হাসিমুখে ফিরে এসে বলে, কী, দেরি করিয়ে দিলাম!

একটু একটু করে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসি। সময় আমাদের ফেরার পথ করে দেয়। নুপূর পায়ে আমরা সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত জলের সান্নিধ্যে ছিলাম। নদীর জলে গোধূলীর সূর্য অস্তমিত হলে দীর্ঘশ্বাস খসে পড়ে। চাঁদের আলোয় বিরহ-ব্যঞ্জণা! কথা বলে না, হাঁটুর উপর থুতনি ভর দিয়ে জোছনা দেখে। উত্তরের বাতাসে শীতের আমেজ। জলের উপরিতলে সাইবেরিয়ান বলাকা। বলাকার মতো তেপান্তরের মাঠ পাড়ি দিই। বুকের মধ্যে চৈত্রের দাবাদাহ। ফেরার আগে হাতে নুপূর ধরিয়ে দেয়। হায়, সেই নুপূর! বড় সাধ করে পরিয়ে দিয়েছিলাম! সে কী তবে মুক্তি চায়!

কয়েক মুহূর্ত পলকহীণ তাকিয়ে থেকে বলি, ফিরিয়ে দিচ্ছো যে!

হৈমন্তির মধ্যে অস্থিরতা, ধরো না, পথিক! প্লিজ!

কিন্তু ক্যানো! তোমার কী পছন্দ হয়নি?

হয়েছে, ভীষণ পছন্দ হয়েছে!

তাহলে ফিরিয়ে দিচ্ছ যে!

রাতের পরিবেশ আলোড়িত করে হৈমন্তি হাসে। উপচেপড়া হাসি থামিয়ে বলে, আরে বুদ্ধ, একটা আমার কাছে আরেকটা তোমার কাছে থাক।

ওহ, এতক্ষণে খেয়াল হয় দুটো নয় একটা নুপূর। নুপুর বিষয়ক ধারণাটাও দারুণ! স্মৃতি হয়ে থাকবে, বিষন্ন মুহূর্তে চোখের সম্মুখে মেলে ধরবো, দুজনকে দুজনের মনে পড়বে!

হৈমন্তির জীবন থেকে আমি যে হারিয়ে যাবো, সে-কথা কী আগেই আন্দাজ করেছিল? আজ আর অবিশ্বাস হয় না, পরিণতির কথা সে ঠিক করে ফেলেছিল। শুধু সময়ের জন্য অপেক্ষা! নুপূরটা ইদানীং পাথরের মতো ভারি মনে হয়। চোখের সম্মুখে ধরলে বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। কতদিন ভাবি, জলে ফেলে দিয়ে আসবো! বিকেলের আলোয় সেদিন পুকুর ঘাটে গিয়েছিলাম, যে আমাকে চোখের জলে ভাসিয়েছে তার স্মৃতিচিহ্ন অথৈই জলে ডুবিয়ে দিব; শেষপর্যন্ত ডুবাতে পারি না। জলের উপর একজন হৈমন্তির মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে! আশেপাশে তাকাই, দৃষ্টির প্রখরতায় অনুসন্ধান করি, নাহ কোথাও নেই! বিশেষ এক ধরনের ঘোর সৃষ্টি হয়েছে।

হৈমন্তি বিচক্ষণ। বহরমপুরের কৃ নাথ কলেজে প্রথম পরিচয়। লাল জমিনে সাদা-পাড় শাড়ি পরে রাঁধা রুপে যেদিন উপস্থিত হলো না বলার সাহস ছিল না। এ যেনো রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তি! দেবী দূর্গার মতো মায়ার কাজল পরানো টানা-টানা চোখ, দীঘল কালো চুল, আদুরে কন্ঠস্বর, গায়ে রঙ কালো! এই নিয়ে অনেক ক্ষোভ- হায় ভগবান, তুমি আমাকে ফর্সা করে বানালে না কেনো! একটু ফর্সা করলে কী এমন ক্ষতি হতো!

হেয়ালী করে বলি, অহংকার জন্মাতো!

বালিকা চোখ পাকায়, এতদিনে এই চিনলে আমাকে! তাহলেই হয়েছে!

কী হয়েছে বালিকা!

আমার কপাল পুড়েছে!

কালো মেয়ে যে রুপবতী হয়, হৈমন্তিকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! তার মতো মেয়ের ভালোবাসা পাওয়া আরো কঠিন! মোটর বাইকে চড়ে কলেজ যাওয়া পছন্দ করতো না। সিগারেট খাওয়া নিয়ে বিধি-নিষেধ। বন্ধুদের সাথে যত্রতত্র ঘোরা যাবে না। ক্লাশ ফাঁকি দিলে নাকি লেখাপড়া হয় না।

লেখাপড়া আমার ভালো লাগে না। সিগারেট ছাড়া চলতে পারি না। চুরি করে যে এক-আধটা খাব সে-পথও বন্ধ! বন্ধুরা চোখে চোখে রাখে, দোস্ত, তোর না সিগারেট খাওয়া মানা!

হুম, তাতে তোদের কী!

আমাদের কী মানে, দেখা হলে কিন্ত বলে দিব!

ও, তোরা তাহলে গোয়েন্দা!

সমস্বরে হাসি; হাসির গমকে রাতের পরিবেশ আলোড়িত হয়। দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসে। মনের মধ্যে বিরহ জাগে।

যাই বলিস, মেয়েটি কিন্তু দারুণ, তাইনারে নন্দ?

তা যা বলেছিস, কলেজের সবগুলো চোখ ওর পানে! ইনিয়ে-বিনিয়ে ভাব জমায়। ছায়ার মতো অনুসরণ করে। বইয়ের ভাজে চিঠি পুরে ইতিউতি করে। হৈমন্তি পাত্তা দেয় না।

বন্ধুরা হেয়ালী করে বলে, দেবে কী, কৃ তো তার পাশেই! সময়ে-অসময়ে বাঁশিতে সুর তোলে! রাত জেগে প্রতিদিন কী করে আমরা কী কিছুই বুঝি না!

হুমায়ূন আহমেদ কতটা সীমাবদ্ধ ছিলেন?

চিঠি লিখি। অনেক রাত পর্যন্ত হৈমন্তিকে চিঠি লিখি। লেখার ভাজেঁ-ভাজে আবেগ! তখনো জানতাম না জীবন কত কঠিন! মাঝে মাঝে বাঁশির কথা ভাবি, সুযোগ হলে জলঙ্গীর তীরে বাঁশিতে সুর তুলবো। আমি আর হৈমন্তি রচনা করবো অপার্থিব আবহ! স্বপ্নের ঘোরে আমি যখন আকাশে হৈমন্তি মাটিতে।

মেয়েটি সংসারী। সংসারের খুটিনাটি তার নখদর্পনে! হাত নেড়ে নেড়ে বলে, সাজানো-গোছানো রুম। ভারী কোন আসবাব থাকবে না। বিশাল বড় একটা আয়না থাকতে হবে!

বড় আয়না ক্যানো!

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে নিজেকে দেখবো। সাঁঝের আলোয় চুল বাঁধতে বসবো। বুঝলে মশাই, একজন কালো মেয়ের কাছে চুল সম্পত্তি নয় সম্পদ।

আমি তখন রবীন্দ্রনাথ থেকে কোট করি, পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম!

আমাকে পাওয়া এতোই সোজা! সাত জনম অপেক্ষা করতে হবে; সাত জনম! বুঝলে নাগর!

জন্মান্তরে বিশ্বাস নেই। পাওয়া যে সহজ নয় অনেক মুল্য দিয়ে বুঝেছি! জীবনে কোনকিছুই সহজে অর্জিত হয় না, প্রতিটি অর্জনের পিছনে রয়েছে ত্যাগ-তিতীক্ষার গল্প।

সম্পদ নিয়ে হৈমন্তি গর্বিত। সত্যি সত্যি অসাধারণ তার চুল! লম্বা। রেশমের মতো কোমল। সামান্য বাতাসেই লুটোপুটি খায়, মুখের উপর লুটিয়ে পড়ে। এক হাতে শাড়ি অন্যহাতে চুল সামলাতে সামলাতে মেয়েটি হয়রান! যেদিন খোপা করে আসে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারি না! চুল বিষয়ক গল্পে মুখর হয়ে উঠি।

চোখ দিও না তো, এভাবে চোখ দিলে আমার চুল উঠে যাব যে!

হৈমন্তি ফুলের কথা বলে, যদি পারো শিউলী ফুলের মালা পরিয়ে দাও!

মালা পরানোর সুযোগ আর পেলাম কই! বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাবা উপস্থিত। মুহূর্তের জন্য আমার পৃথিবীটা থমকে দাঁড়ালো। কী করবো এখন! কেমন করি বলি- বাবা, একটা হিন্দু মেয়েকে ভালোবাসি, অনুমতি দিলে বিয়ে করবো।

বাবা সে-পথ আগেই বন্ধ করে দিয়েছে, মেয়েপক্ষের সাথে কথাবার্তা চুড়ান্ত। যা বাকী তা কেবল আনুষ্ঠানিকতা!

বাবা চলে যাওয়ার পরে অন্ধকারে ঠায় বসেছিলাম। সেদিন রাতে আমার ঘরে আলো জ্বলেনি। উথাল-পাথাল ভাবনায় নির্ঘুম রাত পেরিয়ে গেছে! কী করবো বুঝতে পারি না। বাবার কথার অবাধ্য হবো এমন সাহস ছিল না, হৈমন্তির সামনে দাঁড়াতেও দ্বিধা! মেয়েটিকে আমি ঠকিয়েছি, তার স্বপ্নের নৌকো অথৈই জলে ডুবিয়ে দিয়েছি।

বিয়ের দুদিন আগে ডেকে পাঠায়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে হাজির হই- হৈমন্তির প্রিয় জায়গা। চোখে চোখ পড়তেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হেসে ওঠে- আরে পথিক যে! কী সৌভাগ্য তোমার! বন্ধুদের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে!

ভাগ্য বটে!

আমি হাসতে পারি না। হৈমন্তিকে কেমন অচেনা লাগে! মুখে হাসি থাকলেও চোখদুটো নিস্প্রভ। মেয়েটি নিজেও জানে তার চোখের পানে তাকিয়ে অনেক কিছু পড়তে পারি, বলতে পারি!

অনেকক্ষণ ছিলাম, কিন্তু বিশেষ কিছু বলতে পারিনি! বোবা দৃষ্টিতে চর্তুদিক নিরীক্ষণ করি। জীবনের হিসেব বড় জটিল, মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। নতুন জীবনের জন্য হৈমন্তি অভ্যর্থনা জানায়, ভগবানের কাছে মঙ্গল কামনা করে। শেষ উপহার হিসেবে নাগরাই জুতা, এক জোড়া ধুতি ও টোপর এনেছিল। দারুণ সব উপহার, খুব খুশি হয়েছিলাম, চোখের পাতায় জল জমা হয়েছিল! শালা জল, কাঁদতেও পারি না, লুকাতেও পারি না!

কাঁদতে নেই পথিক, খুশির দিনে কাঁদলে অমঙ্গল হয়।

হৈমন্তি নিজেও চোখের জল আড়াল করে- আমি জানি তো, তুমি নিরুপায়! এমন কী’ই বা করার ছিল! আমি হলেও পারতাম না। দু’জনার মাঝখানে যে দেওয়াল ইচ্ছে করলেও তা গুড়িয়ে দেওয়া যায় না! ফিরে যাও তুমি, আজ থেকে আমাদের পথ ভিন্ন!

ভিন্ন পথের যাত্রী আমরা, যে পথ অনিঃশ্বেষ। পাথরখন্ডের উপর হৈমন্তি বসে থাকে আর আর আমি উল্টো পথের সিঁড়ি ভাঙি। হেরে গেছি, ভালোবাসার খেলায় পরাজিত হয়েছি। পা চালাতে কষ্ট হয়; থেমে থেমে চলি, গঙ্গার তীরে বেয়ে সম্মুখে এগিয়ে চলি। ঝাঁপসা চোখে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাই।

লেখক: গল্পকার ও সম্পাদক- জয়ত্রি।

পিন্টু রহমানের ছোটগল্প: জোয়ার-ভাটা কেমন লেগেছে কমেন্ট করে জানান।

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top