আখতার মাহমুদের ছোটগল্প:
বিড়াল বিষয়ক বিবিধ গল্প
আখতার মাহমুদ
ক্লান্ত শ্রান্ত পাঠক ভদ্রলোক বসার ঘরে ঢুকেই পানি চেয়ে খেয়ে ধন্যবাদ দিয়ে জানান, তিনি এসেছেন লেখকের সাথে দেখা করতে। একটি গল্প নিয়ে আলাপ করতে চান। যে গল্প পাঠক ভদ্রলোকের ঘুম পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে। এত কোমল, এত মানবিক আর রহস্যময় গল্প নাকি তিনি দ্বিতীয়টি পড়েননি। পাঠক ভদ্রলোককে জানাই, লেখক বাজারে গিয়েছেন। যে কোনো মুহূর্তে চলে আসবেন। আগ্রহ দেখিয়ে গল্পের নাম জানতে চাই। তাকে জানাই, আমি লেখকের বন্ধু। দীর্ঘদিনের বন্ধু। তার সব গল্প আমার পড়া। ভদ্রলোক হেসে জানান, বরং লেখকের সামনেই কেবল গল্পটি নিয়ে আলাপ করবেন তিনি। হয়তো সেটাই ভাল সবদিক থেকে। তবে গল্পটা পড়ার পেছনের গল্প আমাকে জানাতে রাজি হন।
আমি বেকার মানুষ, কোথাও যাবার বা ফেরার ব্যস্ততা নেই বলে তাতেও রাজি হই। ভদ্রলোক বলতে শুরু করেন-
‘আমার একটা বিড়াল আছে…. “আমার” বলাটা হয়তো ভুল, কোনদিন যেন বিড়ালটাকে পথে খাবার ছুঁড়ে দিয়েছি, সেই থেকে বাসাতক চলে এসেছে, বাসার বাইরেই থাকে, ঘুমায়; কতবার তাড়িয়েছি হিসেব নেই তবু ফিরে আসে বারবার…. মেয়ে বিড়াল, ছানা-পোনা পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে, সবগুলো মিলে হেগে-মুতে একাকার করে রাখে, এছাড়াও সারাক্ষণ মিউ মিউ শব্দে বাসার সকলে অস্থির; খাবার দেয়া হতো না, তাতেও কোথাও যেত না…. একসময় ভয়ানক অতিষ্ট হয়ে মনে হতে থাকে, বাচ্চা সমেত বিড়ালটি মেরে ফেলা দরকার, কিন্তু আমিতো ছাপোষা মধ্যবিত্ত, অতটা নিষ্ঠুর না হয়ে বরং একজন নিষ্ঠুর মানুষের সন্ধানে নামি।
মন্তব্য করি, ‘ইন্টারেস্টিং। বিড়াল তাড়ানো সত্যিই ঝামেলার। তারপর? নিষ্ঠুর মানুষ পাওয়া গেল?’
‘এলাকার এক পুলিশ অফিসারের কাছে গিয়েছি, হাজতে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলার অপ্রমাণিত অভিযোগ আছে, আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত হওয়ায় তার কাছে গিয়ে অনুরোধ করি, বিড়ালটাকে মেরে দিতে, বাচ্চাসহ; তিনি আঁতকে উঠে জানান, বিড়ালের মতো নিষ্পাপ প্রাণী মারা তার পক্ষে অসম্ভব; তাকে মনে করিয়ে দিই, তিনি মানুষ মারেন- হাজতে; বেঁধে, ঝুলিয়ে, পেছনে সেদ্ধ ডিম ভরে; তিনি বলেন- তারা অপরাধী; প্রশ্ন করি- অপরাধীকে মারা যায়? অপরাধীদের পিটিয়ে মারার কোনো আইন কী আছে? তাতে তিনি দীর্ঘদিনের পরিচয় ভুলে শান্ত গলায় হুমকি দেন- আর একটা কথা বললে পিটায়া হাড্ডি ভাইঙ্গা হাজতে ভরমু, তারপর সারারাত কিলামু তরে, পরদিন বাঁইচা থাকলে সোজা কোর্টে চালান।
দীর্ঘদিনের সম্পর্কে ছেদ পড়ে যাচ্ছে দেখে পুলিশ ছেড়ে এলাকার ছাত্রনেতার কাছে যাই, পেটানো বা মেরে ফেলার কাজে তার চেয়ে দক্ষ কেউ অত্র এলাকায় নেই, অন্তত সেরকমই শুনেছি; আমার প্রস্তাবে ছাত্র নেতা শীতল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে- আমাকে কী অমানুষ মনে হয়? আমি বিড়াল মারবো? তা-ও কচি কচি বাচ্চাসহ? তেলাপোকা পর্যন্ত মারি না আমি!
বলি- কিন্তু শুনেছি, আপনি মানুষ মারেন…… আপনার রাজনীতির ক্যারিয়ারে অর্ধশত মানুষকে চিরতরে পঙ্গু করেছেন, গোটা দশেক গুম হয়েছে আপনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উদ্যোগে।
ছাত্র নেতা চোখ আরো শীতল করে বলেন, যারা গুম হয়েছে তারা অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে গেছে, আর যারা আহত-পঙ্গু, তারা ছোটবেলা থেকে খাঁটি দুধ খায়নি বলেই তাদের হাঁড়ে জোর কম, তাই অল্পতেই পা-হাত-মেরুদন্ড ভেঙেছে বা মচকেছে…. এতে আমাকে দোষ দেয়ার কী আছে? বিড়ালের মতো নিরীহ, তুলতুলে প্রাণীর গায়ে আমার হাতই উঠবে না, মেরে ফেলাতো অনেক দূরের কথা; আপনি এলাকার মুরুব্বি, সেকারণে ছাড় দেয়া গেল, নইলে এই অন্যায় প্রস্তাবের কারণে, নৈতিকতার দংশনে, আপনাকে হাতুড়ি থেরাপি দেয়া উচিত।
ছাত্রনেতার চোখ আরো শীতল হওয়ার আগেই সরে পড়ি… আপনি হয়তো ভাবছেন, বিড়াল আর বাচ্চাগুলোকে বাইরে ফেলে না দিয়ে কেন তাদের হত্যার মতো নিষ্ঠুর পথ বেছে নিতে চেয়েছি? আসলে সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি; আমার বাসা মতিঝিল, বিড়াল আর বাচ্চাগুলোকে বস্তাবন্দী করে গাবতলী ডাস্টবিনের পাশে ফেলে এসেছি একবার; মাসখানেক পর ছানা-পোনাসহ বিড়ালটি ঠিক ঠিক আমার বাসার সামনে এসে হাজির হয়েছে, নারায়ণগঞ্জও ফেলে এসেছি- সেখান থেকেও অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে এসেছে ওরা; সুতরাং, মনে হতো, ওদের থেকে রক্ষা পাবার উপায়- ওদেরকে হত্যা, এর বিকল্প নেই… পরে একজন পরামর্শ দেয়, বাস ড্রাইভাররা বেশ নিষ্ঠুর হয়, এমনকি পুলিশ ও ছাত্রনেতার চেয়েও বেশি।
একজন বাস ড্রাইভারের কাছে গিয়ে প্রস্তাবটা দিই- একটা বস্তায় ভরে বিড়ালগুলো রাস্তায় ফেলে রাখব, সে জাস্ট বাস চালিয়ে দেবে ওদের ওপর; শুনে, ভয়ানক রাগান্বিত হয়ে সে জানায় বিড়াল পিষে মারার মতো অমানবিক কাজ তার তিনপুরুষে করেনি, সে আমাকে পরামর্শ দেয়- কোনো চাইনিজের কাছে যেতে, চাইনিজরা বিড়াল খেতে ভালবাসে আর তারা খাওয়ার জন্যে নিয়ে গেলে তাতে আমার পাপ হবে না এবং সেটাকে ঠিক আর হত্যাও বলা যাবে না……
পরামর্শটা আমার পছন্দ হয়, এটাই সবচেয়ে দারুণ সমাধান।
আমার শালা বায়িং হাউজে চাকুরি করে, তার পরিচিত গোটা দশেক চাইনিজ আছে, তাকে আমার সমস্যা বুঝিয়ে বললে সে তার এক চাইনিজ বন্ধুর কাছে নিয়ে যায়…. চাইনিজ ভদ্রলোক বলেন- আপনার প্রস্তাবে আমার জিভে জল আসছে, বিড়ালের বাচ্চা সত্যিই দারুণ উপাদেয় খাবার- শিকে পুড়িয়ে গার্লিক নান দিয়ে খেতে ভালবাসি, কিন্তু কিছুদিন আগেই এক চাইনিজকে পুলিশ আটক করেছে বিড়াল খাওয়ার অপরাধে; এখানে কুকুর বিড়াল খাওয়া নিষেধ, তাই জিভে জল এলেও এই অনুরোধ আমি রাখতে পারব না কেননা এদেশের আইনের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল।
এই পর্যায়ে এসে হতাশ হয়ে পড়ি দেখে শালা পরামর্শ দেয়, কাটাবন পশু-পাখির দোকানে গিয়ে বিক্রি করে দেয়া যায় কী না দেখতে; আমি তখনি কাটাবন গিয়ে এক বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করি, সে বাচ্চাসহ বিড়াল কিনতে ইচ্ছুক কী না? বিক্রেতা ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে জানতে চায়, বিলাই কি বিলাতি? তাকে জানাই- বিড়াল খাটি দেশি, সুস্থ, বেশ সুর করে ডাকে।
পশু-পাখি বিক্রেতা মাছি তাড়ানোর মতো তাড়িয়ে দেয় আমাকে, তবে তার আগে পরামর্শ দেয় বন অধিদপ্তরে যোগাযোগ করতে…. বন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার কাছে গেলে দেখি সে বই পড়ছে- আপনার বন্ধুর বই; আমার সমস্যার কথা জানালে কর্মকর্তা জানান, বিড়ালের কোনো ক্ষতি হয়নি এই মর্মে, সরকারি পশু ডাক্তারের সার্টিফিকেট যোগাড় করতে হবে আমাকে এবং প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্তৃক সত্যায়িত কপি জমা দিতে হবে, তারপর হাতে লেখা আবেদন পত্র জমা দিতে হবে, কম্পিউটারে টাইপ করা আবেদন গ্রহণযোগ্য না; সাথে আমার নাগরিক সনদপত্রের সত্যায়িত কপি, সত্যায়িত দুই কপি সদ্য তোলা রঙিন ছবি আবেদন পত্রের সাথে যুক্ত করে দিতে হবে।
আবেদনের কতদিন পর বন অধিদপ্তরের নিকট বিড়াল হস্তান্তর করা যাবে জানতে চাইলে তিনি জানান, এক একটি আবেদন পত্র যাচাই-বাছাইয়ে ন্যুনতম তিনমাস সময় লেগে যায়, আবেদন পত্র গৃহীত হলে, বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিড়ালের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যে সরেজমিনে আবেদন পত্রে দেয়া ঠিকানা বা স্থান পরিদর্শনে যান আর তারা পরিদর্শন করে সন্তুষ্ট হলেই কেবল বিড়াল হস্তান্তর হয়ে থাকে; সবমিলিয়ে ছ-সাত মাসের মধ্যে বিড়াল হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে……. জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়ি, তবে ভদ্রলোক যথেষ্ট সজ্জন, তিনি আমাকে পড়তে থাকা বইটি উপহার দিয়ে জানান এতে বিড়াল বিষয়ক একটি গল্প আছে. পড়লে ভাল লাগবে আর দ্রুত আবেদন করে ফেলার অনুরোধও জানান।
বিড়ালের চিন্তা মাথা থেকে কিছু সময়ের জন্যে নামিয়ে বাসায় ফিরে বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ হই, এছাড়াও বিড়াল বিষয়ক সমস্যার একটি ভাল সমাধান মাথায় আসে গল্পটি পড়েই…. আমার মুগ্ধতা লেখককে জানানো জরুরি মনে হয়েছে, তাই ঠিকানা খুঁজে চলে এসেছি। আপনি কী আমাকে আরেক গ্লাস পানি দেবেন? গলা একদম শুকিয়ে গেছে।’
আমি পানি নিয়ে আসতে আসতেই আমার লেখক বন্ধু চলে আসে বাজার সদাই নিয়ে। সে বাজার ভেতরের ঘরে পাঠিয়ে আগন্তুককে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘ইনি কে?’
আমি বলি, ‘তোর ভক্ত। তোর সাথে দেখা করতে এসেছেন। তোর কোন এক গল্প নিয়ে যেন আলাপ করতে চান। সম্ভবত “বিড়াল” গল্পটা।’
‘ও আচ্ছা। ভাল আছেন আপনি?’
‘জ্বি। হ্যাঁ, আপনার “বিড়াল” গল্পটা নিয়েই আলাপ করতে চাই।’
‘ও। ওটাতো সাধারণ একটি গল্প। তবে আপনার ভাল লেগেছে শুনে আনন্দ লাগছে। ’
‘এটা আপনার বিনয়, অমন অদ্ভুত আর নিপুণ ম্যাজিক রিয়েলিজমের কাজ আমার দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি; আমি নিয়মিত পড়ি, সুতরাং আমি জানি আপনার এই কাজটা কালোত্তীর্ণ হয়েছে।’
ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি নিজেই থমকে যাই এবং বুঝতে পারি লেখক বন্ধুও থমকে গেছে। আমার জানামতে ‘‘বিড়াল’’ গল্পটি প্রাণীটির সহজাত প্রবৃত্তিকে উপজীব্য করে লিখা। উন্মাদ, পরকিয়াপ্রিয়, মদাসক্ত, শয়তান পূজারী এক বিজ্ঞানীর গবেষণাগার থেকে ছানাদের নিয়ে পালিয়ে আসার গল্প সেটা। সেখানে ম্যাজিক রিয়েলিজম কোথায় সেটাইতো বুঝে আসে না আমার। ভদ্রলোক কী তবে অন্য কারো গল্পের সাথে গুলিয়ে ফেলছেন গল্পটিকে? আমি জানি, একই ভাবনা আমার লেখক বন্ধুর মনেও চলছে। তবে সে জড়তা থেকে অচেনা কাউকে প্রশ্ন করতে দ্বিধা করে। কিন্তু আমার সে জড়তা নেই।
প্রশ্ন করি- ‘আপনি কোন গল্পটার কথা বলছেন আসলে? গল্পের শেষে কী আছে বলুন তো?’
‘বললামইতো, “বিড়াল” গল্পটা….. ওই যে, একটি বিড়াল ছানাদের নিয়ে গবেষণাগার থেকে পালিয়ে যায়, পালাতে গিয়ে মাটির গভীর গর্ত ধরে ছুটতে ছুটতে অন্য ডাইমেনশনে পৌঁছে যায়, যেখানে বিড়াল ও তার ছানারা হয়ে যায় মহান আত্মা আর ওই ডাইমেনশনে মূলত অশরীরি আত্মাদেরই বাস; নানান ঘটনাক্রমে বিড়ালটি সকল আত্মার সমর্থনে হয়ে পড়ে আত্মাদের প্রধান, যদিও এটা সাধারণ পাঠক ধরতে পারবে না…. তবে লেখায় যথেষ্ট ক্লু আছে- প্রধান আত্মাকে বিড়াল স্বভাবী, সাত প্রাণের অধিকারী, আদুরে ভয়ংকর প্রাণ- এসব বলা হয়েছে; বিড়ালেরা আত্মাদের পৃথিবীতে এক পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করতে চেয়ে আত্মাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুযায়ী চলে আসা সকল আইন রদ করে, নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সুবিধা হয়, এমন আইন চালু করে, এমনকি আত্মাদের কাছে ঘৃণিত যে বিষয়টা- শরীর বা আকার, তা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে; শেষে প্রচন্ড ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে তারা তবে গল্পের সবচেয়ে বড় টুইস্ট আছে শেষ লাইনে, যখন পছন্দের শরীর বেছে নেয়ার জন্যে বিড়ালের আত্মারা পৃথিবীতে নেমে আসে আর নিজেদের ভেতর দীর্ঘ আলাপের পর যখন বিড়ালের শরীর বেছে নেয়, আমি চমকে উঠি, এই দুর্দান্ত গল্পের প্রতি মুগ্ধতার রেশ কাটতেই চায় না যেন, সে কারণেই ছুটে এসেছি কথা বলতে।
‘ওহ বুঝতে পেরেছি…..’ বলেই দেখি বন্ধু ইশারা করছে কিছু না বলতে। ফলে থেমে যাই।
বন্ধু বলে, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এত কষ্ট করে ভাললাগা জানাতে এসেছেন দেখে। আপনার ঠিকানাটা রেখে যান। পরে কোনো বই বেরুলে সেটার সৌজন্য কপি আপনাকে পাঠিয়ে দেব।’
‘অনেক শুকরিয়া।’ বলেই ভদ্রলোক জানান বই বের হলে তিনি নিজেই সংগ্রহ করে পড়বেন। সৌজন্য কপি লাগবে না।
তিনি বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর বন্ধুকে বলি, ‘তিনি তোর “আত্মা” গল্পটা “বিড়াল” গল্পের সাথে মিলিয়ে ফেলেছেন কেন? বুঝতে পারলি কিছু?’
‘সহজ ব্যাপারটা ধরতে পারলি না? দাঁড়া, দেখাই তোকে।’ বুকশেলফ থেকে গল্পের বইটা এনে আমার সামনে ধরে আমাকে দেখায়, ‘এই যে দেখ, “বিড়াল” গল্পের পরে “আত্মা” গল্পটার প্রথম দুপাতা যদি না থাকে তাহলে কিন্তু ভদ্রলোকের বক্তব্য ঠিকই আছে। ভদ্রলোকের সংগ্রহে যে বইটা আছে সেটাতে বাধাইয়ের ভুলেই এই বিপত্তি ঘটেছে।’
‘এত্তেরিকা! বাধাইয়ের ভুলে দুটো পাতা বাদ পড়ে নতুন একটা গল্প হয়ে গেল দেখি। কিন্তু এটা ভদ্রলোককে জানিয়ে দিলেই ভাল হতো।’
‘ভদ্রলোকের মুগ্ধতা কাটাতে ইচ্ছে করলো না। তাছাড়াও পরবর্তী সংস্করণে, আমি ভুলে বাদ যাওয়া পাতা দুটো জেনে বুঝেই বাদ দেব। “বিড়াল” গল্পটা এভারেজ হয়ে গেছে। ওখানে সাহিত্য নেই। বড় বেশি নাটুকে। তারচেয়ে মাঝখানে দুটো পাতা বাদ দিয়ে গল্পদুটোকে এক করে টুকটাক এডিট করে নিলেই কিন্তু গল্পটা টিকে যাবার মতো এক গল্প হবে।’
‘কিন্তু, সেটা কী নৈতিক হবে? ওরকম গল্পতো তুই লিখিস নি। একজন পাঠক দেখিয়ে দিল বলেই না গল্পটা সামনে এল?’
‘পুরো গল্পটাইতো আমারই গল্পের ভেতর ছিল। এতে অনৈতিক কিছুতো দেখি না।’
‘সত্যিই কী তাই? ধর রবীন্দ্রনাথের কোনো গল্পের ভেতর থেকে যদি আমি দুটো গল্প মিলিয়ে নতুন এক গল্প বের করি, তবে সেটাকে কী রবীন্দ্রনাথের নতুন কোনো গল্প বলে চালানো যাবে?’
‘তা যাবে না। কিন্তু এত জটিল করার কিছু নাই দোস্ত। আমি এখনো বেঁচে আছি। সুতরাং, আমার দুটো গল্প মিলিয়ে একটি গল্প দাঁড় করাতেই পারি। এটা কেন তোর কাছে অগ্রহণযোগ্য শোনাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। দুটো গল্প মিলিয়ে দিলে যদি একটা অমর গল্প দাঁড়িয়ে যায় তখন সেটা করা উচিত না?’
‘না। কারণ, ওইরকম গল্প তুই লিখিস নাই।’
‘একমত নই। ভদ্রলোক না বললেও হয়তো কোনো একদিন বিষয়টা আমার মাথায় আসতো।’
‘ভদ্রলোক!’ নিজের অজান্তেই আর্তনাদ বেরিয়ে যায় মুখ দিয়ে।
‘কী হলো?’
উত্তর না দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাই। ভদ্রলোকের বিড়াল বিষয়ক ব্যক্তিগত গল্পের শেষটা শোনা হয়নি। ভদ্রলোক বিড়ালগুলো নিয়ে কী করেছেন সেটা জানা জরুরি। বাইরে গিয়ে এ গলি ও গলি, বড় রাস্তা, বাজার সবখানে চষে ফেলি। কোথাও ভদ্রলোকের দেখা মেলে না। ঘন্টাখানেক পর ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাই।
সোফায় বসে গা এলিয়ে দিয়ে জানাই, ‘পেলাম না ভদ্রলোককে।’
‘তাতে কী?’
‘তুই আসার আগে ভদ্রলোক বিড়াল বিষয়ে একটা গল্প বলেছেন, কিন্তু শেষটা জানতে ভুলে গেছি, তিনিও আর খেয়াল করেন নি বোধহয়।’
‘গল্পটা বল তো, শুনি।’
উপসংহারহীন গল্পটা বলি তাকে। কোনো গল্প একবার শুনলে মনে থাকে আমার। তাই কিছুই বাদ গেল না। শেষে বলি, ‘গল্পটা না জেনে ঘুম হবে না রে। কী করি?’
‘হুম। চমৎকার গল্প। গল্পের শেষটা এভারেজ হবে বলেই আমার ধারণা।’
‘কেমন এভারেজ?’
‘এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি যে, ভদ্রলোক হয়তো বিড়ালগুলোকে মেনে নিয়েছেন।’
‘যাহ, তাহলে তিনি অত কষ্ট করবেন কেন?’
‘তোর কাছে এর বিকল্প কোনো সমাধান আছে?’
কিছুক্ষণ ভেবে হতাশ হয়ে মাথা নাড়ি। ‘হতে পারে হয়তো নিজেই বিড়ালগুলোকে হত্যা করেছেন?’
‘তা হতে পারে। কিন্তু আপাতত ভদ্রলোক বিড়ালগুলোকে মেনে নিয়েছেন- এটা ভেবেই মন শান্ত কর। তবে ভদ্রলোকের এই গল্প লিখে ফেললে একটা দারুণ গল্প হয়ে উঠবে। কিন্তু আমি যদি এই গল্প লিখি সেটা কী অনৈতিক হবে? কী মনে হয় তোর?’
মাথায় জট লেগে যায়। সাথে সাথেই উত্তর দিতে পারি না বলে গলা ছেড়ে হেসে সে ভেতরের ঘরে যেতে যেতে বলে, ‘তুই ভাবতে থাক, আমি গোসল সেরে আসি। পরে একসাথে খাব।’
লেখকের কী উচিত কারো কাছে শোনা গল্প লিখে প্রকাশ করা? কিন্তু লেখক কী মানুষের গল্পগুলোই বলবেন না? সেটা হোক কারো কাছে শোনা গল্প বা চেনা কারো জীবনের গল্প। লেখক গল্পে অন্যের জীবন বেছে নেবেন, অন্যের গল্প বেছে নেবেন এটাতো সহজাত-সরল-স্বাভাবিক…. আবার মনে হয়, লেখক কেন শোনা গল্প বা অন্য কারো জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় নির্ভর করে গল্প লিখবেন। লেখক তো নিজের গল্পটাই বলবেন, নিজ উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার গল্প লিখবেন। লেখক শুনবেন-দেখবেন-উপলব্ধি করবেন অনেক কিছুই, অনেক গল্পই তার সামনে পার হয়ে যাবে ঋজু গম্ভীর, কিন্তু তার গল্পটা হবে তার নিজের। আনকোড়া। খাদহীন সোনা।
কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারি না আমি। বন্ধু গোসল সেরে আমাকে কয়েকবার ডেকে হয়রান হয়ে একা একা খেয়ে ভাতঘুমে ঢলে পড়ে, চোখের সামনে ঝাঁ ঝাঁ দুপুর গড়ায় সোনালি নিরুত্তাপ বিকেলে, আছরের আযানের মিষ্টি সুর আরাম আলস্যে বসে যায় বুকে-মনে। উপলব্ধি করি, অনেক সময় গড়িয়েছে তবুও নড়ি না। কেননা আমার ভাবনার থৈ মেলে না। লেখকের উচিত-অনুচিত বিষয়ে আমি ভেবেই চলি। ভেবেই চলি।
আখতার মাহমুদের ছোটগল্প বিড়াল বিষয়ক বিবিধ গল্প
পড়ে কেমন লেগেছে কমেন্টে লিখুন।
আরও গল্প পড়ুন:
মৃত সুখী নগর: আখতার মাহমুদের ছোটগল্প
মাহরীন ফেরদৌসের গল্প | ভুলে থাকার গল্প