‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ বিষয়ে যা বললেন নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন

গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না

‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’

বাংলাদেশে নারীদের হয়রানি করা, উত্যক্ত করা, তাদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা নতুন নয়। পথে-ঘাটে, বাসে-রিকশায়, হাটে-বাজারে সব জায়গায় নারীরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হয়। প্রতিদিনের পত্রিকা উল্টালে প্রায় ডজন খানেক নারী নির্যাতনের চিত্র চোখে পড়ে। ধর্ষণ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়ায় এসব।

নারীরা কেন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন? এর কারণ বিশ্লেষণে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, শিক্ষিত সমাজ কিংবা আমজনতা সবাই প্রায় তিনটি ভাগে বিভক্ত। একদল মনে করছে, ধর্ম না মানার ফলে, নারীদের রাস্তাঘাটে বের হবার ফলে এসব বাড়ছে।

আরেকদল মনে করছে, বোরখা বা হিজার না পরার ফলে, শালীন কাপড়-চোপড় না পরার ফলে এসব বাড়ছে।

আবার অন্য একটা দল মনে করছে, বিষয়টা কাপড়চোপড়ে নয়, বিষয়টা আমাদের মানসিকতায়। সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হবার ফলে এক শ্রেণির কুরুচিপূর্ণ পুরুষ এসব ঘটায়।

আসল কারণটি আসলে কি?

কয়েকদিন আগের ঘটনা। এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে তার শিক্ষক কুপ্রস্তাব দেয়। নানান ভাবে মেয়েটিকে অনেকদিন ধরে হেনস্তা করে। শেষে মেয়েটি পরিবারকে জানালে তাঁরা ঐ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করে। ব্যস, শেষ পরিণতি হিশেবে মেয়েটির গায়ে আগুন দেওয়া হয়। মেয়েটি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালের বেডে। শেষ খবর পাওয়া গেলো যে মেয়েটি জীবন যুদ্ধে হেরে  মারা গেছে।

এটি কি স্বাভাবিক মৃত্যু? এটি কি হত্যাকাণ্ড নয়?  

মাদ্রাসার মতো একটি প্রতিষ্ঠানেও যদি মেয়েরা নিরাপদ না থাকে তাহলে মেয়েরা আসলে কোথায় নিরাপদ এ প্রশ্ন থেকেই যায়।

নারীদের এসব নির্যাতনের বিষয়ে কিভাবে জনসচেতনা তৈরী করা যায় তা নিয়েই ভেবেছেন একজন তরুণী। বেশ কয়েক বছর যাবত গণপরিবহনে বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে। বাসের ভিতরে নারীদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা)) চারুকলা অনুষদ থেকে চিত্রকলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা নিশাত জাহান নিশা একজন ডিজাইনার। তিনি একটি অভিনব উপায় এসবের প্রতিবাদ শুরু করলেন।

ঘটনাটি বছর খানেক আগের। নিশাত জাহান নিশাসহ কয়েকজন তাদের প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ভিত্তিক কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানে প্রথম নিয়ে আসেন ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লিখা সম্বলিত খোঁপায় পরার কাঁটা। অন্যরকম এই কাঁটার চাহিদা দিনদিন বাড়তে থাকায় তাঁরা নিয়ে আসেন এই লিখা সম্বলিত টি-শার্ট।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই টি-শার্টটি ভাইরাল হলে একধরণের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কেউ কেউ প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে স্ট্যাটাস দেওয়া শুরু করে। কেউ কেউ এর সমর্থনে যুক্তি উপস্থাপন করেন। কেউ কেউ আবার বিষয়টিকে স্রেফ মজার ভেবে নিয়ে ট্রল করা শুরু করেছেন।

নিশা বলেন, “এই টি-শার্ট পরলেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে না। তবু তার বিশ্বাস, ‘আমাদের সোচ্চার আওয়াজই পারে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো নির্মূল করতে।”

শিশু ধর্ষণের জন্য আপনি নিজেই কি দায়ী নন?- পড়তে ক্লিক করুন

এরই ধারবাহিকতায় এই বিষয়টি নিয়ে নিজের অভিব্যক্তি জানিয়েছেন, প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তিনি তার ভেরিফাইড ফেসবুকে ওয়ালে পোস্ট দিয়ে জানান, ‘শুধু ঘা ঘেষে দাঁড়াবেন না’ এটি লেখায় যথেষ্ট নয়। টি শার্টে আরো কি কি লিখা উচিত এ বিষয়ে তিনি একটি লিস্ট ফেসবুকে পোস্ট করেন।

উল্লেখ্য যে তসলিমা নাসরিন নারীর অধিকার, ধর্মীয় কুসংস্কার, লিঙ্গসমতা, নাস্তিকতা, মুক্তিচিন্তা নিয়ে লিখালেখি করার কারণে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েন এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হোন। তিনি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন। বর্তমানে তিনি ভারতে আছেন।

 

আরো কি কি বিষয় টিশার্টে লিখা যেতে পারে সে বিষয়ে তসলিমা নাসরিন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লেখা টি-শার্ট বাংলাদেশের কিছু মেয়ে পরছে। এরকম টি-শার্ট আরো মেয়ের পরা উচিত। আরো কিছু লিখতে হবে টি-শার্টে।

১.

ঘেষবেন না, আমি আপনার মা বোন নই

২.

যৌনবস্তু নই। তফাত যাও।

৩.

নারী -নির্যাতন বন্ধ করো।

৪.

আমরা তোমার সহযাত্রী, আমরা খাদ্য নই।

৫.

বর্বরতা দূর করো। সভ্য সমাজ গড়ে তোলো।

৬.

পুরুষতন্ত্র বিদেয় করো, বিবেকবান মানুষ গড়।

৭.

পশুর কাছে ধর্ষণ না করা শেখ।

৮.

ধর্ষণমুক্ত সমাজ চাই।

৯.

নারীবিদ্বেষ আর নয়।

১০.

নারীর সমানাধিকার ছাড়া সমাজ সভ্য হয় না।

১১.

আমি আপনার স্ত্রী নই, প্রেমিকাও নই। দূরত্ব বজায় রাখুন।

১২.

আমাকে বাধ্য করবেন না আপনাকে ঘৃণা করতে।

১৩.

নারীবিদ্বেষী হওয়ায় কৃতিত্ব নেই, বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হন।

১৪.

পুরুষাঙ্গ হওয়ার চেয়ে পুরুষ হওয়া ভালো।

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top