সাব্বির রহমানের পরিসংখ্যান
৬৫ রান তাঁর সর্বোচ্চ ওয়ানডে ক্রিকেটে। নিউজিল্যান্ডের সাথে ছিল সেই ম্যাচ। নেমেছিলেন ওয়ান-ডাউনে যখন দেশের ক্রিকেটে তাঁকে খুব জোর করে ভিরাট বানানোর চেষ্টা চলছিলো। আহা! পারফেক্ট ওয়ান-ডাউন ব্যাটসম্যান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা! সফল হোননি! প্রায় পাঁচ বছর খেলেছেন দলে। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানটা তাঁর টি-টুয়েন্টি সর্বোচ্চ থেকে কম।
৫৪টি ম্যাচ! দলে-সংবাদমাধ্যমে তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে তকমা পেলেও প্রায় পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড়কে কি তরুণ বলা যায়? গড় ২৪.৫১। যদি এই চার-পাচ বছরই সাতে খেলতেন তাহলে এই গড় ছিল গ্রহণযোগ্য। কিন্তু মাঝে অনেকগুলো ওয়ানডে তিনে খেলেছেন এবং হতাশ করেছেন। এই হলো পরিসংখ্যানের হিসেবে আমাদের সাব্বির রহমান।
ক্রিকেটার সাব্বির রহমানের সমস্যাটা কোথায়?
পরিসংখ্যানের হিসাবে খালিচোখে অসফল তিনি। এমনিতে চিন্তা করলেও খুব একটা সস্তি দেন না! ধারাবাহিক নন! খাম খেয়ালি ব্যাটিং। সে একজন স্ট্রোক-মেকার ব্যাটসম্যান এবং একজন স্ট্রোক-মেকার তিনেই সফল হওয়ার কথা। তাহলে ভুল কোথায়? ভুলটা প্রধানত টেপারামেন্ট। ব্যাটিং এর সময় প্রচুর পরিমাণ অস্থির থাকেন। একটা ডেলিভারি চার হলে পরের ডেলিভারি তাঁর মারতেই হবে। খারাপ বলের জন্য অপেক্ষা করতে চান না।
আর একটা সমস্যা হতে পারে সীমিত শট। একজন স্ট্রোক মেকার হওয়ার পরেও হাতে শট অনেক কম। মিড অন, মিড অফ তার স্কোরিং এরিয়া। এক্সট্রা কভারে মাঝে মধ্যে খেলেন যদি সেট হতে পারেন। হুক ও পারেন মাঝে মধ্যে। স্কয়ার কাট, স্কুপ খেলতে দেখেছি কিন্তু তা মাঝেমধ্যে। আমি মনে হয় তাকে বেশির ভাগ আউট হতে দেখেছি মিড অন আর কাউ কর্নার এর ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়ে। তার মানে একটাই, তিনি ভুল শুধরান না। সুইং এ দুর্বলতা তো আছেই। লেগ স্পিন খেলতেও সমস্যা বোধ করেন। টেকনিক নিয়ে কাজ করেন না। যদি করতো তাহলে মনে হয় হাতে আরো শট আসতো।
সবচেয়ে বড় সমস্যা তাঁর সম্পর্কে বেঠিক মেন্টালিটি এবং অতিরিক্ত ফেম পেয়ে যাওয়া। মেন্টালিটিতে সমস্যা কি সবাই জানেন। দুর্নামের অভাব নাই মাঠের বাইরে। কিন্তু তা সমস্যা হত না যদি মাঠে পারফর্ম করতেন। কষ্টের কথা, তিনি আউটডোর থেকে ইনডোর বেশি প্রেফার করেন।
২০১৪ সালে সানিয়া মির্জাকে উত্যক্ত, “ম্যাও” কান্ড, ড্রাইভার পেটানো কিংবা সফরে থাকাকালীন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফ্যানদের গালি দেওয়া। তাঁর বিতর্কের অভাব নেই। সতীর্থকে পিটিয়েছেন আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে ক্ষমাও চেয়েছেন। আর ফেম বাড়িয়েছে মিডিয়া। হার্ড-হিটার ব্যাটসম্যান, বাংলাদেশের কোহলি। কত না উপাধি তার।
কোথায় হারিয়ে গেলেন সেই সাব্বির রহমান?
তাঁর আবির্ভাব যেকোনো প্লেয়ারের স্বপ্নের মতো। একজন অসাধারণ ফিল্ডার, অসাধারণ স্ট্রোক মেকিং এবিলিটি। স্টাইলিশ ব্যাটিং। একজন পিঞ্চ হিটার। একটা উঠতি প্লেয়ারের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কি আশা করতে পারেন? কিন্তু তার কাছ থেকে যতটা আশা করা হয়েছিল ততটা কি দিতে পেরেছেন?
নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ৬ মাসের জন্য। বিপিএলে ৬ ম্যাচে করেছিলেন সব মিলিয়ে ৭৬ রান। সপ্তম ম্যাচে এসে সব পরিবর্তন করে দিলেন। খেললেন ৮৫ রানের একটা চোখে লাগার মতো ইনিংস। সত্যি বলতে কি! সাব্বির এর দিনে সাব্বিরই সেরা কিন্তু সেই দিন তো আসতেই চায় না। মাশরাফি ছিলেন বিপক্ষে। ইনিংস নিজ চোখে দেখলেন এবং মুগ্ধ হলেন। পরবর্তীতে প্রেস কনফারেন্সে বললেন, সাব্বির যদি নিউজিল্যান্ড সফরে দলের সাথে যুক্ত হয় তাহলে খারাপ হবে না।
নিষেধোজ্ঞা না মেনে কেন এতকিছুর পর প্রশ্নবিদ্ধভাবে দলে নেওয়া হল সাব্বির রহমানকে?
সাব্বিরকে দলে নেওয়া হলো নিউজিল্যান্ডের কিন্তু নির্বাচক কমিটি বললো, এটা অধিনায়কের চাওয়া আর অধিনায়ক বললেন, তিনি শুধু মত দিয়েছেন কিন্তু তিনি নির্বাচক কমিটির অংশ না তাই তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না।
দলে নেওয়ার জন্য নিষেধোজ্ঞা শিথিল কি বার্তা দেয়?
দলে তাঁর প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়ে কথা বলার আগে একটু তাঁর নিষেধোজ্ঞা শিথিলের বিষয় নিয়ে একটু কথা বলি। দলে নেওয়ার জন্য শাস্তি কমিয়ে করা হলো ৬ মাস থেকে ৫ মাস। বার্তাটা কি সঠিক? আমরা ঠিক কি বার্তা দিচ্ছি তাহলে বাকি খেলোয়াড়দের? অপরাধ যেহেতু করেছে সেহেতু শাস্তিটাও সম্পূর্ণ পাওয়া উচিত।
এই নজির যে সাব্বিরকে আরো বেখেয়াল করবে না সেটার কি নিশ্চয়তা? এই পাঁচ মাসে তাঁর কিন্তু কোনো সেঞ্চুরি নেই ঘরোয়া ক্রিকেটে। আছে তিনটি ফিফটি এবং বিপিএলে একটি ৮৫ রানের ইনিংস। যেখানে মুমিনুল, লিটনরা জাতীয় দল থেকে এসে ভূড়ি ভূড়ি রান করে ঘরোয়াতে সেখানেও নিজের মুন্সিয়ানা দেখাতে পারেননি। পারফরম্যান্স এর উপর দলে নেওয়ার কোনো সুযোগ তো আসে না তাহলে। এই পাঁচ মাসে খেলেছেন জঘন্য, নিজের সামর্থ্যের তুলনায়।
তাহলে তাঁকে নিচ্ছি কেনো? সামর্থ্যের ভিত্তিতে? মাশরাফি বলেছেন, বিশ্বকাপে ডেথ বোলিংয়ে প্রতিটি দলের সেরা বোলারগুলো বল করবে। তখন সেই বল সামলিয়ে রান করার অ্যাবিলিটি এই মুহূর্তে সাব্বির রহমানের আছে। কাপ্তানের কথা ভুল না!
সাব্বির নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এখনো খেলেননি। রিস্টের মোচড়, চমৎকার হ্যান্ড-আই কোঅরডিনেশন, যেকোনো সময় গিয়ার পরিবর্তন করা এই গুণগুলো সাব্বির রহমানের মধ্যে আছে। নিজের দিনে তিনিই বাঘ! একাই ম্যাচ পরিবর্তন করতে পারেন কিন্তু সামর্থ্যের উপর ভরসা করে আর কতদিন? আর কতদিন ৩০ গজের বাইরে থাকা একমাত্র ফিল্ডারের হাতেই ক্যাচ দিবেন। এসেছে ধারাবাহিক হওয়ার সময়।
সামর্থ্যের ভিত্তিতে নেওয়া হচ্ছে বুঝলাম। কিন্তু এতে কয়েকটি ব্যাপার খুব বাজে ভাবে চোখে লাগবে।
এক, সাব্বির রহমান কি এতই ভালো খেলোয়াড় যে তা নিষেধোজ্ঞা এক মাস কমিয়ে দিতে হবে যাতে জাতীয় দলে খেলতে পারে?
দুই, দলের বাকি খেলোয়াড়দের প্রতি কি বার্তা যাবে এবং তাঁরা কি শিক্ষা নিবে!
তিন, এতই খেলোয়াড় সংকট আমাদের যে একটা সাত নম্বরের ব্যাটসম্যান নেই?
চার, সাব্বির নিজে কি শুধরাবেন নাকি এর অপপ্রয়োগ করবেন? এবং অবশেষে, মাশরাফির ইচ্ছায় তিনি দলে আরেকটি সুযোগ পাচ্ছেন, এবারও ব্যর্থ হলে সাব্বিরের জাতীয় দলের ভবিষ্যত কি?
সাব্বির রান করুক। মাশরাফির ভরসা রাখুক। দলকে জেতাক। গরু দুষ্ট হলেও আমাদেরই তো। দ্বিতীয় সুযোগ তো দেওয়া যেতেই পারে। তবে এবার অসফল হলে নিজের ক্যারিয়ার নিজেই দাফন করবেন সাব্বির রহমান!