আধুনিক বিশ্ব বনাম কিউবাঃ কিউবার নারী অধিকার কি উন্নত বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়?

কিউবায় নারীর অধিকার

কিউবায় নারী অধিকার 

প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, নারীর অধিকার সংরক্ষিত হয় শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলিতে। পরিবার এবং রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়া নারীর সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়।

অর্থনৈতিক মুক্তি অবশ্যই একটি সাধারণ পূর্ব শর্ত হতে পারে। কিন্তু যথেষ্ট শর্ত পূরণ না হলে অর্থনৈতিক মুক্তি কাজ করে না।

বাংলাদেশের কর্মজীবি নারীদের অধিকার এবং সমমর্যাদা কি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে?

ধনী মুসলিম রাষ্ট্র সৌদী আরবের নারীরা কী একজন মানুষের পূর্ণ অধিকার পাচ্ছে? এমনকি উন্নত এবং উন্নততর বিশ্বেও কী নারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক অধিকার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে?

একই কাজে কী নারী-পুরুষ সমান মজুরী পাচ্ছে? শতকরা কত ভাগ নারী প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের পদে আসীন হতে পেরেছে? এই সব প্রশ্নগুলিকে ভিত্তি হিসাবে রেখে কিউবার নারী নিয়ে এই প্রবন্ধটি লিখা হয়েছে।

অর্থনৈতিক  ভাবে অনগ্রসর রাষ্ট্র কিউবায় নারী-পুরুষের সাম্য কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেল? সেই তুলনায় উন্নত বিশ্বের অবস্থান কোথায়? নারী-পুরুষ সাম্য প্রতিষ্ঠায় আর্থিক প্রাচুর্য নাকি অগ্রাধিকার বিবেচনা বা উভয়ের সমন্বয় প্রয়োজন? এই প্রবন্ধটির তথ্য সরবরাহের অধিকাংশ অংশ অনুবাদ করা হয়েছে।

কিউবায় বিপ্লবের বিজয় ল্যাটিন আমেরিকায় এক অসাধারণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উত্তরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর নতুন সরকার ১৯৫৯ সালে বিপ্লবের একেবারে শুরু থেকেই সংস্কারের প্রকল্পে দরিদ্রদের বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী সমাজে বৈষম্যের প্রধান শিকার নারীদের পরিস্থিতি উন্নয়নের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়।

বিপ্লবের মূল চেতনা ছিল “of the humble, by the humble and for the humble”। এই চেতনার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবের সাফল্য একটি নতুন যুগের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে।

ঐতিহাসিক এবং সামাজিক কাঠামোর সাথে সংযুক্ত বেদনাদায়ক অবিচার এবং অসাম্য থেকে দেশকে মুক্ত করা সেই নতুন যুগের একটি প্রধান লক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।  

বৈপ্লবিক সরকারের আশু অগ্রাধিকার ছিল কিউবার নারী। ১৯৬০ সালে ফেডারেশন অফ  কিউবান উইম্যান প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাউল ক্যাস্ট্রোর স্ত্রী ভিলমা এসপিন ডাবোইস।

ভিলমা জেনারেল ফালজেন্সিও বাতিস্তার স্বৈরতন্ত্র অবসানের বিপ্লবী সংগ্রামে একজন একনিষ্ঠ সক্রিয়তাবাদী ছিলেন।

কিউবায় নারীর অধিকার

নারীর কি অবস্থান নিয়ে বিপ্লব পরবর্তী কিউবা যাত্রা শুরু করেছিল? নারী-পুরুষের সমঅধিকার এবং সমান সুযোগ তৈরির জন্য কি কি নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল?

নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ এবং প্রচলিত সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে কি কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল?  

উত্তর পাওয়া যায় তিনটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে। দেখা যাক বিষয়গুলি কি ব্যাখ্যা করছে।

১। বিপ্লবের আগে 

১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বাতিস্তার সামরিক আইনের শাসনকালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শতকরা ১৭ ভাগ কিউবার নারী শ্রমজীবি ছিলেন। তারা সমমানের কাজে পুরুষ শ্রমিকদের চাইতে অনেক কম মজুরী পেতেন।

স্বামীদের অধিক ক্ষমতার বলে নারীদের জীবন সন্তান পালন এবং গৃহস্থালী কাজে সীমাবদ্ধ ছিল। নিরক্ষতার প্রাথমিক শিকার হিসাবে নারীদের জীবনে সমৃদ্ধি ছিল এক নির্মম পরিহাস। মোট ৫.৮ মিলিয়ন অধিবাসীর ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী কেবল ৫৫% শিশুরা শিক্ষার জন্য সুযোগ পেতো।

১ মিলিয়ন শিশুরা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়ে মায়েদের সাথে ঘরে অবস্থান করছিল। জনসংখ্যার শতকরা ২২% ভাগ অর্থাৎ ৮০০,০০০ জনেরও বেশী মানুষ নিরক্ষরতায় পীড়িত ছিল। এবং এই নিরক্ষর অংশের বেশীর ভাগই ছিল নারী।

১৯৩৩ সালের বিপ্লবের ফলে ১৯৩৪ সালে রামোন গ্রাউ স্যান মার্টিনের প্রগতিশীল সরকারের অধীনে কিউবার নারীরা ভোটাধিকার লাভ করেছিলেন। তথাপি রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা সীমিত ছিল।

১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৬ জন নারী বিধানিক পদে আসীন হয়েছিলেন(২৩ জন ডেপুটি এবং ৩ জন সেনেটর)।

বিপ্লব পূর্ববর্তী বাতিস্তা সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মূল চালিকাশক্তিগুলির মধ্যে নারীদের সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুধুমাত্র নারীদের জন্য একটি সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হলে কিউবার নারীরা সিয়েরা মায়েস্ত্রাতে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে ‘জুলাই ২৬ বিপ্লব’ এ অংশগ্রহন করেন।

বিপ্লবে অংশগ্রহনকারী নারী নেত্রীদের মতে,“ আমরা শুধু নারীদের অধিকারের জন্য লড়ছি না। আমরা প্রত্যেকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লড়ছি।”

কিউবায় নারীর অধিকার

 

২। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিপ্লবী সরকারের প্রথম পদক্ষেপসমূহ

জাতীয় অনুপ্রেরণা হোসে মোর্তের আদর্শ ১৯৫৯ সালের বিপ্লবের একটি অন্যতম প্রধান শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। বিপ্লবের সাফল্যের সাথে সাথেই কিউবা নারীর ক্ষমতায়নকে রাষ্ট্রের প্রধান অগ্রাধিকারের মধ্যে স্থান দেয় ।

১৯৫৯ সালের পহেলা জানুয়ারীতে দেশ থেকে পরাজিত বাতিস্তার পলায়নের কয়েক ঘন্টা পর ফিদেল ক্যাস্ত্রো তার প্রথম ভাষনে নারীদের পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন। সকল শোষিত এবং নির্যাতিত অংশের অবসান করা যে বিপ্লবী নতুন সরকারের লক্ষ্য, সেই ব্যাপারটি সকলের স্মরণে আনেনঃ

“নারীরা আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে এবং জীবনের অন্য সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। তাই তাদেরকে মুক্ত করতে হবে। যখন ভবিষ্যতে এই বিপ্লবের মূল্যায়ন করা হবে তখন অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রধান জিজ্ঞাসা হবে কিভাবে আমাদের সমাজ এবং আমাদের দেশ নারীদের সমস্যাগুলি সমাধান করেছে। বিপ্লবের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসাবে নারীর সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সর্বোচ্চ স্থির সংকল্প, দৃঢ়তা, অধ্যবসায় এবং প্রচেষ্টা।” 

বিপ্লবের সামাজিক এবং সাম্যবাদী অর্জনের সর্বাধিক সুফল ভোগ করে কিউবার নারী। ১৯৬০ সালে ভিলমা এসপিন দুবোই(Vilma Espín Dubois) ‘ফেডারেশন অফ কিউবা’ প্রতিষ্ঠা করেন।

এই ফেডারেশনের লক্ষ্য ছিল সমানিধিকার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য দূর করা এবং ফলশ্রুতিতে, নারীরা যেন সমাজে তাদের যথার্থ অবস্থান অর্জন করতে পারে এবং নতুন সমাজ গঠনে সম্পুর্ণভাবে নিজেদের অবদান রাখতে পারে।

ফিদেল ক্যাস্ত্রো এর প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন- 

আধা ঔপনিবেশিক সমাজে কিউবান নারীরা দ্বিগুনভাবে অপদস্থ এবং অবদমিত হয়েছে। তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। এমন প্রতিষ্ঠান যেটি তাদের নির্দিষ্ট স্বার্থ পূরণে প্রতিনিধিত্ব করবে এবং বিপ্লবের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণে তাদের বৃহত্তর অংশগ্রহন নিশ্চিত করবে।

দ্য ফেডারেশন অফ কিউবান উইম্যানের বর্তমানে চার(৪) লক্ষেরও বেশী নারী সদস্য রয়েছে।

ভিলমা এসপিন দুবোই কিউবান নারীদের শৃঙ্খল মোচনে মৌলিক ভূমিকা পালন করেন। বিপ্লবী কর্মী হিসাবে ‘জুলাই ২৬ আন্দোলন’ এর ২৬তম আন্দোলনে  যোগ দেন এবং ন্যাশনাল ডাইরেক্টোরেটের সদস্য হন।

১৯৫৮ সালে গেরিলা বিপ্লবে তিনি ফ্র্যাংক পেইস সেকেন্ড ইস্টার্ন ফ্রন্টে অন্যতম একজন প্রথম নারী সদস্য ছিলেন। বিপ্লবের সাফল্য অর্জিত হওয়ার পর তিনি আজীবন নারীদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে নিজেকে উৎসর্গ করেন।

তিনি সংসদে ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রিভেনশন এন্ড সোশ্যাল এটেনশন এন্ড কমিশন অন চিল্ড্রেন, ইয়োথ এন্ড উইম্যান’ইকুয়ালিটির সভাপতি হিসাবে কাজ করেন। ভিলমা ২০০৭ সালে মৃত্যুবরন করেন।   

কিউবায় নারীর অধিকার
ভিলমা এসপিন দুবোই(Vilma Espín Dubois)

ফেডারেশনের একটি প্রথম কাজ ছিল দেশে বিদ্যমান পতিতাবৃত্তির অবসান ঘটানো। বিপ্লব- পূর্ব কিউবার প্রায় ১০০,০০০ নারী এই পেশাতে ছিলেন। তাদেরকে এই পেশা থেকে মুক্ত করে নতুন সমাজ গঠনে অংশগ্রহন করানো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।

যৌন শোষনের জন্য দায়ী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণগুলি নির্মূল করার পর নারীদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পতিতাবৃত্তিতে কর্মরত নারীদের পূনর্বাসন করা হয়েছিল।    

হোসে মার্তির উক্তি “মুক্ত হতে হলে কর্ষিত বা অনুশীলিত হতে হবে(to be cultivated is to be free)” অনুসরণে কিউবা ১৯৬১ সালে একটি ব্যাপক নিরক্ষরতা দুরীকরণ অভিযান শুরু করে যেখানে  একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল নারী এবং বিশেষ করে অ-সাদা নারীদের জন্য সামাজিক অগ্রসরতার সাথে সাথে সাম্যবাদীতার সুফল তৈরী করা।

এই অভিযানে এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়। একই বছরে ১০,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যা কিনা ঔপনেবিশিক আমলের ষাট(৬০) বছরের রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত মোট বিদ্যালয়ের পরিমানের চাইতেও বেশী।

অরিত্রির আত্মহত্যাঃ একটি ৩৬০ ডিগ্রি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা- পড়তে ক্লিক করুন

এই উদ্যোগের তাৎক্ষণিক একটি  সুফল হিসাবে এক(১) বছরের মধ্যে ৭০০,০০০ জনের চাইতে বেশী নাগরিক অক্ষরজ্ঞান লাভ করে। এই অক্ষরজ্ঞান প্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর শতকরা ৫৫% ভাগ ছিলেন কিউবার নারী।

এর ফলে নিরক্ষতা কমে শতকরা ৩.৮% এ নেমে আসে। ১৯৬১ সালে ইউনেস্কো ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলির মধ্যে কিউবাকে “প্রথম নিরক্ষরতা মুক্ত রাজ্য” হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।

মায়েরা যেন কর্মক্ষেত্রে, বিভিন্ন প্রশিক্ষনে যেতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করতে পারে সেই লক্ষ্যে ১৯৬১ সাল থেকে কিউবা চিল্ড্রেন’স সার্কল (ডে কেয়ার সেন্টার/নার্সারী)প্রতিষ্ঠা করে।    

তারপর নারীর অধিকার এবং সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সাংবিধানিক এবং আইনগত কাঠামো প্রণয়ন করা হয়। সেকশনে ৪১ এবং সেকশন ৪২ সংবিধানে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার ঘোষনা করে এবং গোত্র, বর্ণ, লিং, ধর্ম বা অন্য যে কোন ব্যক্তি মর্যাদা হানীকর বৈষম্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে নির্ধারণ করে।

পেনাল কোড (আর্টিকেল ২৯৫) এর ৬২ ধারা অনুসারে সমানাধিকার লঙ্ঘনকে একটি অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এই অপরাধের জন্য দুই বছরের কারাবাসের শাস্তি নির্ধারিত হয়।

এই ভাবে কিউবার নারী সকল সরকারী পদে এবং সশস্ত্র বাহিনীর সকল পর্যায়ে কাজ করার পূর্ণ অধিকার ও সুযোগ লাভ করে।    

নারীর অধিকার উন্নয়নে কিউবা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও একটি অনুসরণীয় ভূমিকা রেখেছে। কিউবার নারী তাদের নিজেদের দেহের ব্যাপারে অবিচ্ছেদ্য অধিকার লাভ করেছে। কিউবাকে অনুসরণ করে ১৯৯৫ সালে গায়েনা এবং ২০১২ সালে উরুগুয়ে নারীদের একই অধিকার দেয়।

১৯৬৫ সালে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির মাঝে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে গর্ভপাত প্রথম আইনগত বৈধতা অর্জন করে। কিউবা প্রথম দেশ যে নারীদের প্রতি যেকোন বৈষম্য দুরীকরণের সম্মেলনে স্বাক্ষর করেন এবং দ্বিতীয় দেশ যে এই প্রস্তাবে অনুমোদন করে। 

কিউবায় নারীর অধিকার
ভিলমা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, রাউল ক্যাস্ট্রো (বাম পাশ হতে যথাক্রমে)

 

৩। আজকের কিউবায় নারীর অধিকার 

১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পর থেকেই নারীদের স্বাস্থ্য এবং জীবন যাপনের গুনগত মানোন্নয়ন জাতীয় অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। যেমন, নারীর বর্তমান আয়ু কাল আশি(৮০) বছর, যা পুরুষের আয়ুকাল থেকে দুই বছর বেশী এবং বেশীর ভাগ উন্নত দেশগুলির নারীদের আয়ুকালের সমমানের।

শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪.৬ যা তৃতীয় বিশ্ব এবং আমেরিকার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা)তুলনায় সর্বনিম্ন। প্রসবকালীন মৃত্যুর হার শতকরা .০২ ভাগ যা ল্যাটিন আমেরিকা এবং তৃতীয় বিশ্বের তুলনায় সর্বনিম্ন।

বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে শিশু জন্মের হার শতকরা ১.৫ ভাগ যা ল্যাটিন আমেরিকায় সর্বনিম্ন। তবে শিশু জন্মের এই হার প্রজন্ম বৃদ্ধিতে সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে তাদের আশংকা।    

আইনগত প্রেক্ষিতে, শ্রম আইনের আর্টিক্যাল-৫৯ নির্দিষ্টভাবে কিউবার মায়েদের জন্য প্রণীত হয়েছিল। এখানে বলা হয়েছে,“নিয়োগকর্তা কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ স্থাপন করবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবে যাতে মায়েরা কর্মক্ষেত্রে এবং সামাজিক দায়িত্বে পুর্ণ অংশগ্রহন করতে পারে।”

এর ফলে, কিউবান মায়েরা সন্তান জন্মদানের পূর্বে দেড় মাস এবং পরে তিন মাসের পূর্ণ বেতনে প্রসূতিকালীন ছুটি লাভ করার সুবিধা লাভ করে। এই ছুটিকে এক(১) বছর পর্যন্ত নিয়মিত বেতনের শতকরা ৬০% ভাগ গ্রহনের সুবিধায় বর্ধিত করা যায়।

এক বছর পর, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের পূর্ব পদে পূনর্বহাল হয়ে যায়। অধিকন্তু, অবসরকালীন ফান্ডে ত্রিশ(৩০) বার বাৎসরিক অবদান রাখলে কিউবার কর্মজীবি নারীরা ষাট(৬০) বছর বয়সে পূর্ণ ভাতায় অবসর গ্রহনের  অনুমোদন লাভ করে। তুলনামূলক বিচারে, ফ্রান্সে একজন ফরাসী নারীকে পূর্ণ অবসরকালীন ভাতা পেতে ফান্ডে বিয়াল্লিশ (৪২)বার বাৎসরিক অবদান করতে হয়। 

দেশের মোট শিক্ষার্থীর শতকরা ৬০% ভাগ নারী এবং তার মধ্যে শতকরা ৬৫% ভাগেরও  বেশী উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত হয়েছেন। ১৯৮০ সাল থেকে, গড়ে পেশাজীবি পুরুষ কর্মীদের চাইতে পেশাজীবী নারী কর্মীদের উচ্চতর শিক্ষার হার বেশী।

#MeToo: বাংলাদেশে মিটু আন্দোলন, এতদিন কেন মেয়েরা মুখ খোলেনি? -পড়তে ক্লিক করুন

মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৪% ভাগ নারী শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্ত। এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে মাঝারী এবং উচ্চ পর্যায়ের পেশাদার এবং কারিগরী শ্রেনীর (শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, গবেষক) শতকরা ৬৬% ভাগ হচ্ছে নারী এবং আমলাতান্ত্রিক পেশায় নারীরা বিপ্লবের পূর্বের শতকরা ৬.২% ভাগ থেকে বিপ্লবের পর থেকে শতকরা ৬৬% ভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

বর্তমানে একই মানের কাজে কিউবায় কর্মরত নারী ও পুরুষের সমান বেতন নিশ্চিত করা হয়। আর একই কাজে ফ্রান্সে নারীদের বেতন পুরুষের চাইতে শতকরা ২৮% কম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ২০% কম।  

অর্থনীতিতে নেতৃত্বমূলক অবস্থানে কিউবায় বিপ্লবের পূর্বে নারীর অবস্থান ছিল শতকরা ২% ভাগ। বিপ্লবের পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা ৪৬% ভাগ। এইক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সাথে  তুলনা করলে দেখা যায় ফ্রান্সে সিএসি ৪০টি কোম্পানীতে মাত্র পাঁচ(৫) জন নারী শীর্ষ পদে আছেন।

প্রশাসনিক এবং বিচারসংক্রান্ত পদে কিউবার নারী অর্থ মন্ত্রনালয়ে মোট সদস্যের শতকরা ৬৬% ভাগ এবং সরকারী অভিযোক্তার কর্মকর্তাদের শতকরা ৭৮% ভাগ কাজ করেন।

কিউবার রাজনৈতিক জীবনের সাথে দেশের নারীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেমন, কিউবার রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলে নারী সদস্য শতকরা ৪১.৯%, এবং কার্যনির্বাহী পদে শতকরা ২৩.৫% ভাগ।

২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, কিউবার সংসদে নারী ডেপুটির সংখ্যা শতকরা ৪৮.৯ ভাগ। সংসদে নারী সদস্যের সংখ্যায় বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে কিউবার অবস্থান তৃতীয় স্থানে।

একই ক্ষেত্রে, উন্নত দেশগুলির তালিকায় মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্রের অবস্থান ৭৮, ইউনাইটেড  কিংডমের অবস্থান ৫৮, কানাডার অবস্থান ৪৬। ফ্রান্সে সংসদে নারী শতকরা ২৬% আসনে আছেন। 

খেলাধুলায় কিউবার নারীদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। বিপ্লবের পর ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেন, “খেলাধুলা  মানুষের অধিকার, বিত্তশালীদের অধিকার নয়”।

কিউবায় নারীর অধিকার
কিউবান জাতীয়তাবাদী নেতা হোসে মার্তি

বিপ্লব পূর্ববর্তী কিউবায় খেলাধুলা শুধুমাত্র বিত্তশালীদের অধিকার ছিল। প্রত্যেকে যেন এই অধিকারভুক্ত হতে পারে সে জন্য কিউবায় শিশুর বয়স পয়তাল্লিশ(৪৫) দিন হলেই শারীরিক চর্চার শিক্ষা শুরু হয়।

মায়েরা সুস্বাস্থ্য গঠনে শিশুদের শরীর মেসাজ করার প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। শারীরিক চর্চাকে শিশুদের খেলাধুলার রূপে রূপান্তরিত করা হয়।

পরিশেষে, আমরা এই তথ্যগুলির ভিত্তিতে একটি সিদ্ধানে পৌঁছাতে পারি। কিউবার নারী নিয়ে একটি সাধারণ ধারনা এবং প্রচারনা কাজ করে। তা হলো, এই দেশ একটি দরিদ্র সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং সেই কারণে বেশীর ভাগ নারী পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হতে বাধ্য।

নারীর এই অবস্থানকে তারা একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা হিসাবে ইঙ্গিত করেন। একটি পরিবারের সদস্যরা বৈষম্যহীন হবে কিনা সেটি পরিবারের সংস্কৃতির উপর নির্ভর করবে। আর্থিক অবস্থা পুরাপুরি দায়ী থাকবে না। অভাব এবং সমস্যা ভাগাভাগিতেও সাম্যতা অবস্থান করতে পারে।

ধনী পরিবার বা ধনী দেশ মানেই জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র ভেদে সাম্যতা বজায় থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। আমরা দেখেছি বিশ্বের উল্লেখযোগ্য উন্নত দেশগুলির তুলনায় কিউবায় নারীদের অধিকার, মর্যাদা রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে এগিয়ে আছে।

সমানাধিকার, ন্যায় বিচার একটি পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি ও অগ্রাধিকার। কিউবা সেই প্রেক্ষিতে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এই দৃষ্টান্তকে ধরে রাখা, আরও এগিয়ে যাওয়া কিউবা তথা বিশ্বের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

তথ্য সহায়ক লিংকঃ  

> Women_in_Government

> Dr. Salim Lamrani(2017),Women in Cuba: the Emancipatory Revolution, HUFFINGTON POST 

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top