মরুর বুকে এক অসাধারণ মাহাকাব্য রচিত হলো গত ১৫-ই সেপ্টেম্বর। এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ পেলো এক দুর্দান্ত জয় । জয় দিয়ে শুরু হলো এশিয়া কাপ ২০১৮ তে বাংলাদেশের যাত্রা।
১৫-ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮। এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে খেলতে নেমেছে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা। মাশরাফি টসে জিতে নিলেন ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত। অনেক দিন পর শ্রীলঙ্কা দলে মালিঙ্গার অন্তর্ভুক্তি। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে ফিরেছেন দলে।
ক্রিকেট বিধাতা মাঝে মধ্যে খুব অসাধারণ কিছু গল্প লেখেন। সেই গল্পগুলোর মধ্যে এই ম্যাচটি অনায়াসে জায়গা পাবে।
তামিম ইকবাল বললেন– আমি প্যাড পরতে শুরু করলাম। মুমিনুল প্যাড করতে সাহায্য করল। মাশরাফি ভাই এসে আমার গ্লাভস কেটে আঙুল বের করে দিতে সাহায্য করলেন (দুই আঙুলে মোটা ব্যান্ডেজ ছিল)। জীবনে প্রথমবার অন্য কেউ আমার অ্যাবডোমেন গার্ড পরিয়ে দিল। সবাই সাহায্য করছিল আমাকে।
ওপেনিং তামিম ইকবাল এবং লিটন দাস। মালিঙ্গার প্রথম বলটি সিঙ্গেল নিয়ে লিটনকে স্ট্রাইক দিলেন তামিম। দ্বিতীয় বলটি লিটন ব্যাট চালানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু মালিঙ্গা এদিন যেন তাঁর পুরোনো রূপে। বলটি বাতাসে সুইং খেলো অনেকটুকু।
ওভারের পঞ্চম বল, পেস বোলারদের স্বপ্নের ডেলিভারি। মিডল স্টাম্পে পড়ে বাইরের দিকে সুইং, বলে খোঁচা দিলেন লিটন। পরিণাম প্রথম স্লিপে ক্যাচ। যে আশা নিয়ে লিটনের ক্লাসিক ব্যাটিং দেখতে বসেছিল অনেকেই, সেই আশায় গুড়েবালি।
ওয়ান ডাউনে নামলেন সাকিব। বাহাতি ব্যাটসম্যানদের কাবু করা মালিঙ্গার ইনসুইং ইয়র্কার। বোল্ড! এক রানেই দুই উইকেট। বাংলাদেশ এর কোটি কোটি ভক্তের মনে এক শঙ্কা। ম্যাচটা কি নিয়েই নিলেন মালিঙ্গা?
সুরঙ্গা লাকমল আসলেন। বাউন্সার পড়তে ভুল করলেন তামিম। বাম হাতের কবজিতে লাগলো বল। মাঠ ছাড়লেন তামিম। ৩ রানে ২ উইকেট। আদতে কি তাই? নাহ, স্কোরকার্ডে দুই দেখালেও আসলে তা তিন।
ক্রিজে আসলেন মিথুন। অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েছেন দলে। কিন্তু নার্ভাসনেসেই হয়তো ক্যাচ তুলে দিলেন ম্যাথুস এর হাতে কিন্তু ম্যাথুস মিস করলেন সুযোগ। ম্যাচটাও কি মিস করলেন?
মিথুন এর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে অনেকেই বলা শুরু করলেন, “ এই “লর্ড”কে কেনো দলে নেওয়া হলো”- এরকম অনেক সমালোচনা! সমালোচনা কি এইসব? নাকি অজ্ঞতা?
এই “লর্ড” মিথুন-ই সঙ্গ দিলেন মুশফিককে। আস্তে আস্তে তৈরি করলেন পার্টনারশিপ। যে পার্টনারশিপ বাংলাদেশকে ম্যাচ এ ফিরে আনলো। আপোনসোর বলে কত সুন্দর স্ট্রেট ডাইভ মিথুনের। সামনে এগিয়ে একটি ছক্কা তো মারলেন স্ট্যান্ডের দ্বিতীয় তলায়। অবস্থা বেগতিক।
১৩১ রানের পার্টনারশিপ হয়ে গিয়েছে। ম্যাথুস যেনো বাধ্য হয়েই আনলেন মালিঙ্গাকে। মালিঙ্গা তাঁর প্রতিদান দিলেন। মিঠুনের উইকেট নিলেন। মাহমুদউল্লাহ নামলেন। আপোনসোকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে তাল হারিয়ে ফেললেন। ক্যাচ ধরলেন ধনঞ্জয়া। আবারো বিপদে বাংলাদেশ।
ম্যাচটা জিতে গিয়েছি তখনই। এ যেনো এক বলের মহাকাব্য।
১৩৬ রানে ৪ উইকেট। একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক হোসেন নামলেন। নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ ছিল। হেলায় হারালেন মোসাদ্দেক। মুশফিক তখনো একা লড়ে যাচ্ছেন একপাশে। মিরাজ, ম্যাশকে নিয়ে ছোট ছোট পার্টনারশিপ। রুবেলও ১২ বল খেললেন। মুস্তাফিজ করলেন ১০ রান! কিন্তু অপ্রয়োজনীয় রান নিতে গিয়ে আউট হলেন।
মুশফিক ততক্ষণে সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। ১১ জনের সিংহের সামনে হয়ে রইলেন একমাত্র গর্জন করা বেঙ্গল টাইগার।
মুস্তাফিজ আউট হওয়ার নিরাশ মনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন মুশফিক। কিন্তু তখনো যে ক্রিকেট বিধাতার টুইস্ট-টা বাকি ছিলো। তামিম ব্যথা পেয়ে ফিরেছিলেন ড্রেসিংরুমে, সাথে সাথে হসপিটালে গিয়ে পরীক্ষা করে ধরা পড়ল কবজিতে চিড়।
৩-৪ মাস থাকবেন বাইরে, বললেন চিকিৎসক। কিন্তু তামিম যে হার না মানা যোদ্ধা। হয়তো মনে মনেই বললেন, “ ৩-৪ মাস শুরু হবে কালকে থেকে, আজকে দলের আমাকে প্রয়োজন।”
এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা –পড়তে ক্লিক করুন
মাঠে নামলেন তামিম ইকবাল খান। ডান হাতে স্ট্যান্ড নিলেন তিনি, বাম হাতে প্লাস্টার করা হাতের মধ্যে গ্লাভস ছিড়ে ঢুকানো। শরীরে বল করলেন লাকমল, লাফিয়ে উঠে ঠেকালেন তামিম। ততক্ষণে তামিমের মার চোখে অশ্রু, হয়তো বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের বুকে যেনো গর্বের অনুভব, চোখে অবাক চাউনি।
যে তামিমকে “কালা না পারা” বলা হতো, সে তামিম থেকে এমন ডেডিকেশন! তামিম ইকবাল জাস্ট ডিড অ্যা “গ্রায়েম স্মিথ”, বলতে থাকলেন ধারাভাষ্যকাররা। আহত বাঘের প্রবাদটা তো জানেন সবাই। আহত বাঘ সুস্থ বাঘ থেকেও অনেক বেশি ভয়ানক। তামিম খেলেছেন এক বল, কিন্তু এই এক বলের প্রভাব কতটা জানেন?
মুশফিক মনে যেনো জোর পেলেন আবার। জুড়লেন ৩২ রান। বোলাররা ড্রেসিংরুমে বসে অনুপ্রানিত। তরুণদের সামনে অদ্বিতীয় উদাহরণ। লড়াই না ছাড়ার মানসিকতা। ওই এক বল দেখে যদি আমার,আপনার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেতে পারে, চিন্তা করেন ড্রেসিংরুমে তাঁর প্রভাব।
ম্যাচটা জিতে গিয়েছি তখনই। এ যেনো এক বলের মহাকাব্য।
মুশফিক এর ম্যাচটা খেলার নাকি কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। পাজরের নয় নম্বর হাড়ে চোট, সেই চোট নিয়ে ৪১ ডিগ্রী তাপমাত্রায় প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা কাটিয়ে ১৪৪ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। দেশের প্রতি ডেডিকেশন দেখতে চান, দেখুন এদের। হিংসা হয় তো? পারবেন না ওদের মতো হতে।
থারাঙ্গা শুরু করেছিলেন ঝড়ো। মাশরাফি থামিয়ে দিলেন তা। মিরাজের দুসরায় পরাস্ত কুশল পেরেরা। রুবেলের ইনসুইংয়ে ম্যাথুস আউট। ফিজের আউটসুইংয়ে কুশল মেন্ডিসও ড্রেসিংরুমে। মুশফিকের কাছে ২০ রানে হারলেন লঙ্কানরা।
সাতটা-সাতটা ইনজুরি নিয়ে কালকেও লাফ দিয়ে ফিল্ডিং করেছেন মাশরাফি। তামিম ব্যাট করলেন এক হাতে প্লাস্টার নিয়ে। মুশফিক তাঁর এ পর্যন্ত খেলা সেরা ইনিংস খেললেন পাজরে হাড়ে চোট নিয়ে। দেশপ্রেমের এক অতুলনীয় উদাহরণ এরা।
আপনার কি মনে হয় না, এরা একটা বড় ট্রফি পাওয়ার যোগ্য। আধুনিক ক্রিকেটে এরকম নজির আর মনে হয় না কোথাও পাবেন। এশিয়া কাপ টাইগাররা জিতবে কিনা জানি না। তবে, ক্রিকেট বিধাতা এ ত্যাগ বিফলে যেতে দিবেন না। হয়তো এক অসাধারণ চিত্রনাট্য লিখে রেখেছেন তাঁদের জন্য।