মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(দ্বাদশ কিস্তি)
শীত এবছর একেবারে কমে এসেছে। বাইরে অল্প কুয়াশা আছে, তবে খুব একটা ঠাণ্ডা নেই। রিচি ‘রেডিয়েন্ট হাউস’এ যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। রেজা খান তাকে নিতে গাড়ী পাঠিয়েছেন, যদিও রিচি তা চায়নি। তার মনে অনেক প্রশ্ন, অন্তত সেগুলোর উত্তর খুঁজতে হলেও তার চাকরিটাতে আবার যেতেই হবে। বাবা সংসার ছেড়ে চলে যাবার পর যে মা তাকে গত বিশ বছর ধরে বড় করেছেন, আজ তাকেও কেমন অচেনা লাগছে তার কাছে। রেজা খান তাকে নিয়ে কোন গেম খেলছেন, সেটা সে ধরতে পারছে না। তার মা-ও এই গেমের বাইরে নয়, সেটা সে বেশ বুঝেছে। আবেদা সকালের নাস্তায় নরম সবজি খিচুরী করেছেন, সাথে গরুর কলিজা। খিচুরীর ওপর একটু ঘি ছড়িয়ে দেয়া তার অভ্যেস, তারও ব্যত্যয় হয়নি। এর সাথে যোগ হয়েছে জলপাইয়ের ঝাল আচার। রিচি কয়েক চামচ মুখে দিয়েই উঠে গেল।
‘কি রে আর খেলি না?’ আবেদা পেছন থেকে বলল।
‘ক্ষুধা নেই।’ রিচি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল।
‘সিনেমার নায়িকাদের মত খাবারের ওপর রাগ করছিস কেন? তুই তো নায়িকা না।’
‘তুমিই বা সিনেমার ভিলেনের মত বিহেভ কেন করছো, তুমিও তো ভিলেন না।’
‘আমার কোন আচরণ তোর কাছে ভিলেনের মত লাগলো?’
‘এই যে তুমি এতবার জিজ্ঞেস করার পরেও বলনি রেজা খানের কাছে আমাকে পাঠানোর মানে টা কি ? তোমরা ক্লাসমেট ছিলে এতে তো লুকোনোর কিছুই নেই, কিন্তু তুমি এতদিন আমাকে বলনি কেন?’
‘বলিনি, কারণ বলার সময় হয়নি।’
‘কবে সময় হবে? তোমার ওই ক্যারেক্টারলেস ফ্রেন্ড আমার সত্যি কোন সর্বনাশ করলে সেদিন হবে।’
‘রেজা ক্যারেক্টারলেস হলে অনেক আগেই সর্বনাশ করতে পারতো। অন্তত তোর বাবার থেকে সে ভাল মানুষ তা তোকে বলতে পারি। আর নায়িকাদের মত সর্বনাশ বলছিস কেন? তুই যে রেপড হোসনি, তাতো বুঝতেই পারছিস। তাই না?’
‘মা। তোমাকে অসহ্য লাগছে আমার এখন। তুমি কি ওমন হলে খুশি হতে?’
‘দেশে অনেক মেয়ে শরীর বেঁচে খাচ্ছে, তা তাদের কয়টা মা সেখবর রাখে? আমি আমার মেয়ের সব খবর জানি, এটাতো খুশি হবার মতই কথা। ’
রিচির চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি পড়লো। আবেদা তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি জানেন আজকের দিনটা তার সামনে আরো পরেও আসতে পারতো, কিন্তু বাস্তবতা বেশিদিন অপেক্ষা করেনি। তিনি জানেন, রিচিকে এই পর্যন্ত আনতে তাকে কতটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে একা। কেউ এসে দাঁড়ায়নি, রেজা খান বাদে।
‘তোর অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে, আর বিবেকে বেশি বাধঁলে নাও যেতে পারিস। আমি রেজাকে বলে দেব।’ রিচির ব্যগটা ধরে বলে আবেদা।
রিচি কোন কথা না বলে চোখ মুছে বেরিয়ে যায়, তখন কুয়াশা কমে রোদ উঠেছে। আবেদা তাকিয়ে থাকেন মেয়ের চলে যাবার দিকে, তার চোখেও জল। রিচিকে তিনি কতটা ভালবাসেন সেটা রিচিও জানে না। কিছু ভালবাসার প্রকাশ হয় খুব বাজে আচরণেও, তা সব মানুষ সবসময় বুঝতে পারে না। তাদের অভিধানে হয়তো ভালবাসা আর বাজে আচরণ একসাথে থাকতে পারে না। কিন্তু আবেদার কাছে তা আছে।
গাড়ির ব্যাকসিটের দরজা খুলতে যাবার আগেই রিচি চমকে গেল। ভেতরে রেজা খান নিজেই বসে আছেন। তিনি দরজাটা খুলে বললেন, ‘এসো’
রিচি বুঝতে পারছে না এই লোকটার সাথে তার বসে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। সে কিছুই ভাবার আগে রেজা আবার বললেন, ’দাড়িয়ে থেকোনা, অড লাগছে।’
রিচি ভেতরে গিয়ে বসলো, দরজাটা লাগাতেই তার দমবন্ধ লাগতে শুরু করলো। রেজা খান কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলেন সামনের দিকে। কিছুক্ষণ পর রিচিই বলল, ‘আমি আপনার চাকরিটা করতে যাচ্ছি না, আমার কিছু প্রশ্ন আছে সেগুলোর উত্তর পেলেই আমি চলে আসবো।’
রেজা মুচকি হেসে মোবাইলের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে বললেন, ‘আমার মনে হয় উত্তর পেলে তুমি নিজেই এই চাকরিটা করতে চাইবে। তার চেয়ে আমাদের আরো অপেক্ষা করা দরকার।’
‘কেন?’
‘তোমার কি ছোটবেলার কথা একদম মনে নেই? তোমাদের এই বাড়িতেই কালো সুট পড়া, আমার মত হাইট একটা লোক প্রায়ই আসতো, তার হাতে সবসময় গ্লুকোজ বিস্কুটের প্যাকেট থাকতো, তুমি দেখলেই সেটা হাত থেকে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে যেতে, মনে নেই?’
রিচি কিছুটা ঠাট্টার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেজার দিকে। তার সেসব কিছুই মনে পড়ছে না, বরং লোকটাকে তার মায়ের মতই অসহ্য লাগছে।
থানার নাম পাগলা, বেশিদিন হয়নি চালু হয়েছে। স্থাপিত ২০১২ লেখা। সবকিছু ঝকঝকে লাগছে। সরকারি অফিস অনেকটা নব্যবিবাহিত বধূর মত। নতুন নতুন অনেকটা সাজানো গোছানো আর রঙিন থাকে। দেয়াল থেকে নতুন আস্তরণের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, সামনে কিছু ফুলের গাছও লাগানো হয়। সময় বাড়ার সাথে সাথে যত পুরনো হতে থাকে ততই এর প্রতি মনোযোগ কমে যায়। তখন শ্যাওলা জমে আর ছাগলে খাওয়া ফুল গাছ দেখে পুরনো বউয়ের মত লাগে।
সাদাত থানার বাইরে রাখা একটা বেঞ্চিতে বসে এসব উল্টো পাল্টা ভাবছে, তার পাশে সুব্রত লাহিড়ী বাবু বসে আছেন। সকালের রোদটা তাদের পিঠ বরাবর পড়েছে। একটু দূরে আজগরের স্ত্রী আর বাচ্চা মেয়েটা বসে আছে। তার স্ত্রীর মুখ ঢাকা বোরকায়, তার হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। মেয়েটা মায়ের কোলে বসে থাকতে চাইছেনা, কিন্তু মা তাকে একটু পরপর শাসানি দিয়ে আটকে রাখছে। থানার ভেতরে হাজতে যাবার অপেক্ষায় থাকা তার বাবার সমূহ বিপদের চিন্তা যে তাকে এতটুকু স্পর্শ করেনি তা বেশ বোঝা যায় দুরন্তপনা দেখে।
‘চিন্তা করবেন না, আপনার কোন ঝামেলা হবে না। আজগর নিজেই সব স্বীকার করে ঘাড়ে নেবে।’ সুব্রত সাদাতের কাছে মুখ নিয়ে এসে খানিকটা ফিসফিস করে বললেন।
‘আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করছি না। থানা পুলিশের ঝামেলা আমার কাছে জটিল হলেও আমার বাবার কাছে ততই সহজ। কিন্তু আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন, আজগর নিজেই সব স্বীকার করবে, সেতো আমাকে ফাঁসাতে চাইছে।’ সাদাত তার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘আজগর সাধারন একটা গুটি মাত্র, ওরে আমি চিনি। মার্ডার ও নিজের খায়েশে করে নাই। এইখানে অন্য পলিটিক্স আছে। গুটি চালাইতেছে বড় মাথারা।’
‘আমি পলিটিক্স ভাল বুঝি না। তবে সেদিন রাতে কিন্তু আমি আজগরকে এই লোকটার ওপর একটু ক্ষেপতে দেখেছি।’
‘ওইসব কিছু না। সামনে ইলেকশন। এটাই বড় কারন।’
‘আমি আপনাদের খুব ঝামেলায় ফেলে দিলাম, এলাকায় ক’দিন থাকতে এসে কি হয়ে গেল।’
সুব্রত হাসলেন। হাসলেই তার কাশি পায়, কাশতে কাশতে কথা গুছিয়ে বলতে সময় লেগে যায়। মুখ থেকে একদলা কফ ফেলে বললেন, ‘আমারে আপনি ঠিক চিনতে পারেন নাই। আমাগো আগের অবস্থাটা নাই এইটা ঠিক, তবে আগের ডাট এহনো আছে। আপনি ঝামেলায় ফেলছেন ওই মাথাগুলারে। হা হা।’
আজগরের মেয়েটা সাদাতের দিকে দৌড়ে এল, সুব্রত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আজগর আমাদের বাড়িতে অনেক আগে থেকেই কেরোসিন দেয়। আমি চিনি ওরে। মাইয়াডার জন্য খারাপ লাগতাছে। বয়েস চারও হয় নাই। বউটাও ভাল, কেউ কখনও তার মুখও দেখে নাই। আচ্ছা আপনার বাপের কথা কি যেন বললেন, সে কি অনেক ক্ষমতার লোক নাকি?’
সাদাত কিছু বলতে চাইছিল না। এমন সময় করিম ভেতর থেকে দৌড়ে আসলো, সে যথারীতি হাপাচ্ছে। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে সাদাতকে বলল, ‘আপনারে বড় স্যার ডাকে। একটু জলদি আসেন। সে খুব পেরেশান।’
‘আপনি বসুন, আমি কথা বলে আসছি।’ সুব্রতকে বলে সাদাত উঠে দাঁড়াল। তার ধারনা এতক্ষণে এই ঝামেলার খবর তার বাবা জেনে গেছে। এখন পরিস্থিতি খুব দ্রুত পাল্টে যাবে। সুব্রত কিছু বলার আগেই সাদাত ভেতরে গেল।
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি