অরিত্রির আত্মহত্যা এবং আমাদের সামাজিক অবস্থান
জ্বর যেমন কোন রোগ নয়, রোগের একটি উপসর্গ মাত্র তেমনি অরিত্রির মৃত্যু মূল সমস্যা নয়, মূল সমস্যার একটি উপসর্গ মাত্র।
অরিত্রির মৃত্যুতে আমরা দুইটি দিক খেয়াল করতে পারি। একটি হলো, আত্মহত্যা। আরেকটি হলো, শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অসদুপায় অবলম্বন।
মানুষ কখন আত্মহত্যা করে? যখন তার মনে হয় তার সমস্যার কোন সমাধান আর সম্ভব নয়। বাবা, মা বা পরিবারের কেউ, কিংবা কোন বন্ধুবান্ধবকে অরিত্রির কাছে সমাধানের আশ্রয় হিসাবে মনে হয়নি।
শিক্ষকের কাছে, সহপাঠীদের কাছে, এবং সর্বোপরি, নিজের কাছে লাঞ্চিত হয়ে সে যখন পরিবারের কাছে ফিরেছিল, তখন কী ঘটেছিল? পরিবার এবং আশেপাশের মানুষের কাছে সে কী মানসিক ভরসা হারিয়েছিল নাকি ততটাই ধিকৃত হয়েছিল যার ফলে সে নিজের জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল?
অরিত্রির ঘটনাকে সামনে রেখে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারি একজন সন্তানকে ঘিরে থাকা সুরক্ষার সেই বেড়াটিকে, যে সুরক্ষার বেড়া বলতে বুঝায় অভিভাবককে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে, শিক্ষককে, পারিপার্শ্বিক সমাজকে এবং রাষ্ট্রকে। জন্মের পর থেকে এরাই হয় সন্তানের চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রক এবং প্রভাবক।
একজন সন্তান কোন অপরাধ করলে বা ভুল করলে এই বেড়াটিকে প্রশ্ন করতে হবে যা ৩৬০ ডিগ্রী আকারে সন্তানের বিকাশে ভূমিকা রাখে। সন্তান যখন খুব কৃতকার্য হয় তখন সবাই তার কৃতিত্ব নেয়। তাহলে সন্তানের ব্যর্থতার দায়িত্ব তারা নিবে না কেন?
শিক্ষা ব্যবস্থা বনাম শিক্ষার্থী
যুগে যুগে রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনকে সমাধানের যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সামাজিক সমর্থন এত শক্তিশালী যে আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ হয় খুবই দুর্বলভাবে।
পরিবার, রাস্তাঘাট, থানা, জেলখানা, সন্ত্রাসীর আস্তানাসহ সবখানে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত একটি শক্তিশালী বিচার যন্ত্র। আমরা কি অপরাধীর সংশোধন চাই নাকি শুধু শাস্তি চাই?
অপরাধ সংশোধনের কোন কার্যকরী কলাকৌশলের সাথে সমাজ কি আদৌ পরিচিত? টক শোতে একজন শিক্ষক বলছিলেন যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক এবং মানসিক শাস্তির বিরুদ্ধে আইন প্রবর্তিত হয়েছে।
কিন্তু শিক্ষকরা জানে না শাস্তি এবং বকাঝকা ছাড়া কিভাবে শিক্ষার্থীদের সুশৃংখল করা যায়। তাই প্রশ্ন থাকে, শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন ছাড়া বিকল্প পদ্ধতিতে সন্তানকে ভুল সংশোধনে সাহায্য করার জন্য ৩৬০ ডিগ্রী বেড়ার পক্ষদের সদিচ্ছা, জ্ঞান এবং যোগ্যতা কি যথেষ্ট?
চাইল্ড পর্নোগ্রাফি, চাইল্ড ট্রাফিকিং, বিশ্বজুড়ে এক বিশাল বানিজ্য- পড়তে ক্লিক করুন
নৈতিকতার অবক্ষয় এবং অপরাধ
যে কোন অপরাধের মূলে কাজ করে নৈতিকতার অভাব। কেউ যদি নৈতিকতার শিক্ষা আত্মঃস্থ করে, ধারণ করে তাহলে তার পক্ষে অপরাধ করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। শাস্তির ভয়ে কিংবা পুরুষ্কারের লোভে কেউ নৈতিক শিক্ষা অর্জন করতে পারে না এবং তার ব্যবহারিক প্রয়োগ থাকে না।
দেশের কোন স্তরে অপরাধ এবং দুর্নীতি হচ্ছে না? সেই স্তরগুলিতে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তারাই তো আবার কারো না কারোর বাবা এবং মা। সন্তানদের জন্য তারা তাহলে কেমন আদর্শ মডেল হচ্ছেন?
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, প্রশ্নপত্র ফাঁস, সাজেশন কেন্দ্রিক কোচিং সেন্টারগুলি ইত্যাদি দুর্নীতি এবং অপরাধের পাঠ দান করে থাকে। সন্তান নৈতিক শিক্ষা মুখস্থ করছে আর তার চারপাশের মানুষদের অনৈতিক কাজকে সেই নৈতিক শিক্ষার উদাহরণ হিসাবে শিখছে। এইরকম একটি দ্বান্ধিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে অরিত্রিরা।
সন্তানদের থেকে আমরা কি চাই ?
সমাজ সন্তানদের থেকে কী চায়? ভালো গ্রেড, ভালো ডিগ্রী এবং ভালো চাকুরী চায়। এবং এই চাওয়া হয়ে যায় ‘যে কোন মূল্যে’র প্রতিযোগিতায়। এই লাগামহীন প্রতিযোগিতায় নৈতিকতার স্থান থাকে না।
এই প্রক্রিয়ায় অনৈতিকতা বরঞ্চ ন্যায্যতা পায়। অভিভাবকরা সন্তানের মাধ্যমে সমাজে জয়ী হতে চায়। সন্তান সেখানে একটি যন্ত্র মাত্র।
সন্তানের হাতে তুলে দেয়া হয় আধুনিক প্রযুক্তি। সেই প্রযুক্তিতে কখন, কতটুকু প্রবেশাধিকার পাবে? অভিভাবক কিংবা শিক্ষক সেই প্রযুক্তির ভালো ব্যবহারে কি আকৃষ্ট করছে? প্রযুক্তির বিশাল তথ্য ভান্ডারে কি আকৃষ্ট করছে?
সহিংসতায় ভরপুর আমাদের বিনোদন মাধ্যম
আমি ভিডিও গেইম লক্ষ্য করে দেখতাম সেখানে সহিংসতায় ভরপুর। যুক্তি হলো, ভালো উদ্দেশ্যে মানুষ হত্যা। যেমনটা করে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র। যেমনটা করা হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে হামলা করে নির্বিচারে হত্যা।
যেমনটা করা হয় ধর্মীয় সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হত্যাকান্ড। সব হত্যাকান্ডের একটি যৌক্তিক দিক থাকে। অভিভাবকরা নিজেদের স্বার্থেই দায়িত্বহীনভাবে সন্তানদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দেন। একটি কারণ হলো সামাজিক প্রভাব, আরেকটি হলো সন্তানকে গুনগত সময় এবং দেয়া থেকে নিজেদের রেহাই পাওয়া।
আমি দাবী করবো না উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পারিবারিক সম্পর্ক মানেই একটি বিশুদ্ধতার উদাহরণ। সবকিছুতে, সবসময় আরও ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ থাকে।
তবে আপেক্ষিক বিচারে বাংলাদেশ ভয়াবহভাবে পিছিয়ে। মূল বিষয়টি এখানে অনুপস্থিত। সেটি হলো, যুক্তি এবং নৈতিকতার সমৃদ্ধিতে যে অপরাধ প্রবনতা এবং অপরাধের সংশোধন সম্ভব সেই ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক চর্চা অনুপস্থিতি।
মুখে মুখে এমনকি মিডিয়াতে গর্বের সাথে বলতে শুনি, আমাদের বাবা মা এবং শিক্ষকরা তো আমাদের শারীরিক শাস্তি দিতেন। আজকের পরিস্থিতি তো তারই একটি বিবর্তন প্রক্রিয়া।
উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা
এখানে কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা যেতে পারে। কানাডার স্কুলগুলিতে প্রথম, দ্বিতীয় হওয়ার নিয়ম নেই। একজন আরেকজনের ফলাফল জানে না। আমি আমার ছেলেদের বলেছিলাম, প্রতিযোগিতা হতে হয় নিজের লক্ষ্যের সাথে, অন্য কারোর সাথে নয়।
একটি ক্লাসে সবাই সর্বোচ্চ নম্বর কেন পেতে পারবে না? এখানে স্কুলে ক্লাসে পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গুনাবলীগুলির একটি মূল্যায়ন হয়। প্রতি স্কুলে একজন ছাত্র উপদেষ্টা থাকেন, নিয়মিতভাবে আভিভাবকদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে থাকেন।
তার মানে কি উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থা নিখুঁত?
না। এখানে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের সমস্যা আছে, আদিবাসী এবং কালো সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে বৈষম্যের অভিযোগ আছে, ধনী-দরিদ্র এলাকাভেদে স্কুলের আর্থিক অবস্থানের পার্থক্য আছে, বুলিং এর সমস্যা আছে।
প্রাইভেট কোচিং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে এশিয়ার পরিবারগুলির মধ্যে। স্কুলে গ্রেড নিয়ে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা না থাকলেও দেশীয় পরিবারগুলি ঠিকই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে। সংখ্যায় অল্প হলেও বেসরকারী স্কুল আছে। সেগুলি অধিকাংশই ধর্মীয় স্কুল।
তবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে পার্থক্য হচ্ছে যে এখানে সব সমস্যাগুলি সমালোচিত হয়। সমাধানের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। সন্তান নির্যাতিত হলে আইনের সহায়তা থাকে। বাংলাদেশের মত সন্তানকে অভিভাবক বা শিক্ষকের ব্যক্তিগত মালিকানা হিসাবে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে অনুমোদিত হয় না।
শিশু নির্যাতনের জন্য আপনি নিজেই কি দায়ী নন? – জানতে ক্লিক করুন
আমরা ‘সমাজ’ হিসাবে সুবিধাজনক ভাবে অসঙ্গতিগুলির সমালোচনা করি। একটি ব্র্যান্ডেড স্কুলের সাথে জড়িত দুর্ঘটনা নিয়ে সবাই কথা বলি। অথচ সারাদেশে অনেক স্কুলে যে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন অব্যাহত আছে তা নিয়ে বেশী কথা বলি না। ফলশ্রুতিতে অরিত্রিরা আত্মহত্যা করে।
কিন্তু বেঁচে থেকেও প্রতিনিয়ত কত সম্ভাবনা, কত প্রতিভার নীরব মৃত্যু ঘটছে। মাদ্রাসার লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কতজন যে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা জানা সত্ত্বেও সেই ব্যাপারে ভীষণ নীরব থাকি আমরা।
আমাদের কাজ হলো রোগের উপসর্গকে প্যারাসিটামল খাইয়ে আপাতত উপশম লাভ করা। এই উপসর্গকে ঘিরে থাকা ৩৬০ ডিগ্রী বেড়াটিতে নিহিত মূল সমস্যাগুলির চিকিৎসা করি না।
সবার জন্য একটি পরাজয়
আমরা প্রতিবাদ করি নিজেদের স্বার্থে। নিজেদের অপরাধবোধ, নিজেদের ব্যর্থতা চাপা দেয়ার জন্য। সন্তানের ভুলভ্রান্তিতে সাহায্য করার জন্যই তো অভিভাবক, শিক্ষক এবং রাষ্ট্র।
ভুল ভ্রান্তি হওয়ার ‘কারণে’র আগে ও পরে তারা অবস্থান করে এবং ‘কার্যকরী সংশোধন’এ তাদের অবস্থান করার কথা। এটা তো তাদেরই কাজ।
পরিশেষে, অরিত্রি হয়তো একটি ভুল করেছিল। আমি তার সম্পূর্ণ চিত্র জানি না। তবে একটি ব্যাপারে নিশ্চিত যে অরিত্রির মধ্যে একটি শক্তিশালী নৈতিক চেতনা ছিল।
সমাজ তাকে অনৈতিক অবস্থানে ঠেলে ফেলেছিল কিন্তু তার নৈতিক চেতনা তাকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে ঠেলে ফেলেছিল।
অরিত্রি নয়, অরিত্রির মৃত্যু আমাদের সবার জন্য একটি পরাজয়।