অবমূল্যায়িত অভিনেতা ফারুক আহমেদ:
অভিনেতা ফারুক আহমেদকে নিয়ে কিছু কথা
অভিনয় ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক বেশি কঠিন লাগে। একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু কিছু কিছু অভিনেতা আছেন যারা যেকোনো চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেন। অনেকটা আয়নাবাজির চঞ্চলের মতো।
অভিনেতা অভিনয় ছাড়া বাঁচতে পারেন না। তারা বাঁচেন অভিনয়কে কেন্দ্র করে। যারা সহজেই যেকোনো চরিত্রকে ধারণ করতে পারেন, তাদেরকে আমরা বলি জাত অভিনেতা। কারণ অভিনয় ব্যাপারটা আপনার আসতে হয় ভেতর থেকে। একটু নাচতে জানলাম কিংবা গলার স্বর গাঢ় করে চিজি ডায়লগ বলে ফেললাম তাতেই কিন্তু অভিনেতা হওয়া যায় না।
হিথ লেজার কিংবা ক্রিশ্চিয়ান বেলের নাম তো অনেকেই শুনেছেন। মেথড এক্টর হিসেবে পরিচিত এরা। এমনকি পাশের দেশের নওয়াজউদ্দিন একটা চরিত্রের জন্য মেথড এক্টিং এর সাহায্য নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে এমন কে আছেন? চঞ্চল চৌধুরীর কথা বলতে পারেন। মিসির আলী কিংবা আয়নাবাজির আয়না, মেথড এক্টিং প্রয়োজনীয়তা দুই চলচ্চিত্রেই।
মেথড এক্টিং ব্যাপারটা যদি না বুঝেন তাহলে বুঝাই। মেথড এক্টিং এর ব্যাপারটা হলো, একজন অভিনেতা তাঁর স্ক্রিপ্টের চরিত্রের ভেতর ঢোকার জন্য বাস্তবেও সেভাবে কিছুদিন থাকেন। হিথ লেজার তাঁর সেরা কাজটি করেছিলেন এই মেথড এক্টিং এর মাধ্যমেই। “দ্যা ডার্ক নাইট” চলচ্চিত্রে এমন অনেক সিন ছিলো যেখানে লেজার তাঁর ব্রিলিয়ান্স দেখিয়েছেন তাঁর এই অভিনয়ের মাধ্যমে। একটা সিনের কথা বললে ভালো করে বুঝবেন। জিম গরডন যখন জোকারকে আটক করেন এবং প্রমোশন পান তখন জোকার হুট করে তালি বাজাতে শুরু করে। এই তালি বাজানোর যে ব্যাপারটা সেটা স্ক্রিপ্টে ছিল না কিন্তু হিথ লেজার তাঁর চরিত্রের ভেতর এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিলেন যে হিথ লেজার এবং জোকার প্রায় এক মানুষই হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু হঠাত করে আমি কেনো মেথড এক্টিং এর কথা বলছি? কারণ আমার কাছে ফারুক আহমেদ এমন একজন অভিনেতা যাকে আমরা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারিনি। করতে পারলেও শুধুমাত্র কৌতুক চরিত্রগুলোতে করেছেন। চিন্তা করেন, সঠিক স্ক্রিপ্ট কিংবা কোনো ভালো নির্দেশকের হাতে পড়লে তিনি কতটা সর্বগ্রাসী হতে পারতেন।
তাঁকে সবচেয়ে ভালো করে ব্যবহার করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর প্রতিটি নাটকে ফারুক আহমেদ ছিলেন এবং প্রতিটিতে তাঁর অভিনয় ছিল দেখার মতো।
বলা হয়ে থাকে, প্রতিটি অভিনেতার জন্ম হয় মঞ্চ থেকে। মঞ্চ ছাড়া অভিনয় শেখা সম্ভব না। ফারুক আহমেদও তাঁর অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের নাট্যমঞ্চ থেকে। পড়ার সাবজেক্ট জিওগ্রাফি থাকলেও মন ছিল তাঁর নাটকে। পরবর্তীতে তিনি মীর মশাররফ হোসেন হলের নাট্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি যুক্ত হোন ঢাকা থিয়েটারের সাথে। ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় তিনি কীত্তনখোলা, কেরামত মন্ডল, যুবতী কন্যার মন, প্রাচ্য এবং বনপাংশুলসহ প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেন।
তবে বাংলা নাটকে তাঁর শুরুটা হয়েছিল বিটিভির “গ্রন্থিকগণ কহে” নাটকের মাধ্যমে। কিন্তু জনপ্রিয় হয়েছিলেন “বারো রকমের মানুষ” এর একটি নেতিবাচক চরিত্রের মাধ্যমে।
অবাক করার ব্যাপার, তাই না? যে মানুষটা সারা জীবন মানুষকে হাসিয়ে গেলেন তাঁর শুরুটা হয়েছিল একটি নেতিবাচক চরিত্র দিয়ে। চরিত্রটির নাম ছিল রসিকলাল। বিটিভির মাধ্যমেই তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করার। নাটকের নাম ছিল “অচিন বৃক্ষ”। পরবর্তীকে হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব নাটকে তিনি অভিনয় করেছিলেন। এমনকি তাঁর অভিনয়ে খুশি হয়ে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর একটি বই “লিলুয়া বাতাস” ফারুক আহমেদের নামে উৎসর্গ করেছিলেন।
তিনি শুধু একজন অভিনেতা না। তিনি নাটক রচনা এবং নির্মাণ দুইটিই করেছেন। “কালসাপের দংশন”, “উচ্চবংশ পাত্র চাই”, “দুই বাসিন্দা”, “বিয়েকাটা” সহ আরো কয়েকটি নাটক লিখেছেন। শহীদুজ্জামান সেলিম তাঁর লেখা প্রথম নাটক “উচ্চবংশ পাত্র চাই” এর নির্দেশনা দেন। তিনি নিজেও কিছু নাটক নির্মাণ করেছেন যেমন ‘পানিপড়া’, ‘ডিগবাজী’ ইত্যাদি। এই নাটকগুলো প্রচারিত হওয়ার পর সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
তাঁর অভিনয়ের ‘এক্স ফ্যাক্টর’ কি? ফারুক আহমেদকে আপনি যে চরিত্র দিবেন, তিনি সেই চরিত্র খুবই দক্ষতার সাথে করে ফেলবেন। হোক সেটা চোরের চরিত্র, বাটপারের চরিত্র, আলাভোলা এক মানুষের চরিত্র কিংবা চরম নেতিবাচক এক চরিত্র। নিজের মুন্সিয়ানা দিয়ে ফুটিয়ে তুলবেন যেকোনো চরিত্র। তাঁর এই অভিনয়ের এই দিকটা সুনিপুণভাবে ব্যবহার করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। হয়তো কিছু নাটকে স্ক্রিন টাইম কম পেয়েছেন কিন্তু যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন, তাঁর দিকেই আপনার চোখ আটকে থাকতে বাধ্য।
“উড়ে যায় বকপঙ্খী” নাটকে অভিনয় করেছিলেন তৈয়ব নামের এক চরিত্র। চরিত্রটি অনেকটা নেতিবাচক হলেও নাটক শেষে চরিত্রটার প্রতি আপনার ভালো লাগা এসে পড়বে। মিথ্যাবাদি, বাটপার, মেয়ে দেখলেই তাদের প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া এই চরিত্র মাঝে মধ্যেই মন জয় করেছে তাঁর সহজ সরল কথা বার্তা দিয়ে। “তোমাকে আজ বড়ই সৌন্দর্য লাগছে” এই এক লাইনই তিনি ব্যবহার করেছেন নাটকের প্রায় প্রত্যেকটা মেয়ের সাথে। “ধুর ছাতা, আর দলই করুম না” কিংবা “ আমি অতি উচ্চ বংশের ছেলে, সরকার বংশের” এই ডায়লগ ডেলিভারি এই চরিত্রের জন্য ফারুক আহমেদের চেয়ে ভালো কেউ পারত না।
তাঁকে কেনো আমি বলছি তিনি একজন অবমূল্যায়িত অভিনেতা? কারণ আমি খুব কম অভিনেতার মধ্যে এই গুণ দেখেছি যে দর্শককে ধরে রাখতে পারে।
উদাহরণ দেই। “উড়ে যায় বকপঙ্খী” নাটকে তিনি যতক্ষণ তাঁর স্ক্রিন টাইম পেয়েছিলেন ততক্ষণ আপনি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য। তাঁর ডায়লগ ডেলিভারি, চরিত্রের ভেতর ঢুকে যাওয়া কিংবা একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার পরও মনোটোনে না যাওয়া; এসব গুণাবলি খুব কম অভিনেতার মধ্যে দেখেছি আমি। চঞ্চল, মোশাররফ করিম, ফজলুর রহমান বাবু ছাড়া খুব কম অভিনেতার মধ্যে এই গুণগুলো আছে।
অথচ এত ট্যালেন্টেড হওয়া সত্ত্বেও সারা জীবন পার্শ্বচরিত্রেই অভিনয় করে গিয়েছেন। হয়তো চেহারা অন্য নায়কদের মতো নয় বলে কেউ মূল অভিনেতার সুযোগ দেননি। কিন্তু চেহারা যে কোনো ফ্যাক্টর না তা আমাদের অনেক নাটকের অভিনেতাকেই দেখলে বুঝতে পারবেন। এজন্যই আমি বলছি, আমাদের টিভি ইন্ডাস্ট্রি তাঁর প্রতি এক ধরনের অবহেলা করেছে। তাঁকে আরো ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারতাম আমরা!
আরও সিনেমা রিভিউ পড়ুন: